ঢাকাঃ অবৈধ মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানি (এমএলএম) পদ্ধতির ব্যবসার নাম করে দেশে একযুগ ধরে প্রতারনা করেছে ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিরা সুকৌশলে জনগণের কাছ থেকে ৪ হাজার ১১৯ কোটি টাকা আত্মসাত করেন। এর মধ্যে ৯৬ কোটি টাকা পাচারও করেন তারা। তবে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও জালিয়াতির মামলায় ডেসটিনির শীর্ষ ব্যক্তিরা এখন কারাগারে।
পরবর্তী সময়ে ডেসটিনির আদলে যুবক, ইউনিপে টু ইউসহ একের পর এক এমএলএম কোম্পানি গড়ে ওঠে। এর মধ্যে ২০০৬ সালে যুবক ২ হাজার ৬০০ কোটি, ২০১১ সালে ইউনিপে টু ইউ ৬ হাজার কোটি আত্মসাত করে উধাও হয়ে যায়। তবুও থেমে থাকেনি এই পদ্ধতিতে প্রতারণা। এখন বদলেছে প্রতারণার ধরন। অনেক প্রতারণামূলক স্কিমে অর্থ বিনিয়োগ করে প্রতারনার শিকার হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। হালের আলোচিত ই-কমার্স ইভ্যালি, ধামাকা, ই-অরেঞ্জ, এসপিসি ওয়ার্ল্ড, নিরাপদডটকমসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নিয়েছে গ্রাহকদের অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকা। অভিযোগ উঠেছে অর্থপাচারেরও। এছাড়া রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন সমবায় সমিতির নামে দ্বিগুণ মুনাফার কথা বলে গ্রাহকের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে উধাও হয়েছে। ২০০৮ থেকে ২০১৯ সময়ে ২৬৬টি সমবায় সমিতির গ্রাহকদের ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা ঘটেছে।
জানা গেছে, অতি মুনাফার ফাঁদে ফেলে গ্রাহকদের টাকা লুটের সবচেয়ে বড় দুটি উদাহরণ ডেসটিনি ও যুবক। এ দুটি প্রতিষ্ঠান সাধারণ গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করে প্রায় ৬ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
অতি মুনাফার লোভ দেখিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি বা যুবক। রাজধানীর শাহবাগে আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেটে কয়েকটি দোকান ভাড়া নিয়ে যাত্রা শুরু করে যুবক। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটি উচ্চ সুদের বিনিময়ে আমানত সংগ্রহ ও ঋণদান কর্মসূচী চালু করে।
২০০৫ সালে যুবকের প্রতারণামূলক কার্যক্রম নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তদন্তে নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অবৈধ ব্যাংকিংয়ের অভিযোগে তখন যুবকের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০১২ সালে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠলে ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীনসহ ৫৩ জনের বিরুদ্ধে দুটি আলাদা মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একটিও নিষ্পত্তি হয়নি তবে চুরান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ২০১২ সাল থেকে রফিকুল আমীনসহ ডেসটিনির শীর্ষ ব্যক্তিরা কারাগারে রয়েছেন এবং কিছু কর্তারা পলাতক রয়েছেন।
ডেসটিনির পলাতক আসামীরা নামে বেনামে বিভিন্ন ধরনের অবৈধ মাল্টিলেভেল কোম্পানী (এমএলএম) খুলে প্রতারণা করে আসতেছেন।
জানা যায়, ডেসটিনির দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিংয়ের মামলার কয়েকজন পলাতক আসামী প্রশাসনের চোখের সামনেই আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে অবৈধ এমএলএম কোম্পানি পরিচালনা করছে।
