সিডনির বুকে সবুজ বাংলাদেশ গড়লো রামিন’স ফার্ম

আগামীনিউজ ডেস্ক মার্চ ৮, ২০২০, ০৯:৫৫ এএম

শৈশবের একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আমি বেড়ে উঠেছিলাম এমন একটি গ্রামে, যেখানে বিদ্যুৎ বা টেলিভিশন ছিলো না। তাই প্রত্যেকটা দিন ছিল প্রকৃতির সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। প্রত্যেক দিন সকালে উঠেই বাড়ির বড়দের সাথে ক্ষেতে চলে যেতাম। তারপর সারাদিন ক্ষেতে কাটিয়ে আবার বাড়িতে ফিরে আসতাম।

মাটির প্রকার অনুযায়ী বিভিন্ন ক্ষেতে বিভিন্ন রকমের সবজি আবাদ করা হতো। কোনটাতে উচ্ছে বা পটল বা মরিচ আবার কোনটাতে বাঙ্গি বা তরমুজ বা ধুন্দল। প্রত্যেকটা ক্ষেতই ছিল আলাদাভাবে সুন্দর। বীজ থেকে ছোট গাছ তারপর একসময় ফুল সেখান থেকে ফল। বাংগির ক্ষেতে বাংগি পাকা শুরু করলে অনেক দূর থেকেও সেই ঘ্রাণ পাওয়া যেতো। আর পটলের গাছ হতো পটলের শাখা থেকে। সেটা হাট থেকে কিনে নিয়ে এসে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করে মাটিতে লাগানো হতো।

এই প্রত্যেকটা ব্যাপারই ছিলো আমাদের সাদামাটা শৈশবে উত্তেজনার উপকরণ। আর মাঝেমধ্যে আমি নিজে ক্ষেত পাহারা দেয়া লোকেদের সাথে কুড়ের মধ্যে থাকার বায়না ধরতাম। সেটা ছিল একটা অন্যন্য অভিজ্ঞতা। কুড়ের মধ্যে শুয়ে রুপ কথার গল্প শুনতে শুনতে আর তারা গুণতে গুণতে একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতাম। এরপর একসময় শহরতলিতে বসবাস শুরু করলেও সেইসব স্মৃতি মস্তিষ্ক খুব সযতনে তুলে রেখেছিলো।

তাই যখন নিজে সন্তানের পিতা হলাম তখন স্বাভাবিকভাবেই মাথার মধ্যে এমন একটা চিন্তা কাজ করছিলো যে, ওদেরকেও আমার শৈশবের কিঞ্চিৎ হলে সেই ছোঁয়া দিয়ে বড় করবো। কিন্তু অস্ট্রেলিয়াতে এই ক্ষেত আমি কোথায় পাবো।

আমি যে ক্ষেতের সন্ধান করছি এটা আমার পরিচিত সবাই জানতো। এমনই একজন পরিচিত মানুষ রামিন ফার্মের সন্ধান দিলেন। গিন্নিকে বলার সাথে সাথেই উনি রাজি হয়ে গেলেন। বললেন ভালোই হবে কিছু তরতাজা শাক সবজি কিনে আনা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। এক শনিবার সকালে তাহিয়া আর রায়ানকে নিয়ে রামিন’স ফার্মে হাজির হলাম। তাহিয়া আর রায়ান খোলা জায়গা পেলেই খুশি হয় তার ওপর এখানে ভাগ ভাগ করে বিভিন্ন প্লটের মধ্যে বিভিন্ন শস্য দেখে খুশিতে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিলো। আমি পরিচিত হলাম রামিন’স ফার্মের স্বত্তাধীকারি হারুন ভাইয়ের সাথে।

এই প্রত্যেকটা ব্যাপারই ছিলো আমাদের সাদামাটা শৈশবে উত্তেজনার উপকরণ। আর মাঝেমধ্যে আমি নিজে ক্ষেত পাহারা দেওয়া লোকেদের সাথে কুড়ের মধ্যে থাকার বায়না ধরতাম। সেটা ছিল একটা অন্যন্য অভিজ্ঞতা। কুড়ের মধ্যে শুয়ে রুপ কথার গল্প শুনতে শুনতে আর তারা গুণতে গুণতে একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতাম। এরপর একসময় শহরতলিতে বসবাস শুরু করলেও সেইসব স্মৃতি মস্তিষ্ক খুব সযতনে তুলে রেখেছিলো।

অবার্ন থেকে লেপিংটনে যেতে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ড্রাইভ করতে হয় তবুও উনি হার মানার পাত্র নন। ইতোমধ্যেই উনি পাশে পেয়েছেন আরও কিছু বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী যারা বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন যেমন একবার দেশে উনার বাবা অসুস্থ হলে উনাকে বেশ কিছুদিনের জন্য দেশে যেতে হয়েছিল, তখন তারা ক্ষেতে পানি দেয়ার কাজটা করে দিয়েছিল।

