অনলাইনে চাকরির বিজ্ঞাপন, ঠকছে মানুষ

আল-ইমরান জানুয়ারি ২২, ২০২০, ০৩:৫৯ পিএম
প্রতিকি ছবি

আল-ইমরান : বাংলাদেশে শিক্ষিতের হার বাড়ছে। কিন্ত সেই হারে কর্মসংস্থান না বাড়ার কারণে চাকরি যেন সোনার হরিণ। শিক্ষিত বেকাররা চাকরির খবর পাওয়া মাত্র হন্যে হয়ে ছুটছে। আর এ সুযোগে একশ্রেণির প্রতারক চাকরি নামে অনলাইনে প্রতারণার পসরা সাজিয়ে ওত পেতে আছে। অনেকেই এদের ফাঁদে পা দিয়ে ‘সোনার হরিণ’ পাওয়ার আশায় ভিটেমাটি বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে এই প্রতারক চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনলেও থামানো যাচ্ছে না এদের দৌরাত্ম্য।

 

অনলাইনে বিজ্ঞাপন দেখে প্রতারণার শিকার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোস্তাফিজার রহমান বলেন, পরিবারের আর্থিক অবস্থা তেমন একটা সচ্ছল ছিল না। তবুও গ্রাম থেকে রাজধানীতে এসে যখন ভর্তি হই, চেষ্টা ছিল নিজের পকেট খরচ চালানোর জন্য কিছু একটা করার। এর মধ্যে পার্টটাইম চাকরি খুঁজতে লাগলাম। এজন্য অনেকে আশ্বাস দিলেও আর চাকরি হলো না। অবশেষে ফেসবুকের মাধ্যমে একদিন বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল। সেখানে দেখি সপ্তাহে তিন দিন ও দিনে চার ঘণ্টা কাজে ১০ হাজার টাকা। সঙ্গে ৫ হাজার টাকা জামানত দিলেই চাকরি। ৫ হাজার টাকাসহ উত্তরায় এক রেস্টুরেন্টে বসে তারা চাকরিটা কনফার্ম করে। সাত দিন পর কাজে যোগ দিতে হবে উত্তরাতেই কিন্তু সাত দিন পর আমি আর তাদের ট্রেস করতে পারিনি।

রংপুর জেলার পীরগঞ্জের মিলন নামে একজন বলেন, ফেসবুকে চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে আবেদন করি। এরপর নিয়োগের জন্য ১২ হাজার টাকা দিই। ওদের শর্ত পূরণ করতে আমার সহকারী হিসেবে দুজনকে নিয়োগ দেয়ার কথা বলে আরো ৬ হাজার টাকা দিই। কিন্ত নিয়োগপত্র থাকলেও চাকরিতে যোগ দিতে পারিনি।

এমন প্রতারণার খবর প্রতিদিন দেশের আনাচে-কানাচে ঘটছে। কয়েক দিন আগে এমনি এক প্রতারক চক্রের সন্ধান পায় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন(র‌্যাব)। গাজীপুরের কাশিমপুর এলাকায় ‘মেটলাইফ লিমিটেড’ নামক কোম্পানিতে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিয়ে শিক্ষিত বেকার ও নিরীহ যুবকদের চাকরি দেয়ার কথা বলে প্রতারক চক্রটি। সেই সঙ্গে বেশি বেতনে চাকরি দেয়া ও থাকা-খাওয়া ফ্রি বলে নগদ টাকা জামানত হিসেবে হাতিয়ে নেয়। কয়েক দিন পরই ভুক্তভোগীরা বুঝতে পারতেন- তারা প্রতারক চক্রের কবলে পড়েছেন। পরে র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা জানায়, শিক্ষিত বেকার ও নিরীহ যুবকদের চাকরি দেয়ার কথা বলে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে প্রায় ১৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

