ঢাকাঃ বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এ দেশের শতকরা ৬০-৭০ ভাগ মানুষ এখনো গ্রামে বাস করে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পূর্বে ভারতবর্ষে প্রাচীন, মধ্যযুগ (সুলতানী ও মোগল শাসন) ও আধুনিক যুগের (ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী শাসন) শাসনের অর্থসম্পদের মূল উৎস ছিল বাংলার কৃষি। বর্তমানেও আমাদের স্বাধীন দেশের অর্থনীতি অনেকটায় কৃষি নির্ভর। বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের ১৩.৬ শতাংশ আসে কৃষি থেকে। কৃষি বাংলার অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করলেও কৃষির মূল চালিকাশক্তি বাংলার কৃষকরা সবসময় থেকেছে উপেক্ষিত। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে ফসল উৎপাদন করলেও তার সুফল তারা ভোগ করতে পারেনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৈশর-তরুণ বয়স থেকে বাংলার কৃষকের দৈন্য স্বচক্ষে দেখেছেন যা বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। তাই তার সমস্ত রাজনৈতিক জীবনে কৃষক ও কৃষির উন্নয়ন ও কল্যাণ ভাবনা নিবিড়ভাবে কাজ করেছে। পঞ্চাশের দশকে তাঁকে দেখা গেছে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে কৃষকদের পক্ষে কথা বলতে। আর তাঁর কৃষকদের জন্য সংগ্রামের শুরু হয় যুক্তফ্রন্ট গঠনের মাধ্যমে।
যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি হিসেবে যে ২১ দফা প্রদান করা হয়েছিল তাতে স্পষ্ট কৃষক শ্রমিকদের ভাগ্যোন্নয়ন ও স্বার্থের কথা বলা ছিল। দফাগুলো বিশ্লেষণ করলে নিঃসন্দেহেই বলা যায় ২১ দফা কর্মসূচীই ছিল দেশের কৃষক ও কৃষির উন্নয়নের প্রথম রাজনৈতিক দলিল। কৃষি ও কৃষকদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা চিন্তা বেশ প্রকট ছিল বলেই তাঁকে যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষি, বন, সমবায় ও পল্লী মন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।
তিনি মনে করতেন দেশের কৃষি বিপ্লব সাধনের জন্য কৃষি ও কৃষকের কোন বিকল্প নেই। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রথম আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। সেখানে অন্যসব বিষয়ের সাথে কৃষি ও কৃষকের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।
তিনি বলেন, অর্থনীতিকে অবশ্যই পুনর্গঠন করতে হবে। খাদ্য, আশ্রয় ও বস্ত্র অবশ্যই দিতে হবে। এই স্বাধীনতা আমার কাছে সেদিনই প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে যেদিন বাংলাদেশের কৃষক, মজুর ও দুঃখী মানুষের সকল দুঃখের অবসান হবে। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশের অর্থনীতি পুণর্গঠনের জন্য বাংলাদেশের এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদী না থাকে সে বিষয়ে জনগণকে নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন,আমরা কেন অন্যের কাছে খাদ্য ভিক্ষা চাইব। আমাদের জমি দুনিয়ার সেরা উর্বর জমি। আমি কেন সেই জমিতে দ্বিগুণ ফসল ফলাতে পারব না, তিনগুণ করতে পারব না? আমি যদি দ্বিগুণও করতে পারি তাহলে আমাকে খাদ্য কিনতে হবে না।
আমি চাই বাংলাদেশের প্রত্যেক কৃষক ভাইয়ের কাছে, যারা সত্যিকার কাজ করে, যারা প্যান্টপরা, কাপড়পরা ভদ্রলোক তাদের কাছেও চাই জমিতে যেতে হবে, ডবল ফসল করুন। প্রতিজ্ঞা করুন, আজ থেকে ওই শহীদদের কথা স্মরণ করে ডবল ফসল করতে হবে। যদি ডবল ফসল করতে পারি আমাদের অভাব ইনশাআল্লাহ হবে না।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে ৬০ থেকে ৭০ দশকে অধিকাংশ কৃষি জমি এক ফসলি ছিল। এমনকি অনেক জমি অব্যবহৃত পড়ে থাকত। বঙ্গবন্ধুর এ নির্দেশনা জনগণের মাঝে বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল। তার আহŸানে সাড়া দিয়ে ক্যান্টনমেন্টগুলোর খালি জায়গায় সেনাসদস্যরা স্বেচ্ছাশ্রমে ধান চাষ শুরু করেন। ঢাকার অভিজাত এলাকা ধানমন্ডি, গুলশানসহ অন্যান্য এলাকার বাড়ির সামনে খালি জায়গাগুলোয় বিভিন্ন শাকসবজি চাষ শুরু হয়। কৃষি খাতে তখন বেশকিছু সহায়ক কর্মস‚চি ও নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে প্যান্ট, কোট ছেড়ে