রামিন’স ফার্মের জায়গাটা আমাদের পরিবারের সকলেরই খুবই পছন্দ হয়ে গেলো আর সেই সাথে হারুন ভাইয়ের মিষ্টি ব্যবহার। সবমিলিয়ে রামিন’স ফার্মে গেলেই আমাদের মনটা ভালো হয়ে যায়। আমি ক্ষেতের প্রত্যেকটা প্লট দেখি আর নিজের শৈশবে হারিয়ে যায়। রামিন’স ফার্মের মাঝ বরাবর একটা পায়ে হাটার রাস্তা তার দুপাশে বিভিন্ন সব্জির প্লট। সেখানে কাচা মরিচ, লাল শাক, পুই শাক, কচুর শাক, উচ্ছে, বেগুন, ধুন্দল, চিচিংগা, মিষ্টি কুমড়া, টমেটো, বাংগি আর আছে লাউয়ের মাচা। লাউয়ের কথা আলাদাভাবে বলতে হবে কারণ সিডনির প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে উনার ক্ষেতের লাউ এখন একটা অবশ্যম্ভাবী সবজি।

দু’পাশের ক্ষেত পার হয়ে একদম শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলে সেখানে রয়েছে একটা খাল। সেই খালে সারাবছরই কম বেশি পানি প্রবাহ থাকে। সেই খালেই আমি সিডনিতে প্রথম বারের মতো ক্ষুদে পানা দেখতে পেলাম আর হোগলার বন। সেখান থেকেই সেচের বেশিরভাগ পানির যোগান আসে বলে হারুন ভাই জানালেন।

রামিন’স ফার্মে গেলে সবচেয়ে খুশি হয় রায়ান। কারণ সেখানে অবিরত সেচ দেয়ার ফলে মাটি থাকে নরম। সেই নরম মাটিতে হেটে বেড়ানো রায়ানের সবচেয়ে পছন্দের একটি কাজ। একটু পরেই রায়ানের জুতা মাটিতে ভারি হয়ে যায় তখন সেটা খুলে দিলে সে আরো খুশি মনে কাদার মধ্যে হাটা শুরু করে। রায়ানের কর্মকাণ্ড দেখে আমি হারুন ভাইকে বলেছি উনি যেন রায়ানকে উনার ক্ষেতে নিয়োগ দিয়ে দেন। তার বিনিময়ে আমাকে কোনো টাকা পয়সা দিতে হবে না। শুধু ওকে তিনবেলা খেতে দিলেই হবে তাও অন্ততপক্ষে ওর জ্বালাতন থেকে আমরা রেহাই পাবো। হারুন ভাই বলেন, আমার ছোট ছেলেটাও রায়ানের বয়সী। নাম রাকিন। সেও ঠিক একইরকম দুষ্টু। অবশ্য উনার বড় ছেলে যার নামে এই ফার্মের নামকরণ সে কিছুটা শান্ত। আর সবার ছোট মেয়ে আইজা বেশ শান্ত স্বভাবের। রামিন, রাকিন সুযোগ পেলেই হারুন ভাইয়ের সাথে ক্ষেতে চলে এসে বাবার সাথে কাজে লেগে যায়।

তাহিয়াও খুশি হয় কারণ সে আমার সাথে মাঝেমধ্যে ক্ষেতে নামে লাল শাক, পুঁই শাক তুলতে। আমি কেটে দেই আর ও সেটা ওর হাতে ধরা পলিথিনে রাখে। এছাড়াও আমি গ্রামের ছেলে বলে ক্ষেতের মধ্যে আগাছা হিসেবে হওয়া আরো কিছু শাক আবিষ্কার করেছি। যেমন বৈথার শাক, নোনতা শাক ইত্যাদি।

রামিন’স ফার্ম নিয়ে আমাদের উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। শনিবার এলেই তাহিয়া জিজ্ঞেস করতে থাকে আমরা আজ রামিন’স ফার্মে যাবো কিনা। এর অন্যতম কারণ, রামিন’স ফার্ম সাধারণত শনিবার সকালের সময়টা খোলা থাকে। আপনিও যদি তরতাজা সবজি একেবারে ক্ষেত থেকে সঠিক দামে পেতে চান তাহলে চলে যান লেপিংটনের রামিন’স ফার্মে। রামিন’স ফার্মে যেয়ে আমি বেশ কিছু মানুষের সাথে পরিচত হয়েছি যারা আমাদের মা-বাবার বয়সী। উনারা এসেই ক্ষেতের মধ্যে বসে পড়েন ধুলো ময়লার পরোয়া না করে। দৃশ্যটার মধ্যে এমন একটা অকৃত্রিমতা আছে যে আমি আর চোখ ফেরাতে পারি না।

তবে রামিন’স ফার্মে গেলে ক্ষেতে ঢোকার আগে হারুন ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে নেয়া ভালো কারণ ক্ষেতের মধ্যে আমি বিছুটি গাছ দেখেছি যেটা আপনার গায়ে লাগলে ভয়ংকর চুলকানি শুরু হবে। আর হারুন ভাই বললেন উনি একদিন একটা বড় সাপও দেখেছেন।

আগামীনিউজ/ডেস্ক