গাজীপুরঃ জেলার শ্রীপুরে গত ২১ জুলাই থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত চারটি হত্যাকান্ড এবং হামলার ঘটনায় সাংবাদিক ও সাবেক জনপ্রতিনিধি আহত হয়েছেন। হত্যার শিকার হয়েছেন একজন কৃষক, একজন ছাত্রনেতা এবং দুইজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। এক সপ্তাহে শ্রীপুরে চারটি হত্যাকান্ড এবং হামলার ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মন্তব্য পোস্ট করছে শ্রীপুরের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। তারা এসব ঘটনায় উদ্বেগ ও বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন।
এসব ঘটনায় হত্যাকান্ডের শিকার ও হামলায় আহতরা হলেন উপজেলার গোসিংগা ইউনিয়নের গাজিয়ারন গ্রামের কৃষক অব্দুল আজিজ (৫৫), শ্রীপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সদস্য পৌরসভার বেড়াইদেরচালা গ্রামের সৈয়দ মাহবুব হোসেন মাসুম আহমেদ (২২), তেলিহাটী ইউনিয়নের উদয়খালী গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আরিফ হোসেন (২৪) ও ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার জামিরাপাড়া গ্রামের আফাজ উদ্দিনের ছলে শ্রীপুর পৌরসভার মাস্টারবাড়ী (লিচু বাগান) এলাকার জাহাঙ্গীর সুপার মার্কেটের বিকাশ ও মুদি ব্যবসায়ী মোখলেসুর রহমান (৩২)। প্রত্যেকটি ঘটনার মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন গাজীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) শফিউল্লাহ শফিক।
শ্রীপুরের গাজিয়ারন গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ২৩ জুলাই জমি সংক্রান্ত বিরোধে জোরপূর্বক গাছ কাটার ভিডিও ধারণ করতে গিয়ে কৃষক আব্দুল আজিজের সাথে প্রতিপক্ষ মনির হোসেন, রাকিব, কামরুজ্জামান, সজিব খাঁ, শ্যামল ও কাজলদের সাথে বাক বিতন্ডা ও হাতাহাতি হয়। এক পর্যায়ে তা বড় ধরনের সংঘর্ষে রূপ নেয়। দুই পক্ষ লাঠিসোটা নিয়ে পরষ্পরের ওপর হামলা চালায়। এ ঘটনায় কৃষক আব্দুল আজিজসহ উভয় পক্ষের কমপক্ষে ১০ জন আহত হন। তাদেরকে প্রথমে শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে গুরুতর আহত দুইজনকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
কৃষক আব্দুল আজিজের ছেলে শহীদুল্লাহ জানান, অবস্থার অবনতি হলে কৃষক আব্দুল আজিজকে রোববার (২৫ জুলাই) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার (২৬ জুলাই) বেলা ১১টার দিকে তিনি মারা যান।
মামালার তদন্ত কর্মকর্তা শ্রীপুর থানার-উপ পরিদর্শক (এসআই) সজীব হাসান জানান, এ ঘটনায় কৃষক আব্দুল আজিজের ছেলে বাদী হয়ে শ্রীপুর থানায় মামলা দায়ের করেছে। হাসপাতালে কৃষক আজিজ মৃত্যুর খবর পেলে স্থানীয় জনতা ও বাদীর স্বজনেরা আসামী হেলিম খান ও আরিফ খানকে সোমবার (২৬ জুলাই) রাতেই আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। পুলিশ ওই দুই আসামীকে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠিয়েছে।