মাঠে না নামলে বিপ্লব করা যাবে না, তা যতই লেখাপড়া করা যাক, তাতে কোন লাভ হবে না। আপনাদের কোট-প্যান্ট খুলে একটু গ্রামে নামতে হবে। আপনারা যারা কৃষি শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন আপনাদের গ্রামে গিয়ে কৃষকের সাথে মিশে যেতে হবে, মনোযোগ দিতে হবে তাদের চাহিদা আর কর্মের ওপর, তবেই তারা সাহসী হবে, আগ্রহী হবে, উন্নতি করবে। ফলবে সোনার ফসল ক্ষেত ভরে। আপনারা এখন শহরমুখো হওয়ার কথা ভুলে যান। গ্রাম উন্নত হলে দেশ উন্নত হবে, তখন আপনারা আপনা-আপনি উন্নত হয়ে যাবেন। গ্রামভিত্তিক বাংলার উন্নতি মানে দেশের উন্নতি, আর আপনাদের উন্নতি তখন সময়ের ব্যাপার।
শহরের ভদ্রলোকদের দিকে তাকিয়ে আপনাদের চিন্তা বা আফসোস করার কোনো কারণ নেই। কেননা গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের দিকে আমাদের সবার ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। কৃষক বাঁচাতে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে, তা নাহলে বাংলাদেশ বাঁচতে পারবে না।
অনেকের আগ্রহ থাকতে পারে কৃষি উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অর্থ বরাদ্দ কেমন ছিল। ১৯৭২-৭৩ সালে ৫০০ কোটি টাকা উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ ছিল এর মধ্যে ১০১ কোটি টাকা শুধু কৃষি উন্নয়নের জন্য রাখা হয়েছিল। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের মাধ্যমে সোনার বাংলা গড়ে তুলতে ১৯৭৩ সালের ১ জুলাই প্রণীত হয় বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা।
অবকাঠামো পুনর্গনের সাথে সাথে তিনি এই পরিকল্পনায় কৃষি ব্যবস্থাপনা আধুনিকীকরণে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা নিশ্চিতে সর্বাধিক মনোযোগ দেন। এই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কৃষি মন্ত্রণালয়ে ৪৫৯.১০ কোটি, প্রাণী, মৎস্য ও বন মন্ত্রণালয়ে ১১০.০৭ কোটি, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ৩২১.২০ কোটি, পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ে ১৪৯.৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ফলে তখন থেকেই কৃষির প্রতি, কৃষি স¤প্রসারণের প্রতি, কৃষি উন্নয়নের প্রতি কৃষকরা আন্তরিকতার সাথে ঝাপিয়ে পড়েছিল।
১৯৬৮-৬৯ সালে কৃষিকাজের জন্য সারাদেশে ১১ হাজার শক্তিচালিত পাম্প ছিল। বঙ্গবন্ধুর দিক নির্দেশনায় ৭৪-৭৫ সালে পাম্পের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬ হাজারে। ফলে সেচের আওতাধীন জমির পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশ বেড়ে ৩৬ লাখ একরে উন্নীত হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে কৃষকদের ভর্তুকি ম‚ল্যে সার দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু ফসলের উৎপাদন বাড়াতে উচ্চফলনশীল বীজের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।
কৃষকদের আধুনিক কৃষির ছোঁয়া দিতে কলের লাঙ্গল ও ট্রাক্টর আমদানি করেন। কৃষি কেন্দ্রিক একটি গ্রামমুখী অর্থনীতি ব্যবস্থার বিকাশে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির বিশেষ আদেশে পরিবার প্রতি জমির মালিকানা ৩৭৫ বিঘা থেকে কমিয়ে ১০০ বিঘায় নামিয়ে আনা হয়। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন। ভ‚-স্বামীদের হাত থেকে ভ‚মির মালিকানা বের করে এনে ভ‚মিহীন ক্ষুদ্র কৃষকদের মাঝে তা বিতরণের উদ্যোগ নেন।
সমবায়ী পদ্ধতিতে কৃষকদের মধ্যে জমি বন্দোবস্ত দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ১৩৫ এ বঙ্গবন্ধুর কৃষি সংস্কার আর কৃষক দরদি মনোভাবের আরও কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। এই আদেশে বলা হয়েছে, নদী কিংবা সাগরগর্ভে জেগে ওঠা চরের জমির মালিকানা রাষ্ট্রের হাতে নিয়ে হতদরিদ্র কৃষকদের মাঝে বণ্টন করা। মহাজন ও ভ‚মিদস্যুদের হাত থেকে গরিব কৃষকদের রক্ষাই উদ্দেশ্য ছিল তাঁর। কৃষিজপণ্যে ক্ষুদ্র বিক্রেতাদের শুল্ক থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর আমলে।
