ঠাকুরগাঁওঃ আবহমান গ্রাম বাংলার থেকে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী ‘ভাদর কাটানি’ উৎসব জেলায় শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে নববধূরা দলে দলে শ্বশুর বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে ছুটছেন। স্বামীর মঙ্গল কামনায় সরকারি মতে ১লা ভাদ্র সোমবার, পঞ্জিকা মতে মঙ্গলবার থেকে ঠাকুরগাঁওয়ে শুরু হচ্ছে ভাদর কাটানি উৎসব। ভাদর কাটানি উৎসব পালন করতে বাড়িতে বাড়িতে চলছে নানা আয়োজন।
প্রচলিত রীতি ও জনশুতি অনুযায়ী ভাদ্র মাসের প্রথম ৩ দিন স্বামীর নববধূর মুখ দর্শন করলে তার এবং স্বামীর অকল্যাণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই বিয়ের পর প্রথম পাওয়া ভাদ্র মাসের ৩ দিন বাপের বাড়িতে অবস্থান করে নববধূরা। তবে এর কোন দালিলিক প্রমাণ না থাকলেও যুগ যুগ ধরে এই এলাকার মানুষ এসব আচার অনুষ্ঠান পালন করে আসছেন।
প্রাচীন কাল থেকে আজও এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। রীতি অনুযায়ী নববধূরা এই সময় সাধারণত বাবার বাড়িতে অবস্থান করে এবং স্বামীর মঙ্গল কামনা করে। ভাদর কাটানি উৎসব উপলক্ষে ঠাকুরগাঁওয়ে ঘরে ঘরে ভিন্ন আমেজ বিরাজ করছে। এরই মধ্যে অধিকাংশ নববধূ স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে চলে গেছেন।
এই প্রবণতাটি শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে একটু বেশি। নববধূরা তাদের স্বামীর মুখ দর্শন করবে না ভাদ্র মাসের প্রথম ৩ দিন। তাই নববধূরা তাদের স্বামীর বাড়ি থেকে এই ৩ দিনের জন্য বাবার বাড়িতে নাইওর যায়। গত বছরের আশ্বিন মাস থেকে এ বছরের শ্রাবণ মাস পর্যন্ত যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের নিয়েই এই আয়োজন। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর জীবনে প্রথম ভাদ্র মাসের প্রথম তিন দিন স্ত্রী স্বামীর মুখ দর্শন করলে স্বামীর চোখ দর্শন করলে বা অমঙ্গল, ঝগড়া-বিবাদসহ তাদের দাম্পত্য জীবন সুখের হবে না এমন বিশ্বাস থেকে শ্রাবণ মাসের শেষ ৭ দিন নববধূরা মা-বাবার বাড়িতে নাইওর যাওয়া শুরু করে। এটাকে স্থানীয় ভাষায় বলে ভাদর কাটানি।
এ উৎসবটি পালনে নববধূদের বাড়িতে পড়ে যায় সাজ সাজ রব। থাকে নানা আয়োজন। নববধূরা যে কদিন বাবার বাড়িতে অবস্থান কবে, সে কদিন তারা সামর্থ অনুযায়ী মেয়েকে ভাল-মন্দ খাওয়াবে। প্রচলিত এ প্রথাটি যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলে এভাবেই চলে আসছে। তবে কবে থেকে কিভাবে এই প্রথার শুরু তার সঠিক তথ্য কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। নববধূকে আনতে তার ছোট ভাই, বোন, বান্ধবী, নানী, চাচী, ফুফু ও প্রতিবেশিরা যাবে বরের বাড়িতে। সঙ্গে নিয়ে যাবে সামর্থ মত মুড়ি, পায়েস, নানা রকমের ফল, মিষ্টি। কেউ ভাদ্র মাসের আগের দিন আবার কেউ কয়েকদিন বাকি থাকতেই যায় বরের বাড়িতে। বর পক্ষ সাধ্যমত তাদের আপ্যায়ন করে। নববধূরা মা-বাবার বাড়িতে তিনদিন থাকে।
এরপর বরপক্ষের লোকজনও কনেকে আনতে যায়। তারা তাদের সাধ্যমত ফল, মিষ্টি, পায়েস, মুড়ি, মুড়কি, দই ইত্যাদি নিয়ে যায়। স্থানীয় প্রবীণ লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রাচীন এ লোকাচার তারা দেখে আসছেন। এই উৎসবটি প্রাচীন সংস্কৃতির সাথে মিশে আছে। কেউ কেউ এটাকে কুসংস্কার বললেও সামাজিক রীতির ভাদর কাটানি স্থানীয় লোকেরা শ্রদ্ধার সাথে পালন করে আসছেন।
