উন্নয়নের কোপটা কেন গাছের উপর?

রিপন আশরাফ জুন ৮, ২০২০, ১০:৫৫ পিএম
রিপন আশরাফ

উন্নয়নের কোপটা কেন গাছের উপর?
দেশে নানা সমস্যা।অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয় পদে পদে, দুর্নীতি, অর্থ লুটপাট ও পাচার, মাদক সমস্যা,রোহিঙ্গাদের অপরাধে ইউটিলাইজ করা, মানবপাচার,সরকারী অর্থব্যয়ে বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নিতি, করোনাকালেও প্রনোদনায় ও ত্রান রিলিফে লাগামহীন সিন্ডিকেট দুর্নীতি অনিয়ম, ব্যাংক খাতের নৈরাজ্য, ভোক্তাদের ভূলুণ্ঠিত অধিকার হরনে ভিআইপি মদদ সহ এই ফিরিস্তি লিখে শেষ হবেনা। কিন্তু তবুও আন্তর্জাতিক কোনো সূচকে বাংলাদেশকে খারাপ করতে দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়।

দেশের ভেতরে রাজনীতি নিয়ে যতই কামড়াকামড়ি করি না কেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ মানে আমাদের সবার। আন্তর্জাতিক সূচক প্রশ্নে আওয়ামী লীগ-বিএনপির ঊর্ধ্বে থাকে বাংলাদেশ। তাই আন্তর্জাতিক কোনো সূচকে অল্প অর্জনেও তৃপ্তি থাকে অনেক, আবার কোনো খারাপ খবরে মন খারাপ হয় অনেক বেশি। ঢাকার বাতাসের মান যে খারাপ এবং দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছে তা প্রতি নিঃশ্বাসে টের পায় নগরবাসী। প্রতিদিন সবুজ কমছে, বাড়ছে দালান-কোঠা, গাড়ি; বাড়ছে ধুলা আর দূষণ । যেকোনো উন্নয়নমূলক কাজে রাস্তাঘাট, কলকারখানা নির্মাণের জন্য প্রকৃতি ও পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কতটা?

এখানে একটা সীমার কথা বলেছেন লেনিন এবং তাঁর আগে মার্ক্স অ্যাঙ্গেলস। প্রকৃতির দ্বন্দ্ববাদ শীর্ষক গ্রন্থে ফ্রেডরিক অ্যাঙ্গেলস বলছেন,‘প্রকৃতির ওপর আমাদের বিজয় নিয়ে নিজেদের গর্বিত ভাবার দরকার নেই। কারণ, প্রতিটি বিজয়ের পর প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয়। প্রথম
দফায় আশানুরূপ ফল পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় ফলাফলটা হয় অন্য রকম, যা প্রায়ই প্রথম ফলকে বাতিল করতে পারে।’উন্নয়নের কিছু সূচকে বাংলাদেশ খারাপ করেছে শুনলে মন খারাপ করি। আবার কোন সুচকে দেশ ভালো করলে আনন্দ পাই। কিন্তু পরিবেশ রক্ষা সূচকে বাংলাদেশ ১৮০ টি দেশের মধ্যে নিচের দিকে এখন দ্বিতীয় । এমন সর্বনাশা খবরে আমি অবাক
হইনি। জানা বুঝা তাই মন খারাপ করিনি। পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশ যে খারাপ ও ঝুঁকিপূর্ণ এটা বোঝার জন্য বিশাল জরিপ করতে হয় না। চারপাশে তাকালেই টের পাই। সম্প্রতি প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেকক্স (ইপিআই) ২০১৮’ শীর্ষক যৌথ গবেষণায় ১০টি বিষয়কে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। বিষয়গুলো হলো: বায়ুরমান, পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন, ক্ষতিকর ভারী ধাতু, জীববৈচিত্র্য ও বাসস্থান, বনায়ন, মৎস্য সম্পদ, জলবায়ু ও জ্বালানি, বায়ুদূষণ, পানিসম্পদ এবং কৃষি। ২০১৯ এর তালিকায় পরিবেশ রক্ষার বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের গড় স্কোর ২৯ দশমিক ৫৫। ২০১৬ সালের
তালিকায় বাংলাদেশের গড় স্কোর ছিল ৪১ দশমিক ৭৬। মানে হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ আকারে নীচে নামছি আমরা। ২০১৪ সালের তালিকায় ১৭৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৯। তারমানে পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশের পারফরম্যান্স প্রতিবছরই খারাপ হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষায় যে আমাদের নজর নেই, তা বোঝাতে খুব বেশিদূর যেতে হবে না।