কৃষির প্রতি বঙ্গবন্ধুর কতটা টান ছিল, তা একটি ঘটনা থেকেই ধারণা করা যায়। ১৯৭৪ সালে ফার্মগেটের খামারবাড়িতে পাঁচতারকা হোটেল তৈরীর সব ধরনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকেও খামারের এ জমিতে হোটেল নির্মাণের অনুমোদন প্রদান করা হয়েছিল। কাজী এম বদরুদ্দোজা বিষয়টি জানতে পেরে ছুটে গেলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। তিনি অনেকটা অভিমান নিয়ে বললেন, কৃষি গবেষণার জমিতে হোটেল বানানোটা তিনি মানতে পারছেন না। বঙ্গবন্ধু এর কারণ জানতে চাইলেন। কাজী বদরুদ্দোজা বললেন, ‘এটা হলে কৃষির মস্ত বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। এ জমিতে হতে পারে কৃষি গবেষণার জন্য প্রশাসনিক সমন্বয়ের প্রধান কার্যালয়। বঙ্গবন্ধু কথাটা শুনে আনন্দিত হলেন। এমন একটা আবেদনের অপেক্ষায় তিনি যেন বসেছিলেন। কৃষির গবেষণা বলে কথা।
কাজী বদরুদ্দোজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তুই ঠিক কী চাস, আমার কাছে লিখে নিয়ে আয়। বঙ্গবন্ধুর সহকারীর কক্ষে গিয়ে কাজী বদরুদ্দোজা ‘বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল’-এর গঠন কাঠামো ও কার্যপরিধি এবং এর প্রস্তাব লিখে নিয়ে এলেন। বঙ্গবন্ধু প্রসন্নচিত্তে তাতেই স্বাক্ষর করে অনুমোদন দিয়ে দিলেন। মুহ‚র্তেই জন্ম নিল বাংলাদেশের কৃষিবিষয়ক সব সংস্থার সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল’।
গবেষণার ধারণাকে প্রাধান্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘খাদ্য বলতে শুধু ধান, চাল, আটা, ময়দা আর ভুট্টাকে বোঝায় না; বরং মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, শাকসবজি এসবকেও বোঝায়। এর মাধ্যমে তিনি গবেষকদের কৃষির উন্নয়নে সুষম ও সমন্বিত খাদ্য গবেষণার নতুন ধারণা দ্বারা প্রভাবিত করেছেন। খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিকে গবেষণার উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করে তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণায় নিজেদের আত্মনিয়োগে প্রেরণা জুগিয়েছেন।
স্বাধীনতার পরপরই কৃষির উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এবং নির্দেশনায় বেশ কিছু নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। ১৯৭২ সালে দেশে তুলার চাষ সম্প্রসারন করার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে তুলা উন্নয়ন বোর্ড গঠিত হয়। পুনর্গঠন করা হয় হর্টিকালচার বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি ও রাবার উন্নয়ন কার্যক্রম। সোনালি আঁশের সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করতে প্রতিষ্ঠা করা হয় পাট মন্ত্রণালয়। এছাড়াও ইক্ষু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনসহ অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন। বঙ্গবন্ধু কৃষি সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বীজ ও সার সরবরাহের প্রতিষ্ঠান বিএডিসিকে পুনর্গঠন এবং সারা দেশের বীজ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন ১৯৭৫ সালে। এই বিএডিসি আধুনিক কৃষি সেচ ব্যবস্থার প্রচলন করে এ দেশে।
কৃষিতে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের জন্য তিনি কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। এগুলো তৈরির পেছনে বঙ্গবন্ধুর গবেষণার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের দর্শন ও চিন্তা কাজ করেছে। দেশে ধান গবেষণার গুরুত্ব অনুধাবন করেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে আইন পাসের মাধ্যমে ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন এবং ধানের ওপর নিয়মতান্ত্রিক গবেষণা তখন থেকেই শুরু হয়।
বঙ্গবন্ধুর গবেষণার ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গবেষকরা ১৯৭৫ সালে বিনাশাইল, ইরাটম ২৪ এবং ইরাটম ৩৮সহ নতুন নতুন জাতের ধানের উদ্ভাবন করেন। এর আগে ১৯৭৪ সালে গমের উচ্চফলনশীল জাতের নতুন নতুন গম উদ্ভাবনে বিজ্ঞানীরা সফল হন। এর মধ্যে সোনালিকা জাতটি এদেশে গম উৎপাদনে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। তুলার ৩টি উন্নতমানের জাত বঙ্গবন্ধুর সময়েই উদ্ভাবিত হয়। বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনার মাধ্যমে নতুন নতুন জাতের খাদ্যশস্য উদ্ভাবনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তা আজও গবেষকদের অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করছে।