শুধু ‘মেট লাইফ’ নয়, এমন হাজারো প্রতারক চক্র ভুয়া প্রতিষ্ঠান বানিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। আর এরা মূলত ব্যাংক, বীমা, এমএলএম কোম্পানি, বিপণন কোম্পানি, মার্কেটিং কোম্পানির নামে বেশি প্রতারণা করে। এরা আগে রাজধানীর বিভিন্ন বাসে, জনসমাগম হয় এমন স্থানে চাকরির আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দিত কিন্ত এখন তারা ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম এবং বিভিন্ন অনলাইন অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে বেকার লোকদের প্রভাবিত করে। অনেক সময় বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের টার্গেট করে। তাদের পার্টটাইম চাকরি দেয়ার নামে প্রতারণার ফাঁদে ফেলা হয়। নিয়োগের নামে তাদের কাছ থেকে জামানত বা অন্যান্য খাতের অর্থ নিয়ে সটকে পড়ে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এ ক্ষেত্রে বেকারদের সতর্ক থাকতে হবে এবং নিজেদের চাকরির বাজারে দক্ষতা অর্জন করতে হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জরিপ অনুযায়ী, দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৮০ হাজার, যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ২৬ লাখ। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী কর্মরত মোট জনগোষ্ঠী (শ্রমশক্তি) ৫ কোটি ৮০ লাখ। এর বড় অংশ প্রায় ৫ কোটিই হকার, ফেরিওয়ালা, গৃহকর্মী, গাড়িচালকসহ বিভিন্ন অনানুষ্ঠানিক খাতের।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার(আইএলও) তথ্যমতে, তাদেরই বেকার ধরা হয় যারা সপ্তাহে এক ঘণ্টার কাজের বিনিময়ে মজুরি পান না। সংস্থাটির ‘ওয়ার্ল্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে কম বেকার ছিল বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০১০ সালে। তখন বেকার ছিল ২০ লাখ। ২০১২ ও ২০১৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ২৪ ও ২৮ লাখ। সংস্থাটির দাবি, বাংলাদেশে যে হারে বেকার বাড়ছে বর্তমানে তা প্রায় ৩০ লাখে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দেশে বাস্তবে বেকারের সংখ্যা আরো বেশি।

অনলাইনে চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রতারিত হওয়ার মূল কারণ মূলত দেশে চাকরি প্রার্থীর সংখ্যা বেশি আর কর্মসংস্থানের সুযোগ কম। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিক্ষিত বেকারের হার দেশের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। চাকরি পাওয়ার জন্য যে ধরনের দক্ষতা ও যোগ্যতা দরকার, সে ধরনের শিক্ষা সবাই পাচ্ছে না। এছাড়া বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। মানসম্মত শিক্ষা আর দক্ষ লোকের অভাব। যে কারণে কোথাও কোনো সুযোগ সৃষ্টি হলে সে তথ্য যাচাই না করে হুমড়ি খেয়ে পড়ে শিক্ষিত তরুণরা। এজন্য প্রতারকরা সহজেই প্রতারণার সুযোগ পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এ খাতে বিনিয়োগ আরো বাড়াতে হবে। মানবসম্পদ উন্নয়নে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উচ্চশিক্ষার কারিকুলাম নির্ধারণ করতে হবে। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে।

চাকরির দেয়ার কথা বলে যে প্রতারণা হচ্ছে তা কীভাবে ঠেকানো যায় জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জিয়া রহমান আগামীনিউজ ডটকমকে বলেন, বিশ্বায়নের যুগে এ থেকে পরিত্রাণ পেতে সতর্কতা ও সচেতনতার বিকল্প নেই। আর নিজেকে দক্ষ হিসেবে প্রস্তুত করতে পারলে এমন প্রতারকের কবলে পড়ার সুযোগ নেই।

গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন মনে করেন, দেশের শ্রমশক্তির তুলনায় চাকরির বাজার ছোট। প্রতি বছর হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে। কিন্তু মান নেই। প্রবৃদ্ধি হচ্ছে বিনিয়োগবিহীন। এ খাতে বিনিয়োগ না বাড়লে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে না।

অনলাইনে প্রতারণার বিষয়ে জানতে চাইলে সিটিটিসির ‘সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের’ অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) নাজমুল ইসলাম আগামীনিউজকে বলেন, গত দুই তিন বছরে আমরা কয়েকটা অনলাইন প্রতারণার মামলা নিয়েছি এবং মামলার আসামীদের গ্রেফতারও করা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, সবকিছুই আমাদের নজরদারিতে নাও থাকতে পারে। তবে কেউ যদি আমাদের জানায় যে সে প্রতারণার কবলে পড়েছে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিব। আমরা সর্বদা একটিভ আছি।

আগামীনিউজ/শাই/এনএনআর/আরআর