করোনা সনদ প্রতারণাচক্রের কবলে বিদেশগামীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক অক্টোবর ২৫, ২০২১, ১১:৩৯ পিএম
প্রতিকি ছবি

চট্টগ্রামঃ কভিড-১৯ পরীক্ষার সনদ বিদেশগামীদের জন্য বাধ্যতামূলক। এই সনদ তাদের কাছে অমূল্য। বিশ্বের যেকোনো দেশে যাওয়ার জন্যই এখন কভিড-১৯ পরীক্ষার সনদ প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশ থেকে বিদেশগামী যাত্রীদের কভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য সরকারি-বেসরকারি শতাধিক হাসপাতাল ও ল্যাব নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। কেবল অনুমোদিত এসব হাসপাতাল ও ল্যাবের সনদই বিদেশ যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা যায়। অভিযোগ উঠেছে, এসব ল্যাব ও হাসপাতালে পরীক্ষার জন্য যাত্রীদের দেয়া তথ্য পাচার হয়ে যাচ্ছে। এসব তথ্য ব্যবহার করে ভয়-ভীতি দেখিয়ে একটি চক্র বড় অংকের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। চট্টগ্রামে সম্প্রতি এমন কয়েকটি ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল ও ল্যাবগুলো। 

সম্প্রতি চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি কভিড-১৯ স্ক্রিনিং সেন্টারে চাঞ্চল্যকর প্রতারণার চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। জানা যায়, ১৯ অক্টোবর চট্টগ্রামের বেসরকারি শেভরন কভিড-১৯ স্ক্রিনিং সেন্টারে দুবাই যাওয়ার জন্য করোনা পরীক্ষার নমুনা দেন রাঙ্গুনিয়া উপজেলার নিপুল দাশ। সেদিন বিকালে একটি সেলফোন নম্বর থেকে নিপুল দাশকে টেলিফোন করা হয়। ফোনটি শেভরন ল্যাব থেকে করা হয়েছে দাবি করে বলা হয়, নিপুল দাশের কভিড পজিটিভ ফলাফল এসেছে। তবে তিনি যদি নেগেটিভ ফলাফলের সনদ চান, তাহলে দ্রুত বিকাশের মাধ্যমে ৪ হাজার ৮০০ টাকা পরিশোধ করতে হবে। তবে নিপুল দাশ অর্থ পরিশোধে অস্বীকৃতি জানালে ফোনের লাইনটি কেটে দেয়া হয়। রাতেই তিনি শেভরন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তার রিপোর্ট পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে জানা যায়, তিনি কভিড-১৯ পজিটিভ নন। তার সেলফোনেও এ-সংক্রান্ত বার্তা পাঠানো হয়।

ঠিক একই ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হন  রাউজান উপজেলার অজয় শীল। তাকেও কভিড-১৯ পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ করে দেয়ার জন্য একটি মোবাইল নম্বর থেকে যোগাযোগ করা হয়। তাঁর কাছেও দাবি করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা। এভাবে বিদেশগামী যাত্রীদের সেলফোনে যোগাযোগ করে কভিড পরীক্ষার ফল নেগেটিভ করার প্রলোভন দেখিয়ে একটি চক্র অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

শুধু চট্টগ্রামের শেভরন ল্যাবেই ১০টি ঘটনা জানা গেছে, যেখানে যাত্রীরা অতিরিক্ত অর্থ দেয়ার পরও করোনার রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে বলে অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। কারণ তারা ধরে নিয়েছিলেন, শেভরন কর্তৃপক্ষই পরবর্তী সময়ে ফোন করে রিপোর্ট নেগেটিভ করার জন্য অতিরিক্ত অর্থ নিয়েছে। কীভাবে চক্রটির হাতে নমুনা পরীক্ষা করতে দেয়া যাত্রীদের ফোন নম্বর বা তথ্য পৌঁছেছে সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রতারকচক্র হিসেবে সন্দেহের তীর প্রথম দিকে ঘরের ছেলেদের ওপরই বিদ্ধ হয়।  