জেলার সদর উপজেলার চিলারং ইউনিয়নের ভেলাজান এলাকার আবু তালেব এর মেয়ে এর মেয়ে শিউলি আকতার ৩ মাস আগে বিয়ে হয়েছে। স্ েভাদর কাটানি উৎসবের অংশ হিসেবে চলে গেছেন বাবার বাড়িতে।শিউলি জানান, ‘বিয়ের পর ভাদর কাটানি পালন করতে বাবার বাড়ি এসেছি।
অনেকেই বলে এটা কুসংস্কার তারপরও আমাদের পূর্ব পুরুষরা এটা করে এছেসে। তাছাড়া অনেকদিন পর বাবার বাড়িতে আসতে পেরে বেশ ভালোই লাগছে।’ এদিকে এই উৎসবে পিছিয়ে নেই এ জেলার মুসলমান ধর্মের দম্পতিরাও।সম্প্রতি জেলার সদর উপজেলার কলেজপাড়া এলাকার খোরশেদ আলমের মেয়ে নাজনীন আক্তার সাথে বিয়ে হয়েছে আকচা ইউনিয়নে। শিবগঞ্জ এলাকার জামাল উদ্দীনের ছেলে সোহাক রহমানের।
শ্রাবণের শেষ প্রান্তে এসে নববধূ নাজনীন আক্তারকেও ভাদর কাটানি হিসেবে বাবার বাড়িতে নিয়ে গেছে তার আত্মীয়-স্বজনরা। বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বিশ্রামপুর এলাকার মিনতি (৫২) বলেন, ‘পূর্ব পুরুষদের মূখে শুনেছে ভারতের জলপাইগুড়ি। দেশ বিভাগের পর আমরা বাংলাদেশে চলে আসি। ভারতে হিন্দু-মুসলমান প্রতিটি পরিবারে ভাদর কাটানি উৎসব ঘটা করে পালন করা হতো।
এটা তিনি ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছেন বলে জানান।’ ¯কুল শিক্ষক স্বপন কুমার রায় বলেন, ‘ভাদর কাটানি হলো আমাদের সমাজের প্রাচীন একটি প্রথা। এটা লোকাচার হলেও আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এ উৎসব আমরা জন্ম থেকেই দেখে আসছি। নব বিবাহিত প্রত্যেক দম্পতির জীবনে এটা একবার আসে। তবে এক সময় এই প্রথা অনুযায়ী পুরো ভাদ্রমাস নববিবাহিত দম্পতিরা একে অপরের মুখ দর্শন নিষেধ থাকলেও এখন তিন দিন পালন করছেন।
তবে এই উৎসব মুসলমানদের চেয়ে সনাতন ধর্মালম্বীরা বেশি গুরুত্ব দিয়ে পালন করে বলে জানান তিনি।’ স্থানীয় লোকজনের তথ্য মতে, পিতার আদি পুরুষরা এ নিয়ম পালন করে আসছে। তারা এ রেওয়াজ বংশানুসারে পালন করছেন। এভাবে এক সময় এটা এ অঞ্চলের সংস্কৃতির অংশ হয়ে যায়। হিন্দু সংস্কৃতি ও আচার অনুষ্ঠান থেকে এ ভাদর কাটানির জন্ম হলেও বর্তমানে এটা এ অঞ্চলের সমাজ ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ঠাঁই করে নিয়েছে।
প্রতিবছর শ্রাবণ মাসে বিয়ের ধুম পড়ে যায়। যা অনেকটা প্রতিযোগীতার মতই। এরপর পুরো ভাদ্র মাসই বিয়ে বন্ধ থাকে। অনেকেই কুসংস্কার বলে এই নিয়ম থেকে বেড়িয়ে এসেছেন তবে এর সংখ্যা খুবই কম। কালের আবহে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে এ লোকাচার কমতে শুরু করেছে।
সনাতন ধর্মালম্বীরা আজও গুরুত্বের সাথে এ লোকাচার পালন করে আসছে। ভাদর কাটানি নিয়ে নানা মানুষের নানা মত থাকলে এটি ঠাকুরগাঁও জনপদের একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতির বার্তা বহন করে। বাংলার নারী হৃদয়ে পতিভক্তির এই সংস্কৃতি এ অঞ্চলের নারীদের যেমন উজ্জল করেছে তেমনি সমৃদ্ধ করেছে আবহমান কালের সংস্কৃতি। দাম্পত্য জীবনে শান্তি কামনায় ঐহিত্যবাহী এ উৎসবে জেলার জনপদের ঘরে ঘরে নববধূকে বাবার বাড়িতে বরণ করা হয়েছে।