এদিকে, শ্রীপুর পৌরসভার বেড়াইদেরচালা গ্রামের মৃত আবুল হোসনের ছেলে সৈয়দ মাহবুব হোসেন মাসুম আহমেদ (২৫) ঈদের দিন বুধবার (২১ জুলাই) দিবাগত রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত মাওনা চৌরাস্তায় চামড়া কেনাবেচা করে বাসায় ফিরেন। সে বাসায় পৌছে তার কক্ষের দরজা খোলা দেখে কিছু বুঝে উঠার আগেই চারপাশ থেকে ৭/৮ দুর্বৃত্ত তাকে ঘিরে মারপিট শুরু করে। পরে দৃর্বৃত্তরা তাকে বাড়ির বাইরে বের করে লাঠিসোটা দিয়ে পিটিয়ে মারাত্ন আহত করে পালিয়ে যায়। হামলাকারীরা আগে থেকেই বাড়ির অন্যান্য ঘরের দরজা বাইরে থেকে আটকিয়ে দেওয়ায় তার চিৎকার শুনে বাড়ির লোকজন তাকে উদ্ধার করতে পারেনি। পরে আহাতাবস্থায় সে নিজেই বাইরে থেকে আটকিয়ে দেওয়া একটি ঘরের দরজা খুলে দিয়ে অচেতন হয়ে পড়ে।
শ্রীপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাহফুজ ইমতিয়াজ ভূঁইয়া জানান, মুমূর্ষু অবস্থায় তার স্বজনেরা মাসুম আহমেদকে প্রথমে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়ে। পরে অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকার ন্যাশনাল ইন্সটিউিট অব নিউরোসাইন্স হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার (২৩ জুলাই) সকাল সাড়ে সাতটার দিকে তিনি মারা যান। মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত করছে।
অপর একটি ঘটনার বর্ণণায় তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার (২২ জুলাই) রাত ৯টায় উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের চৌরাস্তায় (তেলিহাটি মোড়) ভাই ভাই ট্রেডার্স থেকে একটি গ্যাস সিলিন্ডার কেনা নিয়ে দোকান মালিক মোজাম্মেলের হোসেনের সাথে স্থানীয় তোফাজ্জল সরকারের বাক-বিতন্ডা হয়। এক পর্যায়ে তারা মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন। খবর পেয়ে তোফাজ্জলের ভাই মোফাজ্জল সরকার ও তাইজু সরকার এসে দোকানে হামলা চালায়। তারা দোকানের ক্যাশ বাক্সসহ আসবাব ভাংচুর করে। এক পর্যায়ে হামলাকারীরা দোকানের ক্যাশ বাক্সের ড্রয়ার ভেঙ্গে নগদ টাকা লুট ও পেট্রোল ঢেলে দোকানে অগ্নিসংযোগ করে। এতে দোকান মালিক ও তার তিন ভাই দগ্ধ হয়। এ ঘটনায় দোকান মালিক মোজাম্মেল হোসেনের ভাই তোফাজ্জল হোসেন বাদী হয়ে ৩ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ১০/১২ জনকে অভিযুক্ত করে শুক্রবার (২৩ জুলাই) সকালে শ্রীপুর থানায় মামলা একটি মামালা দায়ের করেন। চারদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর সোমবার (২৬ জুলাই) দিবাগত রাত সাড়ে ১১ টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরিফ মৃত্যুবরণ করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, রোববার (২৫ জুলাই) সন্ধ্যায় শ্রীপুর পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর শাহজাহান মন্ডলের ছেলে তাজিম মন্ডলের সাথে শ্রীপুর চৌরাস্তা (বাসস্ট্যান্ড) এলাকার মনির হোসেনের মোটর পার্টসের দোকানে মবিল ও খুচরা যন্ত্রাংশ কেনা বেচা নিয়ে বাক বিতন্ডা হয়।
খবর পেয়ে সাবেক ওই কাউন্সিলর এগিয়ে আসলে তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এসময় তারা কাউন্সিলরকে হামলা করে আহত করে। হামলার ঘটনা একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল নিউজ ২৪ এর স্থানীয় প্রতিনিধি ও কাউন্সিলরের ভাগিনা আল আমীন ভিডিও ধারণকালে তিনিও হামলার শিকার হন। আহতদের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এ ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে বলে জানান শ্রীপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাহফুজ ইমতিয়াজ ভূঁইয়া।
