প্রধান শিক্ষকসহ পাঁচ শিক্ষককে মারধর করে ঘটনা ধামাচাপা দিতে প্রথমে সংবাদ সম্মেলন করে পরবর্তীতে এতিম খানার শিক্ষার্থীদের দিয়ে মানববন্ধন করেছেন বরগুনার সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের লেমুয়া খাজুরা পি কে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ইমতিয়াজ হোসেন সোহেল। এর আগে গত রবিবার (২১ জানুয়ারী) সকালে খাজুরা পি কে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলি চলাকালে সভাপতি তার কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে অতর্কিত হামলা চালান এই পাঁচ শিক্ষকের উপর। হামলায় প্রধান শিক্ষক ও চার সহকারী শিক্ষক আহত হন। মারধরের সময় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী ও বিদ্যালয়টির শিক্ষকদের উপস্থিতিতেই এই হামলা হয়। যার প্রত্যক্ষদর্শী স্বাক্ষী উপস্থিত সকল শিক্ষার্থী।
সোমবার বিদ্যালয়ের সামনে সভাপতির নিজের বাড়িতে পরিচালিত পঞ্চায়েত বাড়ি এতিমখানা ও হাফিজিয়া মাদ্রাসার শতাধিক শিক্ষার্থীকে বাধ্য করে মাদ্রাসাটি থেকে দের কিলোমিটার দূরুত্বে অবস্থিত লেমুয়া খাজুরা পি. কে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে এই মানবন্ধন করান। মানবন্ধনে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছাড়াও সভাপতির নিজের গ্রামের একাধিক ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। তবে বিদ্যালয়টির আশেপাশের কোন অভিভাবক বা ব্যক্তি এই মানবন্ধনে দেখা যায়নি।
এর আগে রবিবার (২৮ জানুয়ারি) বরগুনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে মারধরের ঘটনাকে সাজানো দাবি করে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তোলেন সভাপতি।
জানা গেছে, পূর্বঘোষিত সূচী অনুযায়ী সোমবার বিদ্যালয়টিতে সরেজমিন তদন্ত করার কথা ছিল জেলা প্রশাসনের তদন্ত টিমের। মারধরের ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রভাহিত করতেই তিনি এই মানবন্ধন করান। তবে সোমবার তদন্ত আসেননি তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্কুলটির সভাপতি বিভিন্ন ভাবে স্কুল ফান্ডের লক্ষাধিক টাকা জোরপূর্বক আত্মসাৎ করেন। বিনা টেন্ডারে এবং বন অধিদপ্তরের অনুমতি না নিয়ে কোন রেজুলেশন ছাড়া গাছ বিক্রি করে সেই টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এই নিয়ে একজন অভিভাবক মামলা দায়ের করেছেন যা চলমান। এছাড়াও শিক্ষকদের এক মাসের বেতনের টাকা না দিলে বেতন বিলে প্রতিস্বাক্ষর করবেন না বলে জানান। শিক্ষকরা ইউএনও'র নিকট সরনাপন্ন হলে পরবর্তীতে তিনি স্বাক্ষর করেন। ২০২৩ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা করে উত্তোলন করে আতসাৎ করেন সভাপতি। ছয় জন শিক্ষকের টাইম স্কেলের জন্য অর্থ দাবি করাসহ নানা সময়ের এই সভাপতির অনৈতিক অর্থনৈতিক আবদার ও অব্যাহত হুমকি ধামকির ফলে গত ৯ অক্টোবর ২০২৩ ইং তারিখে প্রধান শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটির তিন জন শিক্ষক প্রতিনিধি ও একজন অভিভাবক প্রতিনিধি এবং পাঁচ জন শিক্ষক সহ মোট ১২ জন স্বাক্ষরিত একটি অভিযোগ পত্র বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের নিকট জমা দেন। সভাপতির বিভিন্ন অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার ফলে তার অব্যাহতি চেয়ে এই অভিযোগ দেওয়া হয়। তবে তার কোন তদন্ত করেনি শিক্ষা বোর্ডটি।
একাধিক অভিভাবক জানান, সভাপতি শিক্ষকদের মারধর করার পর আবার মানবন্ধন করে ঘটনাকে ভিন্নখাতে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। বিদ্যালয়ের দুই শতাধিক শিক্ষার্থী স্বাক্ষী যে শিক্ষকদের তিনি মারধর করেছেন। আজ তদন্তে আসার কথা শুনেই তিনি লোক ভাড়া করে এনে এবং নিজের বাড়িতে পরিচালিত মাদ্রাসার এতিম শিশুদের নিয়ে এই মানবন্ধন করালেন।
মানবন্ধনে উপস্থিত বেশ কয়েকজন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী জানান, মাদ্রাসার হুজুর তাদের এখানে আসতে বলেছেন তাই তারা এসেছেন। হুজুরের কথা না শুনলে আমাদেরকে মারতে পারেন সেই ভয়েই আমরা এসেছি।
জানা গেছে, যে সব শিক্ষার্থী মারধরের ঘটনায় গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তদন্তের দিন স্কুলে উপস্থিত না হতে নিষেধ করেছেন সভাপতি। আজ সোমবার তদন্তে আসার কথা থাকায় বিদ্যালয়ের উপস্থিতি অর্ধেকে নেমে এসেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে লেমুয়া খাজুরা পি. কে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইমতিয়াজ হোসেন সোহেলের মুঠোফোনে কল করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে মানববন্ধন থেকে তিনি মারধরের ঘটনাকে সাজানো দাবি করে উল্টো প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তোলেন।
বিদ্যালয়টির একাধিক শিক্ষক বলেন, একটি স্কুলের কমিটি থাকে স্কুলের উন্নয়নের স্বার্থে অথচ সভাপতির কর্তৃক মারধরের ঘটনার পর শিক্ষার্থীরা আছেন আতঙ্কে। স্কুলে উপস্থিতি কমে গেছে। শিক্ষকদের মারধর করে ঘটনাকে সাজানো ও বানোয়াট বলে অর্থের জোড়ে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রোপ্যাগান্ডা চালাচ্ছেন তিনি।
জানতে চাইলে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক ইউসুফ আলী বলেন, সভাপতি আমি এবং আমার চার শিক্ষককে শারীরিকভাবে নির্যাতন করল অথচ তিনিই আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিথ্যা বানোয়াট তথ্য দিয়ে পত্রপত্রিকায় সংবাদ করাচ্ছেন, লোক ভাড়া করে এনে মানবন্ধন করাচ্ছেন। আমার তো আলাদা কোন স্বাক্ষীর দরকার নেই। আমার দুই শতাধিক শিক্ষার্থীর সামনে মারধরের ঘটনা ঘটেছে তারাই স্বাক্ষী। আমার এই কমলমতি শিক্ষার্থীদের বাড়িতে গিয়েও স্বাক্ষী না দিতে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আমরা এই ঘটনা সুষ্ঠ বিচার চাই।
গত রবিবার (২১ জানুয়ারী) মারধরের ঘটনার পর ২৫ জানুয়ারি বরগুনা জেলা প্রশাসক বরগুনা সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার(ভূমি)কে প্রধান করে তদন্তের দায়িত্ব দেন। মঙ্গলবার এই সরেজমিন তদন্তে আসার কথা রয়েছে।