রাঙামাটিঃ অবশেষে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চাকমা সম্প্রদায়ের নতুন চেয়ারম্যান মনোনীত হয়েছেন রাঙ্গমাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক সফল চেয়ারম্যান ও রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নিখিল কুমার চাকমা।
১৯৭৬ সালে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলাকে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড গঠিত হওয়ার পর নিখিল কুমার চাকমাকে প্রথম চাকমা সম্প্রদায়ের ব্যক্তি হিসেবে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা থেকে চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনীত করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানাগেছে, গত ১৩জুন রবিবার পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় থেকে নিখিল কুমার চাকমাকে নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিতে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সচিব মোসাম্মৎ হামিদা বেগম স্বাক্ষরিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন চেয়ে একটি সম্মতিপত্র পাঠানো হলে তাৎক্ষণিক সম্মতি জ্ঞাপন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আইন ২০১৪ এর ৬(২) ধারা অনুযায়ী এই সম্মতি অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোের্ডর নতুন চেয়ারম্যান মনোনীত বিষয়টি পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি দায়িত্বশীল সুত্র নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যানকে নিয়ে নানা রকম গুঞ্জন শোনা গেলেও অবশেষে এর অবসানের লক্ষ্যে রাঙ্গামাটি জেলার কোনো বাসিন্দা প্রথমবারের মতো উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যানের পদে বসবেন। প্রায় অর্ধ শতাব্দীর ইতিহাসে এই পদে আর কখনও রাঙ্গামাটির কোনো নেতা বা কর্মকর্তাকে এ পদে পদায়ন করা হয়নি। কিন্তু এই প্রথমবারের মতো এ জেলা হতে চেয়ারম্যান মনোনীত করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে রাঙ্গামাটি বাসীর পক্ষ থেকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন।
বিগত ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর দীপংকর তালুকদার মন্ত্রী পরিষদ থেকে বাদ পড়েন। এর পর থেকেই অনেকটা হতাশায় দিনাতিপাত করছিল রাঙ্গামাটিবাসী। কেননা, পার্বত্যমন্ত্রী বান্দরবানের এবং বোর্ডের চেয়ারম্যান খাগড়াছড়িতে। উন্নয়নের মূল প্রতিষ্ঠানে রাঙ্গামাটিতে কেউ না থাকার কারণে ছিল এই হতাশাগ্রস্থ। পরিসংখ্যান করে দেখা গেছে, বর্তমান সরকারের তিন মেয়াদে পাহাড়ে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। উন্নয়নের সেই স্রোত ও জোয়ার থেকে রাঙ্গামাটি জেলাও বাদ পড়েনি। তারপরও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার উন্নয়নের ছোঁয়া বেশী হওয়ায় রাঙ্গামাটিবাসীরা কিছুটা হতাশায় ছিলেন।
নিখিল কুমার চাকমা একজন সফল সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন ও তিনি শিক্ষায় দীক্ষায় সাদামনের মানুষও বটে এবং গণমানুষের নেতাও বলা যেতে পারে। সব সময় হাস্যোজ্জ্বল ও ঠান্ডা মাথায় কাজ করেন। সুতরাং এ ধরনের মানুষকে উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে আসীন করায় পাহাড়ের উন্নয়নের গতি ধারা আরো একধাপ এগিয়ে যাবে বলে অনেকের মুখে মুখেই খুশীর বার্তা বইছে।
কেননা, রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে যথেষ্ট এলাকার উন্নয়ন কাজ করেছেন বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান। এদিকে বিগত ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত তিনি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেন। তার দায়িত্ব থাকাকালীন সময়ে দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে যেমন কোনো অভিযোগ ছিল না। তেমনি জনগণের বড় অংশ সন্তুষ্ট ছিল।
উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড (সংশোধিত) আইন ২০১৪ এর ৬ (২) ধারা বলে উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান নিয়োগের ক্ষমতা সরকারের হাতে ন্যস্ত। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড পিছিয়ে পড়া তিন পার্বত্য জেলা নিয়ে উন্নয়নের জন্য বিশেষভাবে গঠিত হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডটি। এটি রাঙ্গামাটি শহরের হেড কোয়ার্টারটি অবস্থিত।