প্রত্যক্ষ্যদর্শীদের বরাত দিয়ে শ্রীপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাহফুজ ইমতিয়াজ ভূঁইয়া জানান, ঘটনার সময় ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার নৈকাটি লেবুবুলি এলাকার সামসুল হকের ছেলে অভিযুক্ত যুবক রুবেল গত তিনদিন যাবত না খেয়ে রয়েছে বলে ওই দোকানে প্রবেশ করে। সেখানে বসে কৌশল করে দোকানের ক্যাশ বাক্স থেকে টাকা হাতিয়ে নিতে থাকে। এতে তাকে বাধা দিলে রুবেলের সাথে থাকা ছুরি দিয়ে দোকানদার মোখলেসুর রহমানকে ছুরিকাঘাত করে গলা কেটে হত্যা করে। এসময় চিৎকার শুনে আশপাশে থাকা লোকজন দৌড়ে এসে ওই যুবককে হাতেনাতে আটক করে পুলিশে খবর পাঠায়। সে গত কয়েকদিন আগে স্থানীয় খাজা বেকারীর পাশের তার এক আত্নীয়/বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে আসে।
এসব ঘটনায় স্থানীয় তিনজন সংবাদকর্মী মোতাহার হোসেন তার ফেসবুকে আইডিতে লিখেছেন আর কত হত্যা!!!, রুবেল রাফি তার ফেসবুকে আইডিতে লিখেছেন আমাদের শ্রীপুর কে মনে হচ্ছে মৃত্যুপুরী এবং এস এম জহিরুল ইসলাম তার ফেসবুকে আইডিতে লিখেছেন নিরাপত্তার চাদরে আগলে রাখুন শ্রীপুরকে। আরেকজন সচেতন ব্যাক্তি আরিফ প্রধান তার ফেসবুকে আইডিতে লিখেছেন শ্রীপুরে আবারও হত্যা!। শ্রীপুর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী কলেজের পদার্থ বিজ্ঞানের প্রভাষক শাহিদুল ইসলাম সুজন তার ফেসবুকে আইডিতে লিখেছেন এটা নতুন কিছু না। শ্রীপুরে এটা কমন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গাজীপুরের সংবাদকর্মী রিপন আনসারী তার ফেসবুকে আইডিতে লিখেছেন শ্রীপুরে অপরাধীরা নিরাপদবোধ করছে কেন!
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সম্পাদক মো: হারুনÑঅর রশীদ ফরিদ জানান, গত কয়েকদিনে শ্রীপুরে ছাত্রলীগ নেতাসহ চারটি হত্যাকান্ড এবং সাংবাদিক ও জনপ্রতিনিধির উপর হমালা জনমনে অশান্তি সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে স্থানীয় প্রশাসন এবং সরকারকে বেকায়দায় ফেলানোর চেষ্টা করছে কিছু দুষ্কৃতিকারীরা। প্রাশন এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ গুরুত্বসহকারে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করে অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে শাস্তির দাবী জানান ওই আইনজীবী।
গাজীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) এস এম শফিউল্লাহ শফিক বলেন, সবগুলো ঘটনার মামলা হয়েছে। পুলিশ একটি হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকায় দুজনকে গ্রেফতারও করেছে। ছাত্রলীগ নেতা মাসুম আহমেদ হত্যাকান্ডের ঘটনা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত করছে। অন্যসব ঘটনায় গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। খুব শিঘ্রই গ্রেফতারের সংবাদ পাওয়া যাবে। সাধারণ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুলিশের সকল তাৎক্ষণিক তৎপরতা সম্পর্কে জানে না। সে কারণে হয়ত বা মন্তব্য করতে পারে। তবে আইনী অগ্রগতির তথ্যগুলো পেলে অবশ্যই প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠবে।