ঢাকাঃ প্রথম যে কোনো কিছুই আনন্দের। ক্রিকেট পাগল একটি জাতির জন্য প্রথম টেস্ট জয় বিশেষ কিছু। আর এই জয়ের জন্য যদি অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘসময়, তবে সেই আনন্দের সীমা যেন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। টাইগার ক্রিকেটে এমনই এক মুহূর্ত এসেছিল ঠিক ১৫ বছর আগের এক দুপুরে। ২০০৫ সালের ১০ জানুয়ারি জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো টেস্ট জয়ের স্বাদ পেয়েছিল বাংলাদেশ।
এ ম্যাচের শুরু থেকেই বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মনোভাব ছিল জিততেই হবে। কয়েক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে প্রথম টেস্ট জয়ের সময় বাংলাদেশের অধিনায়কত্ব করা হাবিবুল বাশার বলেছিলেন, ‘জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ শুরু হওয়ার আগে টিম মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, জয়ের জন্যই খেলব আমরা। তখনো আমাদের টেস্ট ম্যাচের পরিসংখ্যানে জয়ের ঘরে ‘শূন্য’ লেখা। খুব খারাপ লাগত দেখে। পরিকল্পনা ছিল, ঘরের মাটিতেই শূন্য মুছে ফেলতে চাই।’
এ ম্যাচে টস জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিতে দু’বার ভাবেননি বাশার। ব্যাট হাতে আশানুরূপ শুরু পায় বাংলাদেশ। উদ্বোধনী জুটিতে ৯১ রান যোগ করেন জাভেদ ওমর বেলিম ও নাফিস ইকবাল। এ ম্যাচে কোনো টাইগার ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরি না পেলেও ছিল হাফ সেঞ্চুরির ছড়াছড়ি। ব্যাটিং অর্ডারের ক্রমানুসারে অর্ধশতক পেয়েছিলেন নাফিস ইকবাল (৫৬), হাবিবুল বাশার (৯৪), রাজিন সালেহ (৮৯) ও মোহাম্মদ রফিক (৬৯)। অল্পের জন্য হাফ সেঞ্চুরির দেখা পাননি খালেদ মাসুদ (৪৯) ও মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা (৪৮)। সবার সম্মিলিত পারফরম্যান্সে প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ অলআউট হয় ৪৮৮ রানে। ১৪৯.৩ ওভার ব্যাট করা এ ইনিংসই ছিল সেসময় বাংলাদেশের দলীয় সর্বোচ্চ।
নিজেদের প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে উজ্জীবিত বাংলাদেশের সামনে দিশেহারা হয়ে পড়ে জিম্বাবুয়ে। মাশরাফীর পেস আক্রমণের পর মোহাম্মদ রফিকের ঘুর্ণি জাদুতে ১৫২ রানেই ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলে তারা। ফলো অনের শঙ্কায় পড়লেও অধিনায়ক তাতেন্দা তাইবুর ৯২ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংসে ভর করে ৩১২ রানে থামে জিম্বাবুয়ে। রফিক পাঁচটি ও মাশরাফী তিনটি উইকেট নেন।
দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে শুরু থেকেই উইকেট হারাতে থাকে বাংলাদেশ। মিস্টার ফিফটি খ্যাত হাবিবুল বাশার আবারো দলের ভরসার প্রতীক হয়ে খেলেন ৫৫ রানের ইনিংস। প্রথম ইনিংসের ওপেনার জাভেদ ওমর পায়ে ব্যথার ফলে সাত নম্বরে ব্যাট করতে নামেন। ওভারপ্রতি ৩.৯৮ গড়ে রান করতে থাকা বাংলাদেশ ইনিংস ঘোষণা করে ৯ উইকেটে ২০৪ রানে। ম্যাচ জিততে জিম্বাবুয়ের লক্ষ্য দাঁড়ায় ৩৮১ রান।
ম্যাচের চতুর্থদিন ব্যাট করতে নামা জিম্বাবুয়ে শিবিরে শুরুতেই জোড়া আঘাত হানেন তাপস বৈশ্য। চার ওভার না যেতেই ২ রানে ২ উইকেট হারিয়ে পুরোপুরি চাপে পড়ে যায় জিম্বাবুয়ে। এই চাপ থেকে আর বেরোতে পারেনি সফরকারীরা। শেষদিনের মঞ্চ নিজের করে নেন প্রথম টেস্ট জয়ের ম্যান অব দ্য ম্যাচ এনামুল হক জুনিয়র। প্রথম ইনিংসে কোনো উইকেট না পেলেও শেষদিন একাই ছয় উইকেট শিকার করেন তিনি। তার ঘুর্ণিজাদুতে দিশেহারা হয়ে জিম্বাবুয়ের কেউই ব্যাট হাতে দাঁড়াতে পারেনি। মাত্র ১৫৪ রানে অলআউট হয় তারা। বাংলাদেশ পায় ২২৬ রানের বিশাল জয়।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে কাঙ্ক্ষিত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসে দুপুর ১২টা ৫৩ মিনিটে। চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে এনামুলের বল জিম্বাবুয়ের ক্রিস্টোফার এমপোফুর ব্যাটে লাগার পর সিলি পয়েন্টে ক্যাচ ধরেন মোহাম্মদ আশরাফুল। সঙ্গে সঙ্গে দৌড় দেন আশরাফুল, দৌড় দেন সতীর্থরাও। এমএ আজিজ স্টেডিয়াম ছাড়িয়ে উৎসবের রঙিন আনন্দে মেতে ওঠে পুরো দেশ। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর প্রথম এই জয় পেতে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছে পাঁচ বছর দুই মাস! ৩১টি পরাজয়, ৩টি ড্র আর অপেক্ষার দীর্ঘসময় পার করে আরাধ্য জয় পায় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ এমন একটা সময়ে এ জয় পেয়েছিল যখন একটা জয় মানেই অনেক বড় ব্যাপার ছিল ক্রিকেটারদের কাছে, দর্শকদের কাছে। এই সিরিজের আগে বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেকে। স্মরণীয় এই জয়ে সমালোচকদের মুখটাও বন্ধ করতে সক্ষম হন ক্রিকেটাররা।
টেস্টে ক্রিকেটের পিচ্ছিল আঙিনায় বাংলাদেশ এরপর খেলে ফেলেছে আরো অনেক ম্যাচ। সময়ের পরিক্রমায় শুরু স্ট্যাটাস পাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১১৭টি টেস্ট খেলেছে বাংলাদেশ। ১৩ জয়ের বিপরীতে হারের মুখ দেখেছে ৮৮ বার! এই তথ্যই তুলে ধরে এখনো ক্রিকেটের কুলীন ফরম্যাটে বাংলাদেশের সংগ্রাম চলছেই।
হোঁচট খেতে খেতেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স বিবেচনায় বাংলাদেশের উন্নতি আশাব্যঞ্জক। হয়তো ভবিষ্যতে আরো অনেক স্মরণীয় জয় আসবে দেশের ক্রিকেটে। কিন্তু প্রথম টেস্ট জয়ের এ স্মৃতি সবার মনের মণিকোঠায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে আজীবন।
আগামীনিউজ/নাসির