পাবনা: জেলার প্রথম শ্রেণী পৌরসভা সাঁথিয়া। যেখানে কর্মচারিদের বেতন নেই, সড়কে বাতি নেই। ফিক্সড ডিপোজিটের টাকাও গায়েব! যানবাহন আছে ভাড়া খাটে অথচ তহবিলে টাকা জমা নেই। রাস্তাঘাটের অবস্থাও বেহাল।
প্রায় ৫৩ হাজার ৮’শ ৮৫ জন মানুষের বসবাস সাঁথিয়া পৌরসভায়। যার মধ্যে গ্রামের সংখ্যা ২৭টি ও মৌজা ১৯টি। বিস্তীর্ণ ২৫ দশমিক ২৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই পৌরসভাকে শহর বলা যায় না। গ্রামীণ পরিবেশ এই প্রথম শ্রেণীর পৌরসভায় রাতে সড়কে বাতি জ্বলে না। কারণ বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকার কারণে বিদ্যুৎ সরবারাহ বন্ধ করে দিয়েছে পাবনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২। গত দুই বছর ধরে বাতিহীন পৌর এলাকার গুরুত্বপূর্ণ সকল সড়ক। বিদ্যুৎ বিল বকেয়ার পরিমাণ ১৪ লাখ ৯৮ হাজার ৪’শ ৯৩ টাকা। যদিও খাতাপত্রে (নথিপত্রে) দেখানো হয়েছে পৌরসভা এলাকার ১০ কিলোমিটার সড়কে বাতি আছে!
গত ৪১ মাস ধরে পৌরসভার ৩৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারির মধ্যে কেউই বেতন পান না। মাস্টার রোলে কর্মরত ১০ জন কর্মচারিরও একই হাল। নিয়মিত অফিস করেন না নির্বাহী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর হোসেনও, থাকেন না সাঁথিয়ায়। প্রায় দুই বছর যাবত সচিবের পদ শূন্য।
২০০৬ সালে জনতা ব্যাংক বেড়া শাখায় ফিক্সড ডিপোজিট ছিল ৫৫ লাখ টাকা। এই টাকা ট্রান্সফার করে নিয়ে আসা হয় সাঁথিয়া সোনালী ব্যাংকে। সেই টাকা গায়েব হয়ে গেছে বা খরচ হয়ে গেছে! কেন কি কারণে এই ফিক্সড ডিপোজিটের অর্থ খরচ করা হলো? এ ব্যাপারে দুদকের তদন্ত এখন শেষ পর্যায়ে।
এ ব্যাপারে পৌর মেয়র মিরাজুল ইসলাম বলেন ‘হ্যাঁ কর্মচারিদের বেতন বকেয়া আছে। বিদ্যুৎ বিল ক্রমান্বয়ে পরিশোধ করা হচ্ছে। তবে সড়কের বাতিগুলো বন্ধ আছে।’ তবে, ৫৫ লাখ টাকা ফিক্সড ডিপোজিটের টাকার বিষয়ে তিনি কোন সদুত্তোর দিতে পারেননি।
বছরে প্রায় আড়াই কোটি টাকা আয় হয় পৌরসভায় রাজস্ব খাতে। কিন্তু, এই রাজস্বের আয়কৃত টাকা যথাযথভাবে জমা এবং খরচ হয় না এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। আছে ৪টি ট্রাক, ২টি রোলার মেশিন, একটি সার্ভিস ট্রাক এবং একটি অ্যাম্বুলেন্স। এসব যানবাহন ভাড়া বাবদ যে আয় হয় নেই তার কোন হদিস বা তহবিলে জমা নেই কোন অর্থও। ট্রাকগুলো ভাড়া খাটে বালু-ইট পরিবহনে। অথচ যানবাহনের ভাড়ার টাকা পৌরসভার তহবিলে জমা হয় না। প্রতিটি ট্রাক ভাড়া দেয়া হয় মাসে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকায়। এই হিসাবে ৪টি ট্রাকের ভাড়া বাবদ আয় হওয়ার কথা বছরে ৩০ লাখ টাকা। জমা হয় না রোলার এবং অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার টাকাও। জন্ম নিবন্ধন ফি আদায় হলেও তা পৌরসভার তহবিলে জমা হয় না। অটো রিক্সা ও ভ্যানের লাইসেন্স পৌরসভা থেকে প্রদান করা হয় না। যদিও পৌরসভা এলাকায় প্রতিদিন এসব যানবাহন থেকে চাঁদা আদায় করা হয়। এই আদায়কৃত টাকা কার পকেটে যায় এ প্রশ্ন জনমনে।
বোয়াইলমারী বাজারে খাস জমিতে নির্মান করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু মার্কেট’। মার্কেটের প্রতিটি দোকান বরাদ্দ দেয়া হয়েছে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকায়। এই টাকা কোন খাতে জমা হয়েছে তারও কোন হদিস নেই। একই অবস্থা বালিকা বিদ্যালয়ের দক্ষিণের তাঁতী বাজারের। পৌরসভার সামনের তিনটি দোকান ভাড়া বা লীজ গ্রদান করা হয়েছে কিভাবে কত টাকায় তারও কোন স্বচ্ছতা নেই।
চলাচলের অনুপোযোগী পৌরসভার সড়কগুলো। পাকা সড়কের চেয়ে সাঁথিয়া পৌরসভায় কাঁচা সড়কের পরিমাণ বেশি। পাকা সড়ক ৩৮ দশমিক শূন্য ২ কিলোমিটার। হেরিন বন বন্ড সড়ক ১২ কিলোমিটার। কাঁচা সড়ক ৪৯ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার। একই সড়ক বারংবার মেরামত দেখিয়ে টাকা খরচ দেখানোর অভিযোগও আছে। পৌর এলাকায় সম্প্রতি ৪০ টি তারা নলকূপ স্থাপন করার প্রকল্পেও নয়-ছয় করার অভিযোগ উঠেছে। পানিতে প্রচুর আয়রন হেতু বিশুদ্ধ পানীয় জলের সঙ্কট বিদ্যমান।
বার্ষিক উন্নয়ন খাতে (এডিপি) সরকার ২০১৯-’২০ অর্থবছরে প্রদান করেছে ৮৫ লাখ টাকা। ১০টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তার ৯টির টেন্ডার হয়েছে। এইসব কাজের খতিয়ান পাওয়া যায়নি। পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর হোসেন অকপটে স্বীকার করলেন “কর্মচারিরা বেতন পান না। সবকিছুতে অনিয়ম। এভাবে একটি পৌরসভা চলতে পারে না। এ বিষয়ে পৌরসভার কয়েকজন কর্মচারির সঙ্গে কথা বলে তাদের বেতন না পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। এছাড়াও গতমাসে (আগস্ট) সরকার মন্ত্রণালয়ের উপ-পরিচালক কর্তৃক অডিট রিপোর্টে এর সত্যতা মিলেছে।
১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী (সাবেক রাষ্ট্রপতি) মো. জিল্লুর রহমান সাঁথিয়া পৌরসভার উদ্বোধন করেন। প্রায় ২৩ বছর আগে স্থাপিত পৌরসভার ভবন নেই, কাজ চলছে পুরাতন ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে।
আগামীনিউজ/মিথুন