সুন্দর তুমি এসেছিলে আজ প্রাতে

মহিউদ্দিন মখদুমী ডিসেম্বর ৪, ২০২২, ১২:৪০ পিএম

দীর্ঘ ১২ বছর পর আপনার সাথে আজ দেখা হলো আমার। প্রথমে চিনতে না পরলেও পরে চিনেছি। কথা গুন গুন করে বেরুতে চাইছিল।  প্রস্থে শরীর বেড়েছে একটু। মোবাইলে কথা বলা কমেনি এখনো। বোতল খুলে পানি খেলেন। খালি বোতলটি হাতে ধরে থাকলেন কিছুক্ষণ। পরে কোথাও ফেলবার জায়গা নেই দেখে খুঁজে খুঁজে একটি টেবিলের নীচে রাখা ঝুঁিড়তে ফেললেন। আপনি ইচ্ছে করলে, খালি বোতলটি বয়কে ডেকে দিতে পারতেন। অথবা পায়ের নীচে ফেলে কছলাতে পারতেন অথবা তিন তলার জানালা দিয়ে ছুঁড়ে দিতে পারতেন। করেননি, এই সচেতনতা বোধের জন্যই আপনি আমার কাছে অন্যরকম ছিলেন।

দীর্ঘ ১২ বছর পর আপনার ছায়ায় কাটানো বসন্তের দিনগুলো নড়ে উঠলো। কী মনোহর ছিল দিনগুলি। আপনার চিন্তার স্পর্শে থাকায় ঋতু বৈচিত্রকে খুব উপভোগ করতাম। ফেসবুক, ইউটিউব পাত্তা পেত না হৃদয় বোধের কাছে। দেখুন ! এখন কী অসম্ভব দিন বদলে গেছে আমাদের। প্রকৃতি দেখবার চোখ গুলো অন্ধ হয়ে গেছে ডিজিটাল মাধ্যমে মিশে। এই যে অগ্রহায়ণ মাস চলছে। শীতের সাথে উষ্ণতার গোপন লড়াইয়ের আনন্দ ক’জন অনুভবে নেয়। কমার্শিয়ালিটি খুবলে খাচ্ছে আমাদের যাপিত জীবনের শেষ সুখটুকু। উষ্ণতার উপশম হলেই পাশ ফিরে শোয়াটাই এখন বড় সুখ। সকালেই যে বেরুতে হবে, সময় কোথায় অতীন্দ্রিয় স্পর্শের। আমি মিলিয়ে দেখতাম আপনার অনুভবের স্থানটি সব সময় সৃষ্টিশীল ছিল। জন্যই আপনি আমার বোধের অন্যরকম ছিলেন।

সময় থেমে থাকে না। একজন ধর্ষিতা, একজন বিধবা, একজন তালাকপ্রাপ্তা, একজন বেকার, একজন চাকুরীচ্যুত, একজন অপমানিত, একজন ক্ষমতাহীন কিংবা একজন ফকীর যে কারো সময়ের মতো  একজন মন্ত্রী, একজন এমপি, একজন উচ্চ পদের সরকারী কর্মকর্তা কিংবা একজন সফল ব্যবসায়ীরও সময় চলে একই গতিতে। সময় সব সময় বলে দেয় জীবন থেমে থাকে না। যে কোন ভাবেই হোক না কেন জীবন লড়তে লড়তে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যেতে যেতে মৃত্যুর কাছে গিয়ে নতজানু হবেই। মৃত্যু মানেই অর্থ-বিত্ত-বৈভব-ক্ষমতা সব শেষ। আবার যতদিন আয়ু আছে জীবন শব্দ করবেই। ‘আমি এসেছিলাম’ জীবনের এই শব্দটি জানিয়ে দেয়ার কাজটি আপনি অন্য রকম ভাবে সাজাতে চাইতেন। পৃথিবীতে অবস্থানের নান্দনিক চিহ্ন আঁকতে চাইতেন। জন্যই আপনি আমার চিন্তায় অন্যরকম ছিলেন। অন্য রকম মানে প্রবাহমান চিন্তার বিপরীদে চলা।

আপনাকে ছেড়ে আসার দিনটি খুব কষ্ঠের ছিল। কেন? কি কারণে আপনাকে ছেড়ে আসতে হবে? এর উত্তর মেলেনি আজও। অথবা উত্তর মেলাতে পারিনি। আপনাকে ছেড়ে আসার পর অঝোরে কেঁদেছে মন। নিজের অপরাধ খুঁজেছি। ভুল খুঁজেছি। কিছুই পাইনি। কারণ আমি এখনো বিবেক হাতের তালুতে রেখে পথ হাঁটি। ঘড়ি দেখার মতো বিবেক দেখি । নিজেরে জন্যে। আপনাকে ছেড়ে এসে টানা ছয় মাস বইয়ের ভিতর পড়ে ছিলাম। বই ছিল আমার মানসিক আশ্রয়। পত্রিকা পড়তাম। দেখতাম পুরো পৃথিবী। সাত মাসের মাথায় একটি জীবিকার পথ হয়েছিল। সেটি ছাড়িনি এখনো। দীর্ঘ ১২ বছরে অনেক বদলে গেছি আমি। মেধাস্বত্ব বিক্রি করে দিয়ে যা আয় হয় তা দিয়েই চলে জীবন। যা উপার্জন করি জমাতে পারি না কিছুই। বিবেক বেঁচে থাকলে যা করতে হয় তাই করি। তিনটি বই লিখেছি। আরো দুটি আসবে। যার কাছে মেধাস্বত্ব বিক্রি করেছি। তিনি তুখোর জ্ঞানী। বাঙালী হলেও ইংলিশই তাঁর ভাষা। এখন বাংলার প্রেমে পড়েছে। ফোনে যখন কথা বলেন তখন মনে হয় দৈব্য কিংবা ফেরেস্তা কথা বলছেন। আমাকে তাঁর কাছে ডাকেন। এ দেশ ছেড়ে কোথাও গেলে শান্তি পাব না এই ভেবে আমি যেতে চাই না। না করে দিয়েছি। অদ্ভুত ভাবে ‘দেজা ভু’ নামক একটি রোগে আক্রান্ত হয়েছি। কঠিন এবং জঠিল এই রোগ। দেজা ভু রোগটি যখন খুব প্রবল ভাবে দেখা দেয় তখন ভবিষ্যতে কী ঘটবে বলে দেয়া যায়। পরিকল্পনা ও সুপরামর্শ দিয়া যায়। দেজা ভু ছিল আপনার রোগ। আর সর্বশেষ আক্রান্ত রোগী হয়তো আমি।

সব সময় ব্যতিক্রমি চিন্তা ছিল আপনার। যা সাজাতেন সুন্দর পরিপাটি করতেন। যা ভাবতেন তার দৃশ্যপট সুন্দর করতেন। চিন্তা স্বত্তার বিভিন্ন রুপ ছিল আপনার। নদী ভালোবাসতেন। নদীর প্রতি গভীর প্রেম ছিল আপনার। শেষে তিস্তা নামের একটি স্বপ্ন দাঁড় করিয়ে নদীকে কাছে রাখতে চেয়েছিলেন। এখন সেই তিস্তা নামের নদীটি কেমন আছে এবং আপনি? দেখা হলো অথচ জানা হলো না। শুধু চকচকে অনুভবে এসেছিল ‘সুন্দর তুমি এসেছিলে আজ প্রাতে।’

সাংবাদিক ও লেখক
০৩-১২-২০২২