রংপুরঃ অনুপ্রেরণা মানুষকে সাহস যোগায়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ত্যাগের মহিমা শেখায়। সমাজের বিশিষ্টজনেরা অতিত বীরদের ত্যাগের আলোচনা করে যুবকদের উজ্জীবিত করে। এজন্য সকল জাতীয় দিবসে দেশময় হয় বিশেষ দিনগুলোতে নানা অনুষ্ঠান। যে সব মানুষ দেশের জন্য, ভাষার জন্য লড়াই সংগ্রাম করেছেন, সেই সব মানুষদের সমাজে বাঁচিয়ে রাখতে নির্মাণ করা হয় ভাষ্কর্য। তাদের জীবনী নিয়ে করা হয় নানা অনুষ্ঠান। অথচ ভাষার জন্য যে সব মানুষ লড়াই করেছেন তাদের জীবনী জানাতো দূরের কথা স্থানীয়ভাবে তাঁরা স্মৃতির অতলে চলে যাচ্ছে।
সরকারি-বেসরকারি বা কোন সাংগঠনিকভাবে তাদের স্মৃতি সংরক্ষনে নূন্যতম কোন উদ্যোগ নেই।
উত্তরাঞ্চলের ছয় ভাষা সৈনিকের নাম নতুন প্রজন্মতো দূরের কথা ষাটার্ধো মানুষরাও জানেন না। ওই সব ভাষা সৈনিকরা হলেন ঠাকুরগাঁও বালিয়া ডাঙ্গী উপজেলার দবিরুল ইসলাম, পঞ্চগড়ের মির্জা নূরুল হুদা, দিনাজপুরের আসলে উদ্দিন, নীলফামারী সদর উপজেলার খয়রাত মিয়া, সৈয়দপুরের অধ্যাপক আব্দুল হাফিজ ও ডিমলা উপজেলার মনির উদ্দিন ভাষানী। এর মধ্যে পাঁচজন অনেক আগে প্রয়াত হয়েছেন। গত বছরের ২৭ জানুয়ারী পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন ডিমলার মনির উদ্দিন ভাষানী। উত্তরাঞ্চলের ভাষা আন্দোলনে স্থানীয় ভাবে ওই সব ভাষা সৈনিক যথেষ্ট অবদান রাখেন। বিশেষ করে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় ভাষা আন্দোলনে জনমত সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন এ্যাড. আব্দুর রহিম, আসলে উদ্দিন, মির্জা নুরুল হুদা ও অধ্যাপক আব্দুল হাফিজ।
এ্যাড. আব্দুর রহিম আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে আমৃত্যু জড়িত ও তার ছেলে ইকবালুর রহিম এমপি সরকার দলীয় হুইপ থাকার কারণে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজের নাম এম আব্দুর রহিমের নামে নামকরণ করা হয়েছে। তবে তিনি একজন ভাষা সৈনিক ছিলেন সেই পরিচয় পুরোপুরি তলিয়ে গেছে। দবিরুল ইসলাম শুধু ভাষা সৈনিকই ছিলেন না, তিনি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিলেন এবং পরে কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যও ছিলেন। পাকিস্তানি কারা প্রকোষ্ঠে আইয়ুবী নির্যাতনে ১৯৬০ সালের ১৩ই জানুয়ারী তার মৃত্যু হয়। তিনি ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বামুনিয়া গ্রামে জন্ম নেন। অথচ তাঁর কোন স্মৃতি চিহ্ন ঠাকুরগাঁও জেলা জুড়ে কোথাও মিলবে না।
তার গ্রামের মানুষ ভাষা সৈনিক দবিরুল ইসলামের নামও জানে না। ভাষা সৈনিক মির্জা নুরুল হুদা ও আসলে উদ্দিন আরো চরমভাবে উপেক্ষিত। এদের নাম হাল আমলের রাজনীতিবিদরাও জানে না। নিজ জন্মস্থানেও নেই তাদের কোন স্মৃতিচিহ্ন।
নীলফমারীর সদর উপজেলার সোনারায় ইউনিয়নের সন্তান খয়রাত মিয়া। তিনি পাক আমলে প্রাদেশিক সরকারের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য প্রাদেশিক পরিষদে কথাও বলেছেন। ছাত্রদের মিছিলেও সামিল হয়েছেন। তিনি যে একজন ভাষা সৈনিক ছিলেন দুই একজন ইতিহাসবেত্তা ছাড়া বর্তমান আমলের কেউই জানে না।