১৯৭৬ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান জিয়াউর রহমান এক অর্ডিন্যান্স বলে এই প্রতিষ্ঠান চালু করেন। এর দু’বছর আগে বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় রাঙ্গামাটি সফরে এলে পাহাড়ের মানুষের জন্য এই ধরণের একটি বিশেষ উন্নয়ন সংস্থা গঠনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং এটি স্থাপন করে পার্বত্য পশ্চাৎপদ এলাকায় উন্নয়নের কাজ আরম্ভ করেন।
অন্যদিকে এ সংস্থাটি সামরিক সরকারের অর্ডিন্যান্স বলে বোর্ড গঠিত হলেও চেয়ারম্যান করা হয় চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারকে। এরপরে নির্বাচিত সরকারের সময়েও বিভাগীয় কমিশনারই এ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সালে পুণরায় সামরিক সরকার ক্ষমতায় বসার পর ১৯৮৩ সাল থেকে চেয়ারম্যান এর দায়িত্ব চলে যায় সেনাবাহিনীর হাতে। ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত মোট ৮জন জেনারেল চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ২রা ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর চুক্তি মোতাবেক চেয়ারম্যান পদে বেসামরিক নেতার পদায়ন ঘটে।
চুক্তি স্বাক্ষরকারী তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বান্দরবান থেকে নির্বাচিত এমপি বীর বাহাদুরকে উপমন্ত্রীর মর্যদায় এই পদে নিয়োগ দেয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতার পদ পরিবর্তন হলে বিএনপি সরকারও একই ধারাবাহিকতায় খাগড়াছড়ি থেকে নির্বাচিত এমপি আব্দুল ওয়াদুদ ভুঁইয়াকে চেয়ারম্যান নিয়োগ করে। ২০০৮ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বীর বাহাদুর এমপিকে পুণরায় প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় চেয়ারম্যান হিসেবে পদায়ন করে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর তিনি পার্বত্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর সেই সময়ে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ে সচিবে দায়িত্বে থাকা নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরাকে এই পদের দায়িত্ব দেয়া হয়।
তবে ইতোমধ্যে ২০১৪ সালে ১৯৭৬ সালের অর্ডিন্যানন্সের আইনটি সংশোধন করে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার। ২০১৪ সালের ৮ জুলাই নতুন আইনের প্রজ্ঞাপন জারি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকার। এ আইনটি সংশোধনের আলোকে সরকারের উপর ন্যাস্ত করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নযন বোর্ড চেয়ারম্যানের পদটি। তখন থেকেই দলীয় বা বেসামরিকভাবে চেয়ারম্যানের পদটি মনোনীত করে নিয়োগ করছেন।
নিখিল কুমার চাকমা নির্বাচিত কোনো প্রতিনিধি নন তবে সরকার কর্তৃক নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে এর আগেও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া চেয়ারম্যান হিসেবে যে কাউকে নিয়োগ প্রদানের এখতিয়ার আছে সরকারের। শুধু এ ক্ষেত্রে একজন উপজাতীয়কে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা আছে আইনে এবং পার্বত্য চুক্তিতে। আইন অনুযায়ী একজন চেয়ারম্যান একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও চারজন সদস্য নিয়ে উন্নয়ন বোর্ড গঠন করা হয়ে থাকে। ছয় জনকেই সরকার নিয়োগ প্রদানের ক্ষমতা আছে।
রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগে দীঘদিন সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে থাকা নিখিল কুমার চাকমা দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝেও বেশ জনপ্রিয়। তিনি সবার সাথে হাস্যেজ্জল ও আত্নবিশ্বাসী এবং বিনয়ের সহিত কতোপকথন করেন। তিনি আগামী দিনে গণমুখি প্রতিষ্ঠান হিসেবে উন্নয়ন বোর্ডকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে কতটা বজায় রাখতে সক্ষম হয় তা হয়তো পনিস্থিতি ও সময়ই বলে দিবে। তবে তিনি খুবই উন্নয়ের জোয়ারের স্রোত ধরে রাখতে খুবই আশাবাদী ব্যক্ত করেছেন।