২ বছর আগে যশোর রোড সম্প্রসারণে বেশকিছু শতবর্ষীসহ অন্তত আড়াই হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিছু ব্যয় বাড়বে এই অজুহাতে এই গাছ কাটার নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। পরিবেশবাদীদের তুমুল প্রতিবাদ আর শেষ পর্যন্ত আদালতের হস্তক্ষেপে আপাতত রক্ষা পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত যশোর রোড। আমরা যখন যশোর রোড নিয়ে ব্যস্ত, তখন দেশের অন্তত দুটি জায়গায় গাছ কাটা সারা হয়ে গেছে সবার চোখের আড়ালে। সাভার-মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের উন্নয়নের জন্য প্রায় চার হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। কুমিল্লা একসময় ছিল পানির জলাধারের শহর। বড় জলাধারগুলোও আস্তে আস্তে মরে যাচ্ছে বা ভরাট হয়ে যাচ্ছে। সেই সবুজের দেখা পাইনা । শহরের সার্কিট হাউস চত্বরে অল্পকিছু গাছ বিশালাকার গাছ ছিল। বছর কয়েক আগে সার্কিট হাউস চত্বরের সেই গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে খালি মাত্র উন্নয়নের কারনে।উন্নয়নের কারনে কি করে বলি , বলতে হবে উন্নয়নের অঝুহাতে।কারন উন্নয়ন মানে গাছের উপর চড়াও হওয়া বুঝায় না। কুমিল্লার সার্কিট হাউস ভেঙ্গে বহুতল ভবন করা হয়েছে।এদিকে ঢাকা হতে ময়মনসিংহের দিকে গেলে দুইপাশের হতশ্রী কেটে ন্যাড়া করা গজারি বনের অপমৃত্যুর দৃশ্য ।গত ১০ বছরে শিল্প গোষ্ঠী আর বনের বিট কর্তারা মিলে বিশাল ভাওয়াল বন উজাড় করেছে সীমাহীন বেপরোয়া গতিতে। এরুপ কত ভাওয়াল গজারি বন বা কুমিল্লা কাহিনী অতিক্রম হয়ে গেছে একটা আরেকটাকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে তার সব হিসাব আমাদের দুই চোখে কি ধারন করা যায়!উন্নয়ন বিরোধী মানুষ নই কেউ। কিন্তু উন্নয়ন করতে প্রথমেই গাছের উপর
দৃষ্টি যায় কেন?কোপটা গাছের ওপর দিতে হবে কেন? গাছেরা মিছিল করতে পারেনা তাই?

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে অনেক রাজনীতি হয়েছে, জল ঘোলা হয়েছে। সুন্দরবন ঝুঁকির মুখে এই যুক্তিতে পরিবেশবাদীরা অনেক দিন ধরেই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরোধিতা করে আসছেন। কিন্তু সকল কান্না, প্রতিবাদ হারিয়ে গেছে । কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মুনাফা যেখানে একমাত্র আরাধ্য দেবতা, সেখানে পরিবেশের প্রশ্নটি অত গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমরা দেখছি, সুন্দরবনের গা ঘেঁষে রামপালে যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণে ‘সরকারের নজর বনের জমিতে’ শিরোনামে প্রথম আলো সহ বিভিন্ন পত্রিকার রিপোর্টের সুত্রে বলা ; বন বিভাগ এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ ৭০ হাজার ৭৬৩ দশমিক ৬২ একর বনভূমি বরাদ্দ দিয়েছে। এক বছরের মধ্যে নতুন করে আরও ১৯ হাজার একর বনভূমি চেয়ে মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য ৪ হাজার ৮৩৫ একর বনভূমিতে আশ্রয়শিবির গড়ে তোলা হয়েছে।’ যে দেশের সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ কিন্তু সরকার সাংবিধানিক এই বাধ্যবাধকতা প্রতিপালন তো করছেই না, বরং করছে উল্টোটা। উন্নয়নের নামে বনভূমি সাবাড় করা হচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা- এসডিজি পূরণে বনভূমির পরিমাণ দেশের মোট ভূখন্ডের ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করতে হবে।

কিন্তু উল্টোপথে হাটছি আমরা।
এই যে সেদিনের আমফানে সুন্দরবন বুক চিতিয়ে যেভাবে দেশকে বাচাল না হলে ঢাকাও ঝড়ে ফাকা হয়ে যেত। আমাদের শিক্ষা হয়নি সিডর আইলাতেও । শুধু উন্নয়নের নামে গাছের উপর কোপ, পাহাড়ের উপর কোপ এসব বন্ধ না হলে দুর্যোগ যে ভাবে বারছে তাতে অনেক ক্ষতির বিমিময়ে চড়া মুল্য দেবার সময় খুব আসন্ন। যেভাবে দেশজুড়ে গাছ কেটে সাবাড় করা হচ্ছে, উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বনভূমি বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে তাতে দুইবছর পর পরিবেশ রক্ষা সূচকে ইনশাল্লাহ আমরা নিচ দিক থেকে প্রথম হতে পারবো আশা করি। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, উন্নয়নের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা বুঝি পরিবেশ। পরিবেশের কথা বললেই কিছু মানুষ প্রশ্ন করে, আপনি কি উন্নয়ন চান না? অবশ্যই চাই। উন্নয়ন যেমন চাই, চাই পরিবেশ সংরক্ষণও। একটা ছাড়া আরেকটি টেকসই হয় না। টেকসই উন্নয়নের জন্য চাই পরিবেশসম্মত উন্নয়ন। টেকসই উন্নয়ন যে পরিবেশকে সাথে নিয়ে সমন্বিত উন্নয়ন একথা অনেক আতেল বুঝতে চায়না। এই মুহূর্তে এই সত্য না বুঝলে অনেক দেরী হয়ে যাবে। দেরী হোয়ে গেলে তখন পরিবেশের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে । দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই এই বিষয়টি বোঝা দরকার। কারণ একবার গাছ কেটেফেললে আবার আগের অবস্থায় যেতে অনেক সময় লাগবে। তাই গাছ কাটার আগে, বন বরাদ্দ দেয়ার আগে সবগুলো বিকল্প চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে।

আগামীনিউজ/জেএস