বঙ্গবন্ধু পাটের সম্ভাবনা নিয়ে যেভাবে ভেবেছেন, তা বিশ্বের আর কেউ হয়ত সেসময়ে ভাবতে পারেনি। এ ভাবনাটি ছিল বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তি থেকে উত্থিত গবেষণা ভাবনা। সে ভাবনা যে কতটা বাস্তবসম্মত ছিল, তা এখন আমরা বুঝতে পারছি। বর্তমানে পাটের ফাইবার বা আঁশ নিয়ে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। পাটের ফাইবার ব্যবহার করে কম্পোজিট ম্যাটেরিয়ালসহ নানা গবেষণালব্ধ উপাদান পৃথিবীর প্রযুক্তির অগ্রযাত্রায় মুখ্য ভ‚মিকা রেখে চলেছে। বঙ্গবন্ধুর গবেষণা ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সেসময়ে ড. কুদরাত-ই-খুদাসহ অন্য গবেষকরা দেশীয় উপাদানগুলোকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে নতুন ধারার গবেষণা শুরু করেন।
কৃষি উপকরণে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাচেতনা যা ছিল আজ এত বছর পরেও আশ্চর্য হতে হয়। কৃষিশিক্ষা, মানসস্মত বীজ উৎপাদন এবং বিতরণ, সুষ্ঠু সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা, কৃষিতে ভর্তুকি, বালাই ব্যবস্থাপনা, সমন্বিত ফসল ব্যবস্থাপনা, খামারভিত্তিক ফসল ব্যবস্থাপনা, সমবায়ভিত্তিক চাষাবাদ, ভেঙে যাওয়া অর্থনীতি পুনর্গঠন, মিল্কভিটা পুনর্গঠন, সার, সেচ, বীজ বিষয়ক কার্যক্রম এসবের ওপর সর্বাত্মক জোর দিয়েছেন। বিশেষ করে রাসায়নিক সারের বিষয়ে তিনি বলেছেন, আমাদের যে সার কারখানাগুলো আছে এগুলোকে নিশ্চিত উৎপাদনমুখী করতে হবে বেশি করে। প্রয়োজনে আরও নতুন নতুন সারের কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে হবে কৃষি বিপ্লবের বাস্তবায়নের জন্য। গবাদিপশুর কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। গরু দিয়ে হাল চাষ, গরুর গোবর জমিতে প্রয়োগ করে জমির উর্বরতা বাড়ানোর তাগিদ তিনি তখনই দিয়েছেন। বালাই ও বালাইনাশকের কথাও তিনি বলেছেন।
নিজেদের বালাইনাশক কারখানা তৈরি ও এর সুষ্ঠু ব্যবহারের প্রতি তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নিজেরা বীজ উৎপাদন করতে হবে। প্রয়োজনে শুরুতে বিদেশ থেকে মানসম্মত বীজ আমদানি করে দেশের বীজের চাহিদা মেটাতে হবে। পরে আমরা নিজেরাই মানসম্মত উন্নত বীজ উদ্ভাবন করব। শীতকালীন ফসল উৎপাদনে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন শীতকাল আমাদের ফসল উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি নির্ভেজাল এবং নিশ্চিত মৌসুম। তাছাড়া অন্য দুই মৌসুমের চেয়ে এ মৌসুমে বেশি সংখ্যক বেশি পরিমাণ ফসল উৎপাদিত হয়। সেজন্য তিনি বলতেন শীতকালে ফসল উৎপাদন বাড়িয়ে আমাদের শস্যভান্ডার টইটুম্বুর করতে হবে।
কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে কৃষির গুরুত্ব সীমাহীন। আমাদের রয়েছে উর্বর মাটি, প্রকৃতি প্রদত্ত অফুরন্ত সম্পদ, আর পরিশ্রমী জনগণ। এগুলোর সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে আমরা অসাধ্য সাধন করে ফেলতে পারি। গড়তে পারব বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা, সুখে থাকবে বাংলার মানুষ, সুখে থাকবে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর আজীবনের লালিত স্বপ্ন ছিল এদেশের শোষিত, বঞ্চিত, অবহেলিত কৃষকের মুখে হাসি ফোটানো, তাই তিনি সার্বিক কৃষি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার প্রদানের পাশাপাশি কৃষি উন্নয়নের সৈনিক কৃষিবিদদের যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। এজন্য বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে আমরা সবাই বদ্ধপরিকর। তাই দরকার আমাদের সমন্বিত, আন্তরিক এবং কার্যকর পদক্ষেপ। বঙ্গবন্ধু একটি নতুন মানচিত্র চেয়েছিলেন, নতুন ভ‚খন্ড চেয়েছিলেন, নতুন জাতিসত্তা চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন একটি স্বনির্ভর সুখী মানুষের সোনার দেশ।
লেখক: মো. কবির হাসান
গবেষণা সহকারী
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়