সিরাজগঞ্জে ভাঙনে নিঃস্ব হচ্ছে অসহায় মানুষ
আগামী নিউজ | রানা আহমেদ, সিরাজগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি প্রকাশিত: জুন ৩, ২০২১, ০৭:০২ পিএম
ছবিঃ আগামী নিউজ
সিরাজগঞ্জঃ যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি শুরু হওয়াতে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, চৌহালী ও এনায়েতপুরে শুরু হয়েছে তীব্র নদী ভাঙন। গত এক সপ্তাহের ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে তিন শতাধিক বসতভিটা, একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিস্তীর্ণ ফসলিজমি। ভাঙন আতংকে নদী তীরবর্তী মানুষেরা তাদের বাড়ি-ঘর অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন।
ভাঙন কবলিতদের অভিযোগ বছরের পর বছর প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও নদী ভাঙনরোধে কোন কাজ শুরুই হয়নি আজও। তবে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে ভাঙন রোধে সাড়ে ছয়শ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে যা একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
সরেজমিন ভাঙন এলাকা ঘুরে, স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই রুদ্ররূপ ধারন করেছে সিরাজগঞ্জের যমুনা নদী। পানি বৃদ্ধি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জেলার এনায়েতপুর খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ থেকে শাহজাদপুরের কৈজুরি পর্যন্ত সাড়ে ছয় কিলোমিটার নদীতীরবর্তী এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে শুরু হয়েছে তীব্র ভাঙন। গত এক সপ্তাহে শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরি ইউনিয়নের পাচিল ও হাট পাচিল, একই উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের পাকরতোলা ও এনায়েতপুরের ব্রাক্ষনগ্রামে তিন শতাধিক বসতভিটা ও বিস্তীর্ণ ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ সকল এলাকার ভাঙন কবলিতরা সহায়-সম্বল হাড়িয়ে বাড়ি-ঘর ভেঙে রাস্তার পাশে বা অন্যের জমিতে আশ্রয় গ্রহণ করছে। পরিবারের নারী-শিশুসহ গবাদি পশু নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন ভাঙনে নিঃস্ব হওয়া মানুষেরা।
এদিকে যমুনা নদীর পানির তীব্র ঘূর্ণাবর্তের কারণে চৌহালী উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নের হাটাইল, ঘুশুরিয়া, হিজুলিয়া, কাঠালিয়া ও উমারপুর ইউনিয়নের পয়লার প্রায় তিন কিলোমিটার নদীতীরবর্তী এলাকায়ও ভাঙন শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যেই এই এলাকাগুলোর বিস্তীর্ণ ফসলি জমিসহ হাটাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পশ্চিম হাটাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে এই এলাকাগুলোর নদীতীরবর্তী হিজুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিম সম্ভুদিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, খাস মধ্য শিশুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মধ্য শিমুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মিশ্রিগাতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বারবয়রা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইউসুফ শাহি সলঙ্গী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বিলজলহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাউশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শৈলজানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হাটাইল নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
ভাঙনকবলিত স্থানীয়দের অভিযোগ, এনায়েতপুর খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ থেকে শাহজাদপুরের কৈজুরি পর্যন্ত সাড়ে ছয় কিলোমিটার নদীতীরবর্তী এলাকা বরাবরই অরক্ষিত। প্রতিবছরেই এই এলাকাগুলোতে দেখা দেয় নদীভাঙন, নিঃস্ব হয় মানুষ। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যথারীতি ভাঙন এলাকা পরিদর্শনে এসে বারবার নদী ভাঙ্গন বন্ধে দ্রুত কাজ শুরু হবার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি আজও। ফলে বছরের পর বছর নদী ভাঙনের শিকার হয়ে ফসলী জমি, বসতভিটা হারিয়ে পথে বসেছেন অনেক ধনাঢ্য কৃষকেরাও।
নদী ভাঙন কবলিত কৈজুরি ইউনিয়নের পাচিল গ্রামের কালাম ফকির বলেন, পৈত্রিক সূত্রে ১১ বিঘা ফসলি জমি ও তিন বিঘার একটি বসতবাড়ি পেয়েছিলাম। বাড়িতে অন্তত ১৫টি দুধেল গাভী ছিল। গত কয়েকবছর যাবত ভাঙনে সবই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। শনিবার (২৯ মে) আমার শেষ সম্বল ৪০ কাঠার ফসলি জমি আর বসতভিটা একসাথে ভাঙতে আরম্ভ করেছে। ঘড়-বাড়ি ভেঙে সরিয়ে রাস্তার ঠালে রেখেছি, নিঃস্ব হয়ে পথে নেমে গেলাম। তিনি আরও বলেন, তিন বছর আগে আমার জমি যখন ভাঙা শুরু হয় তখন থেকেই শুনছি নদীতে বাধ দেয়া হবে, কিন্তু আজও কোন কাজ শুরু হলো না অথচ আমার সব শেষ হয়ে গেল।
এনায়েতপুরের ব্রাক্ষনগ্রামের ষাটোর্ধ বৃদ্ধ আবুল সরকার বলেন, কিছুদিন আগে স্থানীয় সাংসদ ও মন্ত্রী এসে বলে গেল এই এলাকার আর এক চাপ জমিও নদীতে যেতে দেওয়া হবে না। অতিদ্রুত বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হবে। অথচ গত এক সপ্তাহে তিন শতাধিক বসতভিটা ও কয়েকশত বিঘা ফসলী জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেল। ভাঙন বন্ধ করতে কোনও কাজ শুরুতো দূরের কথা কেউ খোঁজ খবর নিতেও আসেনি।
জালালপুরের পাকরতোলা গ্রামের চায়না বেগম বলেন, আমাদের বাড়ি ছিল কৈজুরির পাচিলে। সেখানে ভাঙনে আমাদের বসতভিটা নদীতে চলে যাওয়ায় পাকরতোল এসে এক আত্মীয়ের জমিতে ঘড় তুলেছি। এখন এই বাড়িও নদীতে বিলীন হওয়ার পথে। দুবছর আগেও গোয়ালভড়া গরু, গোলাভরা ধান ছিল, এখন আমরা নিঃস্ব। সরকার কোনও সহযোগিতা না করলে আমাদের আর কোন উপায় নেই।
স্থানীয় কবির হোসেন, হাসানুজ্জামান জানান, পাচিল, হাট-পাচিলে যেভাবে নদী ভাঙন শুরু হয়েছে, গত এক সপ্তাহে তিনশতাধিক বসত ভিটা ও প্রচুর পরিমাণ ফসলি জমি নদীগর্ভে চলে গেছে। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনও তৎপরতা নেই। দ্রুত এই ভাঙন থামাতে কাজ শুরু করা না হলে অল্প সময়েই হয়ত এই দুটি গ্রামই নদীতে বিলীন হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড-সিরাজগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানান, এনায়েতপুর থেকে কৈজুরি পর্যন্ত সাড়ে ছয় কিলোমিটার অরক্ষিত নদীতীর রক্ষায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য সাড়ে ছয়শ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রকল্পটি দ্রুতই অনুমোদন হবে। অনুমোদনের পর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা গেলে এই এলাকায় আর ভাঙন থাকবে না।
এই নির্বাহী প্রকৌশলী আরও বলেন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার মহোদয়ের পরামর্শক্রমে ভাঙন রোধে জরুরি ভিত্তিতে চর কেটে নদীর স্রোত পরিবর্তনের জন্য ২৬ ইঞ্চি একটি ড্রেজার আনা হচ্ছে। ড্রেজারটি পৌঁছলে দ্রুত চর কেটে দেয়া হবে। এতে ভাঙন থেমে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।