গণতন্ত্রহীনতা: কার লাভ কার ক্ষতি

কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২১, ০৩:৪৮ পিএম
ছবি: আগামী নিউজ

ঢাকাঃ স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ নূর হোসেনের এই স্লোগান বাংলার আপামর জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এছাড়া এর পূর্বেও বহুকাল দশকের পর দশক ধরে ‘গণতন্ত্র চাই’ এই সংগ্রাম অব্যাহত ছিল। ক্ষমতার পালা বদল হয়েছে। যারা ‘গণতন্ত্র-গণতন্ত্র’ বলে চিৎকার করেছে তারাই রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে। যারা দেশ শাসন করেছে তারা লুটেরা-ধনীক শ্রেণিরই প্রতিনিধিত্ব করেছে। এই শাসকগোষ্ঠী এতোটা দুর্বল যে বুর্জোয়া গণতন্ত্রটাও দিতে পারছে না। 

বর্তমান সময় দেখা যাচ্ছে, দেশ গণতন্ত্রহীনতার চরম শিখরে পৌঁছেছে। জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। বিনা ভোটে নির্বাচিত সরকারের অনিয়ম-দুর্নীতি-লুটপাটের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলার অধিকার নেই। গুম-খুন-হত্যা নিত্যনৈমিত্তক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংবাদপত্র বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। সভা-সমাবেশের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে।

নানা ধরনের আইন করে জনগণের তথা শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে দমন করা হচ্ছে। গণতন্ত্রহীনতার সংস্কৃতিকে আরও পাকাপোক্ত করে স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ চালাচ্ছে বর্তমান সরকার। উপজেলা ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন পর্যায়ের স্থানীয় প্রতিষ্ঠান, এমনকি বিভিন্ন পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনেও ভোটারদের অবাধ অংশগ্রহণের সুযোগ হরণ করে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের জিতিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে সরকার। ফলে দেশের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জবরদখল ব্যবস্থা। 

‘গণতন্ত্রহীনতার’ কারণে সমাজে অবক্ষয়-অস্থিরতা বেড়েছে। মানবতাবোধ-পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমছে। আস্থাহীনতা ও হতাশা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র। এই কথা স্বৈরাচার আইয়ুব-ইয়াহিয়া-এরশাদও বলেছিল। বাংলার মানুষ কখনোও এটা মেনে নেয়নি, ইতিহাস তাই বলে। গণতন্ত্রহীনতার কারণে আজ লুটেরা ধনীকগোষ্ঠী লুটপাটের মহোৎসবে মেতে উঠেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে।

খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। যত বেশি প্রকল্প ততো বেশি লুটপাট। মামলা বাণিজ্য-চাঁদাবাজি প্রণোদনার টাকা লুট দেশের বাইরে আমলাদের ঘরবাড়ি ইত্যাদি নানা ধরনের বিষয় দেশের জনগণের সামনে এসেছে। অপরদিকে, শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ যখন তার ন্যায্য মজুরি, কর্মসংস্থানের গ্যারান্টি, কৃষক তার ফসলের লাভজনক দাম, বন্ধ পাটকল ও চিনিকল খোলার দাবিতে আন্দোলন করছে, তখন উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ করছে বলে বর্তমান শাসকগোষ্ঠী নিমর্মভাবে তাদের উপর দমন-পীড়ন-নিপীড়ন চালিয়েই যাচ্ছে। 

সারাদেশে বর্তমান সরকার ভয়ের সংস্কৃতি চালু করেছে। সাধারণ মানুষ কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হলেই তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। মানুষের মধ্যে বাড়ছে প্রচণ্ড ক্ষোভ ও হতাশা। এই সুযোগ গ্রহণ করছে সাম্প্রদায়িকগোষ্ঠী। ওয়াজ-নসিয়াত করে তারা ধর্মের নামে রাজনীতিকে নিয়ে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।

সাধারণ মানুষ ক্রমান্বয়ে অদৃষ্টবাদী হয়ে উঠেছে। যার প্রভাব সমাজ ও রাষ্ট্রে পড়ছে। লুটেরা ধনীক গোষ্ঠী, গণতন্ত্রহীনতা, সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদ আজ এক হয়ে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। লুটেরা ধনীক গোষ্ঠী গণতন্ত্র হরণ করে, তাদের স্বার্থে গণতন্ত্র যখন ধ্বংস হয়, তখন সুযোগ নেয় সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং এর সাথে যুক্ত সাম্রাজ্যবাদ। তাই একটার সাথে আরেকটা সম্পর্কিত। আজ সারা বিশ্বব্যাপী আমরা দেখতে পাচ্ছি পুঁজিবাদ তার ঐতিহ্যগত ধারায় বিকশিত হচ্ছে না।