তার নামে রেলওয়ের একটি স্টেশনের নাম রাখা হলেও ওই স্টেশনটি এখন পরিত্যাক্ত।
নীলফামারী শহরে একটি মহল্লায় রাস্তার নাম তার নামে করা হয়েছে। কিন্তু কোথাও ভাষা সৈনিক শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। অধ্যাপক আব্দুল হাফিজ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। ন্যাপের (মোজাফ্ফর) প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তার খ্যাতি রয়েছে। সাংবাদিক ও সাহিত্যিক সমাজে রয়েছে তার দুনিয়া জুড়ে নাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়নের ব্রহ্মত্তর গ্রামে তার জন্ম হলেও তিনি একজন ভাষা সৈনিক ছিলেন এমন কথা সৈয়দপুরের মানুষতো দূরের কথা তাঁর পাড়ার মানুষও জানে না। এমন একজন দেশ বরেন্য ব্যক্তির সৈয়দপুর শহরে নেই কোন ভাষ্কর্য্য। এমনকি একটি সড়কের নামও তার নামে নাম করন করা হয়নি।
ভাষা সৈনিক মনির উদ্দিন ভাষানীর জন্ম নীলফামারীর সর্বউত্তরের উপজেলা ডিমলার বালাপাড়ায়। তিনি তেভাগা আন্দোলনে যেমন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তেমনই সক্রিয় ছিলেন স্থানীয় ভাষা আন্দোলনে। রাজনীতির কারণে জেল খেটেছেন। এমনকি এক দশক পর্যন্ত আত্মগোপনে রাজনৈতিক জীবন কাটিয়েছেন। আমৃত্যু এই বিপ্লবী মানুষটি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে লড়াই করে গেছেন। বাংলাদেশের ওয়াকার্স পার্টির রাজনীতির সঙ্গে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন। পরিতাপের বিষয় এমন ত্যাগি মানুষটি যে ভাষা সৈনিক ছিলেন তা ডিমলাবাসী জানেনেই না। তার নামে কোন সড়কের নামকরণও করা হয়নি।
ভাষা সৈনিকদের নাম হারিয়ে যাওয়া বিষয়ে কথা হয় যুব নেতা আশরাফুল আলমের সঙ্গে। তিনি আগামী নিউজকে আক্ষেপ করে বলেন, যেহেতু মহামতি ওইসব মানুষদের পরিবারের কোন সদস্য বড় দলের বড় নেতা নন। কিংবা তাদের পরিবারের কেউ বর্তমানে কোন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। সেজন্য ওইসব মানুষের স্মৃতিচিহ্নও সমাজ থেকে ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বাধ্য। কথা হয় বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য রুহুল আলম মাষ্টারের সঙ্গে।
তিনি বলেন, স্থানীয় ত্যাগী রাজনীতিবিদদের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে হলে স্থানীয় ইতিহাস রচনা করে তা স্থানীয় শিক্ষার্থীদের ঐচ্ছিক বিষয়ে অর্ন্তভূক্ত করলেই জনহিতৈষী মানুষদের ত্যাগ বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। একই সঙ্গে এসব মানুষের জীবনী জানতে পারলে পরবর্তী প্রজন্মও ত্যাগের মহিমায় গড়ে উঠবে। স্থানীয় ভাষা সৈনিকদের স্মৃতি রক্ষা বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে কথা হয় ঠাকুরগাঁয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ইউএনও জোবায়ের হোসেন, নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ইউএনও জয়শ্রী রানী রায়, নীলফামারী সদর উপজেলার ইউএনও এলিনা আকতার ও সৈয়দপুর উপজেলা ইউএনও নাসিম আহমেদের সঙ্গে।
তারা জানান, বিষয়টি নিয়ে এখন ভাবার সময় এসেছে। দেখাযাক আগামী দিনে কি করা যায়।
আগামীনিউজ/এএস