যাহা গঙ্গা তাহাই পদ্মা

প্রভাত আহমেদ মার্চ ৪, ২০২১, ০৪:৩৪ পিএম
ছবি: আগামী নিউজ

ঢাকাঃ আমাদের দেশে যাকে আমরা বলি প্রমত্তা পদ্মা সেটারই ভারতের অংশের নাম গঙ্গা। এই পদ্মা নদীর দু’ধারের জেলেপাড়া নিয়েই লেখা হয়েছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, পদ্মার মাঝিদের নিয়ে গাঁথা হয়েছে গান ‘সর্বনাশা পদ্মা নদীরে তোর কাছে সুধাই’; নজরুলের ‘পদ্মার ঢেউরে’ গানেও বধুয়ার রূপের সাথে তুলনা করা হয়েছে পদ্মার ঢেউএর ।গঙ্গার পবিত্র জলে স্নান করে শুভ্র হওয়া বাঙ্গালীর কাছে তাই গঙ্গা বা পদ্মা শুধু একটি নদীর নামই নয় বরং তা আমাদের শাশ্বত বাঙ্গালী সংস্কৃতির ধারক ও বাহকও বটে।

গঙ্গার চুক্তির ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করার পূর্বে এই নদীটির কিছু প্রকৌশলগত তথ্য দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। পার্বত্য অঞ্চলে সাধারনত এক বা একাধিক উপনদী মিলে একটি মূল নদীর ধারা উৎপন্ন হয়। হিমালয় পর্বতমালার গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন ভাগীরথী নদী আর নন্দা দেবী, ত্রিশুল, ক্যামেট ইত্যাদি হিমবাহ থেকে উৎপন্ন অলকানন্দা এই দুটি উপনদী মিলেই গঙ্গার মূল ধারাটির সৃষ্টি হয়েছে । পরবর্তীতে জাহ্নবী নদীও এর সাথে মিলিত হয়ে সম্মিলিত প্রবাহ হিমালয়ের গিরীসঙ্কট পার হয়ে ভারতের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের গোয়ালন্দে এসে এটি যমুনার সাথে মিলিত হয়েছে এবং এই সম্মিলিত ধারাটি পরে আবার চাঁদপুরে ‘আপার মেঘনার’ (নদী-প্রকৌশলগত ভাবে সুরমা আর কুশিয়ারার মিলিত প্রবাহই ‘আপার মেঘনা’ বা ‘উপরের দিকের মেঘনা’ নামে পরিচিত) সাথে মিলিত হয়ে ‘লোয়ার মেঘনা’ (‘নিচের দিকের মেঘনা’ যা আমাদের কাছে মুল মেঘনা নদী নামে পরিচিত) নামেই বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। যদিও বাংলাদেশে প্রবেশের পর থেকেই একে পদ্মা নদী নামে ডাকা হয় কিন্তু নদী-প্রকৌশলগত ভাবে গোয়ালন্দের আগ পর্যন্ত এর নাম মুলত গঙ্গা আর গোয়ালন্দ থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত অংশের নাম পদ্মা।

ফাঁরাক্কা ব্যারেজ প্রকল্প

ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নির্মান করা কলকাতা বন্দর ব্রিটিশ ভারতের সবচেয়ে পূরাতন বন্দর ও একসময়কার প্রধান বন্দর ছিল। হুগলী নদীর তীর ঘেঁষে এই কলকাতা বন্দরে ষাটের দশকে নদী থেকে বয়ে আসা বিপুল পলি বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধা সৃষ্টি করে। যার প্রতিকারে ভারত সরকার একটি প্রকল্প হাতে নেয় ১৯৫১ সালে, যাতে গঙ্গা নদীতে ব্যারেজ নির্মান করে একটি বিকল্প খাল দিয়ে গঙ্গার পানিকে হুগলী নদীতে প্রবাহিত করে বন্দরের সঞ্চিত পলিকে স্থানচ্যুত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। সেই পরিকল্পনা পরিশেষে বাস্তবায়িত হয় ১৯৭৪-৭৫ সালে ‘ফারাক্কা ব্যারেজ’ নামে।

গঙ্গা চুক্তির ইতিহাস

১৯৫১ সালে ফারাক্কা ব্যারেজের পরিকল্পনা প্রকাশের পর থেকে শুরু হওয়া বিতর্ক, আলোচনা ও সংঘাতের অবসান ঘটে ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তির মাধ্যেমে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার রয়েছে এক বিশাল ইতিহাস যা আমাদের দেশের পানি বা পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের জানা থাকলেও সাধারন মানুষদের বেশীরভাগই এই বিষয়ে অজ্ঞ, ফলে সৃষ্টি হয় ভূল বোঝাবুঝি। বিখ্যাত পানি বিশেষজ্ঞ ডঃ আইনুন নিশাত ১৯৯৬ সালে তার “Impact of Ganges Water Dispute on Bangladesh” শীর্ষক প্রবন্ধে [৩] গঙ্গার পানি চুক্তির এই ৪৫ বছরের ইতিহাসকে ছয়টি পর্যায়ে ভাগ করেছেন। এই পর্যায়গুলির অনুবাদকৃত সারসংক্ষেপ নিচে দেয়া হলঃ