জানা যায়, চট্টগ্রামের তিনটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিদেশগামী যাত্রীদের করোনা টেস্ট করানোর জন্য অনুমোদন লাভ করেছে। অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল, ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল ও শেভরন ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরি লিমিটেড। প্রতিদিন এ ল্যাবগুলোতে গড়ে ৫০০-৬০০ বিদেশগামী যাত্রী কভিড পরীক্ষার জন্য নমুনা জমা দেন। নিয়ম অনুযায়ী সরকার নির্ধারিত আড়াই হাজার টাকা ফির বিনিময়ে নমুনা জমা দেয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যাত্রীদের পরীক্ষার ফলাফল জানিয়ে দেয়া হয়। পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটেও সেটি প্রকাশ করা হয়।

ল্যাবগুলোর কভিড পরীক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের মতামত থেকে জানা যায়, বিদেশগামী যাত্রীদের কভিড টেস্টের সব তথ্য সংগ্রহ করে ডাইরেক্টর জেনারেল অব হেলথ সার্ভিসেসের (ডিজি হেলথ) ওয়েবসাইটে আপলোড করতে হয়। সেখানে প্রবেশের জন্য প্রতিটি ল্যাব কর্তৃপক্ষকে আলাদা ইউজারনেম ও পাসওয়ার্ড দেয়া হয়। এগুলো ব্যবহার করে ডিজি হেলথের ওয়েবসাইটে প্রবেশের পর নিজেদের তথ্য আপলোডের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলার বিদেশগামী যাত্রীদের কভিড পরীক্ষার সব তথ্য দৃশ্যমান হয়। ফলে কোথায় কোন ল্যাবে কোন যাত্রী নমুনা পরীক্ষা করতে দিয়েছেন, তা দেশের যেকোনো প্রান্তে বসে দেখা যায়। ধারণা করা হচ্ছে, বিদেশগামী যাত্রীদের নমুনা পরীক্ষার দায়িত্ব পাওয়া শতাধিক সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ল্যাবের কোনো না কোনোটির সঙ্গে জড়িত কেউ বা কোনো চক্র এসব তথ্য অসাধু উপায়ে ব্যবহার করছে। যেগুলো ব্যবহার করে তারা যাত্রীদের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্য ল্যাবের তথ্য প্রদর্শনের সুযোগটি বন্ধ করে দেয়া হলে প্রতারণা কমে যাবে।

এদিকে, শেভরনের নাম করে প্রতারণার ঘটনার অভিযোগ পেয়ে গত ৩১ আগস্ট শেভরনের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের হালিশহর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। শেভরনের পরিচালক মো. রাশেদুল হাসানের করা ওই ডায়েরিতে যেসব নম্বর থেকে প্রতারণামূলক ফোনকল এসেছে সেগুলো উল্লেখ করা যায়। ফোন নম্বর ট্র্যাক করে জানা যায়, প্রতারণায় ব্যবহূত মোবাইল নম্বরগুলো পাবনা, সিলেট, নোয়াখালীতে ব্যবহূত হচ্ছে। ফলে অন্য জেলার ঘটনা হওয়ায় থানা কর্তৃপক্ষও এ বিষয়ে কোনো সহযোগিতা করতে পারেনি।

এ বিষয়ে মো. রাশেদুল হাসান বলেন, করোনা টেস্টের জন্য দেয়া তথ্য অ্যাপস কিংবা ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করা সহজ। প্রথম অভিযোগ পাওয়ার পর আমাদের কোনো কর্মী এ ঘটনা ঘটিয়েছে ভেবে তাদের সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু পরে বুঝতে পারি যে দেশের যেকোনো স্থান থেকে এটি করা সম্ভব। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় দুই মাস আগে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছি। থানা থেকে এ বিষয়ে কোনো ইতিবাচক সহযোগিতা না পেয়ে এখন আদালতের মাধ্যমে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছি আমরা। এ বিষয়ে প্রশাসন যদি কঠোর ব্যবস্থা নেয় তাহলেই বিদেশগামী যাত্রীদের সঙ্গে ঘটা প্রতারণা বন্ধ করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

তবে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠানই এ বিষয়ে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দেয়নি বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন ডা. মো. ইলিয়াস চৌধুরী। তাঁর মতে, বিষয়টি আমরা শুনেছি। তথ্য প্রমাণসহ কেউ যদি আমাদের কাছে অভিযোগ দেয়, তবে বিষয়টি আমরা সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে জানাব। তখন সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেয়া হবে।

আগামীনিউজ/শরিফ