গাইবান্ধাঃ জেলার সুন্দরগঞ্জে চন্ডিপুর ইউনিয়নের উজান বোচাগাড়ী গ্রামে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে তা বিভিন্ন ঠিকাদারের কাছে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। আর নদীর পাড় ঘেষে ড্রেজার দিয়ে বালু তোলায় নদীর গতিপথ দ্রুতই পরিবর্তন হয়ে তীব্র স্রােতের সৃষ্টি হয়েছে। এতে নদী পাড়ের বসত বাড়ি এবং শতশত হেক্টর ফসলি জমি নিমিষেই নদীগর্ভে বিলিন হচ্ছে। মারাত্নক ঝুঁকিতে রয়েছে আরও ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বিদ্যুৎ এর খুটি, গ্রামীণ সড়ক ও পার্শ্ববর্তী নদী রক্ষা বাঁধ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় এক মাস ধরে দিন-রাত ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করেন স্থানীয় মো. সাজু মিয়া, মো. শাহজাহান মিয়া ও মাসুদ মোল্লার নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। প্রতিদিন হাজার হাজার ঘন ফুট বালু উত্তোলন করে বিভিন্ন ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করেন তাঁরা। এতে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি। ফলে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে সরকার যেমন বঞ্জিত হচ্ছে, তেমনি পরিবর্তন হচ্ছে নদীর গতিপথ। সে কারণে বসতভিটা ও ফসলি জমি নদী গর্ভে বিলীন হচ্ছে। হুমকির মুখে পরেছে শতশত হেক্টর ফসলি জমি ও ঘরবাড়ি। আর ভাঙ্গন আতংকে রাত কাটছে নদীপাড়ে বসবাসকারী অসংখ্য পরিবারের। গৃহহারা হয়ে ভীষণ বিপদে এসএসসি পরীক্ষার্থী থেকে শুরু করে শিশু, বৃদ্ধ ও গবাদিপশু।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বালু উত্তোলনের শুরুতেই ইউএনওকে মোবাইল ফোনে জানানো হয়েছিল। তিনি তখন ব্যবস্থা নেননি। সংবাদ পাওয়া মাত্র ব্যবস্থা নিলে হয়তো আজ আমাদের এ অবস্থায় পড়তে হতো না। প্রায় ১ মাস মেশিন চলার পরে গত রোববার ১৪ নভেম্বর অভিযান চালিয়ে ড্রেজার ধ্বংস করে দেন উপজেলা প্রশাসন। মেশিন ধ্বংশ করে দেয়ার পর থেকেই জীবনের হুমকিসহ নানান খরগ নেমে আসে তাঁদের উপর বলেও জানান ভুক্তভোগীরা। তাঁরা বলছেন, ভরা বন্যা মৌসুমে এই চক্রটি ট্রলার দিয়ে নদী থেকে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করে। ফলে নদী ভাঙন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বহু লোকজন ঘর-বাড়ি, ফসলি জমি হারিয়ে আত্মীয় স্বজনের বাড়ি ও বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। সামনে সন্তানদের পরীক্ষা। তাদের লেখাপড়াও বিঘিœত হচ্ছে। এভাবে বালু উত্তোলন করলে গোটা এলাকা নদী গর্ভে বিলিন হবার সম্ভাবনা রয়েছে। ভিটে-মাটি, বসবাড়ি, ফসলি জমি ও বিভিন্ন স্থাপনা নদীতে চলে গেছে। সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় ত্রিশ পরিবার হারিয়েছেন তাদেও সহায় সম্বল।
বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আমাদের এখানে যে দিন প্রথম ড্রেজার মেশিন বসানো হয় সেদিনই ইউএনও স্যারকে মোবাইল ফোনে জানাই। আজ আসি, কাল আসি করে প্রায় মাস পার করেন তিনি। পরে লিখিত অভিযোগ দেয়ার পরে গত ১৪ নভেম্বর তিনি লোক পাঠিয়ে মেশিন ধ্বংশ করে দেন। যে দিন মোবাইলে জানিয়েছিলাম ওইদিন আসলে বালূ খোরদের ড্রেজার মেশিনে আমাদের ঘর বাড়ি নদীগর্ভে যেত না।’
তিনি আরও বলেন, ‘শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট কতিপয় প্রভাবশালীর মদদে দীর্ঘদিন যাবৎ এই বালু ব্যবসা পরিচালনা করে আরছেন। জীবনের ভয়ে কেউ কোনো প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না তাদের বিরুদ্ধে। সিন্ডিকেটের এই সদস্যরা হরিপুরে তিস্তা ব্রীজের কাজে চায়না কোম্পানির নিযুক্ত ঠিকাদারের কাছে বালু বিক্রি করছেন।’
নদী ভাঙ্গনের শিকার অপর এক পরিবার প্রধান ছকিনা (৫৪) বলেন, ‘হামরা নদীর পাড়ের মানুষ। নদী আগে অনেক দূর আছিল। নদীতে বড়বড় মেশিন বসেয়া বালা তোলে। সেই জন্যে নদী হামার বাড়ি ঘর ভাঙ্গি নিয়ে গেল। মেশিনগুলা না বসাইলে নদী এতো পাগলা হইলো না হয়।’
৭০ বছর বয়সী বিধবা জরিনা বেওয়া বলেন, ‘তিস্তা নদীত অনেক আগেই মোর স্বামীর জমি ভাঙ্গি গেইছে। সেই থাকি মুই নদীর পাড়ে মানুষের জমিত থাকোম। মোর থাকার শেষ জায়গাটাও দুইদিন আগে নদীত গেইছে। এখন মুই কই থাকিম, কি খাইম রে বাবা।’
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ-আল-মারুফ বলেন, ‘১৫/১৬ দিন আগে তারা আমাকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে যেতে পারিনি। তবে লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পরপরই সেখানে আমি লোক পাঠিয়ে সেখানে অভিযান চালিয়ে ড্রেজার মেশিন ধ্বংশ করা হয়েছে। এর আগেও ওই এলাকায় বালু উত্তোলনকারীদের একাধিকবার জরিমানা ও ড্রেজার ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। আর এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।’
আগামীনিউজ/নাসির