তার নয়া উদারবাদী নীতি দেশে দেশে সাধারণ মানুষের বিপক্ষে যায় তখন তারা তাদের পুঁজির স্বার্থে বিভিন্ন দেশে লুটেরা ধনীক গোষ্ঠী সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের কাঁধে ভর করে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দেয় এবং গণতন্ত্রহীনতার পরিবেশ তৈরি করে। যেমন আমরা সাম্প্রতিককালে দেখছি আমেরিকায় ট্রাম্প, ভারতে মোদীর শাসন- যেখানে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ন্যূনতম নীতিবোধ ছিল তাও ধ্বংস হয়েছে।

আমাদের দেশও এর বাইরে নয়। ধারাবাহিকভাবে শাসকগোষ্ঠী আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে। লুটপাট, দলীয়করণ, দুর্নীতি-নৈরাজ্য আজ সর্বক্ষেত্রে বিরাজ করছে। ফলশ্রুতিতে বর্তমান সরকার ফ্যাসিবাদী কায়দায় দেশ পরিচালনা করছে। কেননা বর্তমান সরকার জনগণের কাছে দায়বদ্ধ নয়। জনগণের ভোট ছাড়াই ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছে। এর বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের সংগ্রামকে জোরদার করতে হবে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার আন্দোলনকে অগ্রসর করার পাশাপাশি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। সরকারের ফ্যাসিবাদী প্রবণতা রুখতে হবে। এর জন্য বামপন্থি, গণতন্ত্রী, দেশপ্রেমিক, প্রগতিশীল শক্তিগুলোকে এক জায়গায় নিয়ে আসতে হবে।

শ্রমিক, কৃষক, ক্ষেতমজুরসহ সমাজের সুবিধা বঞ্চিত মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। শ্রেণির লড়াইকে যত তীব্রতর করা যাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ততোই অগ্রসর হবে। একটা বিষয় তো আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে- লুটেরা বুর্জোয়া শাসকশ্রেণি ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার দেবে না। গণতন্ত্রের সংগ্রামকে বাধাগ্রস্থ করার জন্য বর্তমান শাসকগোষ্ঠী কখনোও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলণ্ঠিত হলো বলে আওয়াজ তুলবে, কখনো হেফাজত বা অন্যান্য সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে আপস করবে। সমাজ ও রাষ্ট্রকে প্রতিনিয়ত অস্থিরতার মধ্যে রাখবে। এই সময়কালে অপরাপর বিরোধী বুর্জোয়া দলগুলিও কার্যকর অর্থে বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা ও জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা কাজে লাগিয়ে জনগণের সামনে আশার আলো তেমন দেখাতে পারছে না।

বামপন্থি প্রগতিশীল দলগুলো তাদের সাধ্যমত বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা এবং গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে সেটা এই মুহূর্তে সাধারণ জনগণের সামনে আস্থাভাজন শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে পারছে না। গণতন্ত্রহীনতা বজায় থাকলে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শক্তিশালী হয়, সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটে, লুটেরা ধনীকগোষ্ঠী, স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ, স্বেচ্ছাচারিতা বৃদ্ধি পায়। সামরিক-বেসামরিক আমলারা লুটপাটের মহোৎসবে মেতে উঠে। শ্রমিক কৃষক ক্ষেতমজুরসহ শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম দমন করা হয়।

সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠে। সামগ্রিকভাবে বলা যায় ফ্যাসীবাদী ধারায় দেশ পরিচালিত হয়। তাহলে কি বর্তমান সরকারের দুঃশাসন গণতন্ত্রহীনতা লুটেরা ধনীকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম গড়ে উঠবে না? নিশ্চয়ই উঠবে। এই সংগ্রাম গড়ে তোলার মুখ্য ভূমিকা নিতে হবে বামপন্থি কমিউনিস্টদের। সাহসীকতা এবং ধৈর্যের সাথে কৃষক, শ্রমিক, ক্ষেতমজুর, ছাত্র-যুবদের অধিকার আদায়ের লড়াইকে অগ্রসর করা ছাড়া আমাদের সামনে বিকল্প কোনো পথ নেই।

শ্রেণি পেশার লড়াইয়ের সাথে জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং বর্তমান সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সমান্তরালভাবে লড়াই জারি রাখতে হবে। আঘাত আসবে। হত্যা, জেল জুলুম নিপীড়ন নেমে আসবে তাকে প্রতিরোধ করতে হবে। এই চেতনায় বামপন্থি কমিউনিস্ট কর্মী সমর্থকদের সর্বদাই প্রস্তুত থাকতে হবে। কেননা মনে রাখতে হবে আমাদের দেশে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিকে যারা ধ্বংস করতে চায় তারা শক্তিশালী। তারা শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষের অধিকার খর্ব করতে চায়।

এই শত্রুদের বিরুদ্ধে বামপন্থি ও কমিউনিস্টদের লড়াই চলবে বিজয়ী না হওয়া পর্যন্ত। এ জন্য ব্যাপক শ্রমজীবী মেহনতি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নিরন্তর চালিয়ে যেতে হবে। তাহলেই বিজয় সম্ভব। তবেই শ্রমজীবী, মেহনতি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।

সহকারি সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)

আগামীনিউজ/প্রভাত