যেখানে ডেসটিনি ২০০০ লিঃ এর অর্থ-আত্মসাৎ মামলায় প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার সাজা প্রাপ্ত হয়ে জেল খাটছেন সেই অবস্থাতেও তারা প্রশাসনকে বৃদ্ধা আঙ্গুল দিখিয়ে দিব্বি ঘুরে বেডাচ্ছেন এবং অবৈধ ব্যবসা (এমএলএম) ও ভয়াবহ প্রতারনার মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার করছেন।
এছাড়া জমি এবং প্লট বিক্রির নামে শতশত মানুষদের নিকট থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করেই যাচ্ছেন তারা। প্লট বুঝে না পেয়ে গ্রাহক তাদের টাকা ফেরত চাইলে নানা রকম ভয়ভীতি এবং গুম করার হুমকি দিচ্ছে ফলে তারা ভীষণ আতঙ্কে আছে। এই ল্যান্ডের নামে জনগন থেকে যে টাকা আমানত রাখা হচ্ছে এর বিরুদ্ধেও তাদের নামে একাধিক মামলাও রয়েছে বলে এক সূত্রে জানা গেছে কিন্তু অজ্ঞাত কারনে প্রশাসন তার কোন প্রকার ব্যবস্থা নিচ্ছে না ফলে ভুক্তভোগীরা ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।এসব অবৈধ টাকায় তাদের রয়েছে ঢাকায় নামে বেনামে একাধিক দামি ফ্লাট ও বিলাসবহুল গাড়ি।
সাম্প্রতিক সময়ে লকডাউনের সময় মানুষজন ঘরে বন্দি,দোকানপাট বন্ধ এই সুযোগে লোভনীয় অফার দিয়ে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, কিউকম, এসপিসি ওয়ার্ল্ড, বুমবুম, আদিয়ান মার্ট, নিডস, দালাল, সিরাজগঞ্জ শপ, নিরাপদ ডটকম, আলাদিনের প্রদীপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ই-কর্মাসের নামে ডেসটিনির আদলে ব্যবসা পরিচালনা করতেছে। ডেসটিনিতে যেমন প্রশাসনের নজর দারি ছিল না তেমনি পরর্বতী সময়ে প্রশাসনের নজর দারি না থাকায় এসব ই-কর্মাস এত কোটি টাকা আত্মসাত করার সুযোগ পেয়েছে। অতিরিক্ত লোভী মার্সেন্ট ও গ্রাহকরা সরকারের কাছ থেকে এসব কোম্পানির বৈধতা যাচাই না করে লেনদেন করায় অনেকাংশে দ্বায়ী। যত ই-কর্মাস হচ্ছে তাদের কর্নধাররা বা কোম্পানির সাথে সংযুক্ত অনেকেই ডেসটিনির সাথে কোন না কোন ভাবে জড়িত বলে জানা যায়।
এমন সব প্রতারণা ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে বর্তমানে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, কিউকম, এসপিসি ওয়ার্ল্ড, বুমবুম, আদিয়ান মার্ট, নিডস, দালাল, সিরাজগঞ্জ শপ, নিরাপদ ডটকম, আলাদিনের প্রদীপ, এসকে ট্রেডার্স, প্রিয়শপ, ২৪টিকেট ডট কম, গ্রিনবাংলা, এক্সিলেন্টবিগবাজার, ফাল্গুনিশপসহ প্রায় ২৬টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুদক, পুলিশ, র্যাব, সিআইডিসহ সরকারের অন্তত নয়টি সংস্থা।
এদিকে চটকদার সব পণ্যের অফার দিয়ে আলোচনায় আসা ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাসেল প্রায় শত কোটি টাকা কয়েকটি দেশে পাচার করেছেন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে উঠে এসেছে। টাকা পাচারের বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাসেল ইভ্যালি প্রতিষ্ঠার পর প্রায় ১১ বার বিদেশে গেছেন। বিদেশে যাওয়ার তার মূল উদ্দেশ্য ছিল যে, ইভ্যালিকে অন্য দেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে পরিচিত করানো। যাতে তারা সহজেই তাকে পণ্য সরবরাহ করে। বিদেশের একাধিক প্রকল্পে তার বিনিয়োগ রয়েছে। তার এ কাজে সহযোগিতা করেছে তার এক বন্ধু। তিনি চীন থেকে মোবাইল ফোন এনে থাকেন। বিদেশে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচারের ক্ষেত্রে ওই বন্ধুর হাত রয়েছে বলে রাসেলকে রিমান্ডে নিয়ে জানতে পেরেছে পুলিশ।
আগামী নিউজ/এসআই