কুড়িগ্রাম: রাজীবপুর উপজেলা শহর থেকে নদী বিচ্ছিন্ন ইউনিয়ন কোদালকাটি। প্রাকৃতিক দূর্যোগ বন্যা,খরা,নদী ভাঙ্গন এই ইউনিয়নের চর এলাকার মানুষের নিত্যসঙ্গী। উপজেলা শহর থেকে সড়ক যোগাযোগ বিছিন্ন একটি দ্বীপ মত এলাকা। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় সবসময় নাগরিক সেবা থেকে উপেক্ষিত থাকত এই এলাকার মানুষ।
বিষয় গুলো নিয়ে মনে মনে ভাবতে থাকেন স্থানীয় আমিনুর রহমান নামের এক মাদ্রাসা শিক্ষক। ভাবনায় সবসময় বিরাজ করে কি ভাবে এই এলাকার মানুষদের সচেতন করা যায় নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা যায়।যাতে কিছুটা পরিবর্তন ঘটে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের। এমন ভাবনা থেকে মনে মনে পণ করেন 'প্রতিদিন কমপক্ষে একটি ভাল কাজ করব, এলাকার মানুষের জন্য।
হঠাৎ মনে হলো তার এই ভাল কাজ করার স্বপ্ন পূরণে সহায়ক হতে পারে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করা। এতে প্রতিদিন ছোট পরিসরে ভালো কাজ করা যেতে পারে। নিজের সাধ্য মত এলাকার নানা সমস্যা সমাধান করার ব্রত নিয়ে নেমে পড়লেন তিনি। প্রথম দিকে কাজটি কঠিন মনে হলেও আস্তে আস্তে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন আমিনুর রহমান। গত প্রায় চার বছর হলো কোদালকাটি ইউনিয়নের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নানা কাজ করে যাচ্ছেন। তাকে সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন স্থানীয় তরুণেরা।
শুষ্ক মৌসুমে কোদালকাটি ইউনিয়ন থেকে উপজেলা শহরে আসতে বিশাল তপ্ত বালুচর ও নৌ-পথ পারি দিতে হয়। পায়ে হাঁটা, বাইসাইকেল বা মোটরসাইকেল চালানোও কষ্ট কর হয়ে পরে এই পথে। আমিনুর রহমান সিন্ধান্ত নেন বালুর উপর যদি কাঁশপাতা (কাশিয়া) বিছিয়ে দেওয়া যায় তাহলে চলাচল সুবিধা হবে। সেই ভাবনা থেকে কয়েকজন শ্রমিক নিয়ে চর থেকে কাশিয়া সংগ্রহ করে বালুতে বিছিয়ে দিলেন কয়েক কিলোমিটার।এতে চলাচলে অভাবনীয় সুবিধা হলো শিক্ষার্থী সহ সাধারণ মানুষের। এভাবেই শুরু পরোপকারী আমিনুর রহমানের স্বেচ্ছাসেবী হওয়া।
পরের বছর বালুতে কাশিয়া বিছানোর পাশাপাশি ছোট ছোট খাল গুলোতে বাঁশের সেঁতু বানিয়ে দেন এতে করে চলাচলে পথচারীদের আর পানিতে ভিজতে হতো না। ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ সড়ক গুলো কাঁচা হওয়ায় প্রায় সময় ধূলা উড়ে। এতে শ্বাসকষ্ট সহ চলাচলে বিঘ্ন হয় পথচারীদের। সেই সড়কে স্থানীয় তরুনদের সাথে নিয়ে পানি সেচ দিয়ে ধূলো প্রতিরোধ করেন তিনি এতে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করে পথচারীরা। কোন সড়ক ভাঙ্গা থাকলে সেগুলো মেরামতও করেন তিনি।
গ্রামের অসহায় কেউ অসুস্থ হলে ডাক্তারের খোঁজ করে দেওয়া।জেলা শহরের নামকরা ডাক্তারদের খোঁজ খবর পাওয়া যায়,তার কাছে। বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা গুলোর সাথেও নানা সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করেন তিনি।সুযোগ পেলে গ্রামের মানুষের মাঝে নানা স্বাস্থ্য সচেতনতা ও কৃষি বিষয়ক আধুনিক তথ্য জানান তিনি।করোনা মোকাবেলা ও সচেতনতায় নিজের অর্থে বিভিন্ন মসজিদে জীবাণু নাশক স্প্রে, সাবান ও লিফলেট বিতরণ করেছেন। হাটবাজার সচেতনতামূলক প্রচারণা চালিয়েছেন। ঢাকা থেকে আসা মানুষের হোম কোয়ারেন্টাইন ও নিশ্চিত করেছেন আমিনুর রহমান।
স্থানীয় তরুন রাশেদুল ইসলাম রাশেদ বলেন, আমিনুর স্যার তার কর্মে ফাঁকি দেয় না। স্কুল শেষ করে অথবা বন্ধের দিন তিনি এলাকাবাসীর জন্য সচেতনতা ও উন্নয়ন মূলক কাজ করেন।
চর সাজাই গ্রামের হানিফ উদ্দিন বলেন, মাষ্টার গ্রাম থিকা বাঁশ কালেকশন কইরা নদীতে বাঁধ (বান্ডাল) দিছে এহন আর নদীতে ভাঙ্গে না আমার গ্রামে। এমন মানুষ খুব কমে আছে বর্তমান সমাজে।
কোদালকাটি ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির ছক্কু বলেন,আমিনুর রহমান একজন কাজ পাগল মানুষ। যে কোন সামাজিক বা ভাল কাজে তাকে না ডাকলেও পাওয়া যায়। নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধ সহ নানান সামাজিক কাজ করে ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে।
কর্ম জীবনে আমিনুর রহমান চর সাজাই দাখিল মাদ্রাসার শরীরচর্চা বিষয়ে শিক্ষক। বয়স পঞ্চাশের ঘরে। স্বামী স্ত্রী এবং এক ছেলে এক মেয়েকে নিয়ে ছোট সুখের সংসার।
শিক্ষক আমিনুর রহমান আগামীনিউজকে বলেন, আমার আর্থিক সামর্থ্য খুব বেশি না। তবে চেষ্টা করি বিপদে আপদে মানুষের পাশে দাড়াতে। প্রথম দিকে পরিবার থেকে এসব সামাজিক কাজে কর্ম নিয়ে কিছুটা বাঁধা দেওয়া হত শুনতে হতো কটু কথাও। তবে এখন আর নিষেধ করে না বরং উৎসাহ দেওয়া হয় বলেও জানান তিনি।
স্বপ্ন দেখেন সমাজ থেকে সব হিংসা বিভেদ দূর হবে। বিপদে সুখ দুঃখে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে। নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মান হবে তার ইউনিয়নে রক্ষা পাবে বসতবাড়ি আবাদি জমি নিশ্চিত হবে মানুষের সকল মৌলিক অধিকার।
রাজীবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নবীরুল ইসলাম আগামীনিউজকে বলেন, আমিনুর রহমান মাষ্টারের গুনের কথা শুনেছি। ছোট্ট পরিসরে নিজের এলাকার উনি অনেক কাজ করেন। একজন আন্তরিক ও দায়িত্বশীল মানুষ। প্রতিটি গ্রামে এমন পরোপকারী মানুষ থাকলে সমাজ থেকে সব হিংসা বিভেদ এবং অসংগতি দূর করা সহজ হবে।
আগামীনিউজ/মালেক