প্রথম পর্যায় (১৯৫১-১৯৭৪)

এই পর্যায়ের মূল লক্ষ্য ছিল ব্যারেজ নির্মানের পূর্বেই গঙ্গার পানির সুষ্ঠু বন্টন নিশ্চিত করা। ফলশ্রুতিতে মূল আলোচনা কেন্দ্রীভুত ছিল বাংলাদেশ ও ভারতের নিজস্ব দাবীদাওয়া এবং তার যৌক্তিকতার মধ্যে।বাংলাদেশ ও ভারত পরস্পর বিপরীতে অবস্থান নেয়। বাংলাদেশ গঙ্গার পানির সম্পূর্ন প্রবাহের দাবীতে অটুট থাকে এবং দাবী করে যে ফারাক্কার আরো উজানে অবস্থিত জলাধার সমুহ ভারতের প্রয়োজন মেটেতে যথেষ্ট, সেই সাথে গঙ্গায় ব্যারেজ নির্মান করে এর প্রবাহকে বিকল্প খাল দিয়ে হুগলী নদীতে স্থানান্তর করে কলকাতা বন্দরের পলি সমস্যা সমাধানের কারিগরী দিকের পরিকল্পনারও সমালোচনা করে। অন্যদিকে ভারত দাবী করে যে বাংলাদেশের আসলে খুব বেশী পরিমান পানি প্রবাহের দরকার নেই কারন গঙ্গায় প্রবাহিত পানির সিংহভাগই বঙ্গোপসাগরে অপচয় হয়।ভারত এই বলে নিশ্চিত করে যে ব্যারেজ নির্মানের পুর্বেই বাংলাদেশ ও ভারতের স্ব স্ব হিস্যা চুড়ান্ত করা হবে। ১৯৭২ সালে আন্তঃসীমান্ত নদীসমুহের উন্নয়নের দিককে সামনে রেখে সংযুক্ত নদী কমিশন (জ়েআরসি) প্রতিষ্ঠিত হয়।

দ্বিতীয় পর্যায় (১৯৭৪-১৯৭৬)

যেহেতু গঙ্গার পানি বন্টন নিয়ের সমস্যার উৎপত্তি তাই এই পর্যায়ে ‘গঙ্গায় পানি বৃদ্ধির’ বিষয়টি সামনে আনা হয়। বাংলাদেশ প্রস্থাব করে যে ভারত বর্ষা মৌসুমের বিপুল পরিমান পানিকে উজানের জলাধারে সঞ্চিত করে তা শুস্ক মৌসুমে ব্যাবহার করতে পারে, অন্যদিকে ভারত একটি সংযোগ খালের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র (বাংলাদেশে যমুনার উজানে মূল নদীটির নাম ব্রহ্মপুত্র) থেকে বিপুল পরিমান পানি গঙ্গায় নিয়ে আসার প্রস্তাব করে। এই পর্যায়ে গঙ্গার পানি বন্টনের সমীকরন নিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ব্যার্থ হয়। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের সাথে একটি অন্তর্বর্তীকালীন মতৈক্যের ভিত্তিতেই ব্যারেজের কার্যক্রম শুরু হয়।মতৈক্যটি কিছুটা এরকমঃ ভারত বিকল্প খাল দিয়ে ১১,০০০ থেকে ১৬,০০০ কিউসেক ( ১ কিউসেক=প্রতি সেকেন্ডে ১ ঘনফুট পানির প্রবাহ) পানি গঙ্গা থেকে অপসারন করবে আর বাকী প্রবাহ বাংলাদেশে চলে যাবে। এই পরীক্ষামুলক পানিবন্টন মাত্র ৪১ দিন স্থায়ী হয়।১৯৭৬ সালে আগের মতৈক্যের নবায়ন না করে ভারত একতরফা ভাবে গঙ্গার পানি অপসারন করে যার ভয়াবহ প্রভাব পড়ে পদ্মানদী কেন্দ্রিক বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের উপর এবং একই ঘটনার পূনরাবৃত্তি ঘটে ১৯৭৭ সালে। বাংলাদেশ বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করে এবং সাধারন পরিষদ এক্ষেত্রে একটি মতৈক্যের বিবৃতি দেয় যার ফলশ্রুতিতে বিষয়টির একটি সুষ্ঠূ সমাধানের জন্য বাংলাদেশ ও ভারত ঢাকাতে মন্ত্রীপরিষদ পর্যায়ের বৈঠকের ব্যাপারে একমত হয়।

আগামীনিউজ/প্রভাত