ভারতে চিহ্নিত করোনা ভ্যারিয়েন্টঃ বাংলাদেশের প্রস্তুতি!

নিউজ ডেস্ক মে ১০, ২০২১, ১১:৫৭ এএম

ঢাকাঃ মূলতঃ ভারতের চিকিৎসা খাত চরমভাবে ভেঙ্গে পরেছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরু থেকেই দেশটিতে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা ছাপিয়ে গেছে প্রথম ঢেউয়ের ভয়াবহতাকেও। মাত্র ৫মাস আগে গত সেপ্টেম্বর থেকে কোভিডের প্রথম ঢেউয়ের সংক্রমণ কমতে শুরু করে। বছর শুরু হতেই নিয়তি আবার হামলা করে দেশটিতে। ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই সংক্রমণের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে প্রতিদিন। মার্চে হঠাৎই দৈনিক সংক্রমণের হার বাড়ে এবং এপ্রিল মাসে বেড়ে তা ভাঙতে থাকে পূর্বের সব রেকর্ড।

মহামারি করোনায় ইতিহাস গড়েছে ভারত। প্রায় ১৪০ কোটি জনসংখ্যার এই দেশটিতে ভয়াবহ রুপ নিয়েছে করোনা ভাইরাস। দেশের হাসপাতালগুলোতে কোন জায়গা নেই। মুমূর্ষু রোগীরা হাসপাতালে স্থান না পেয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন খোলা বারান্দায় অথবা অ্যাম্বুলেন্সে। বেশিরভাগ মানুষ চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। শ্মশান কিংবা গোরস্থানের দৃশ্যগুলো যেন ভারতের আহাজারির স্থান। ভারতে সবচেয়ে ভয়ংকররুপে দেখা দিয়েছে মারাত্মক অক্সিজেন সংকট। অন্যদিকে হাসপাতাল ও আইসিইউতে শয্যার অভাব এখন চরমে!

সভাবতই প্রশ্ন উঠে- হঠাৎ এই সংক্রমণের কারণ কী?

বলা বাহুল্য ভারতে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে শুরু হয়ে এপ্রিল পর্যন্ত চলে নির্বাচনী প্রচারণা, ভোট গ্রহণ ও সভা, মিছিল, সমাবেশ। কাছাকাছি সময়ে বসে কুম্ভ মেলা। মেলায় আসা হাজার হাজার মানুষ ভাইরাসকে ব্যপকভাবে ছড়িয়ে দিয়েছে।

সংক্রামনের আরেক কারণ হতে পারে অতি-সংক্রমণশীল নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলোর।

“ভারতে ব্যপক সংক্রামনের কারণ কি? ভ্যারিয়েন্ট কতটা দায়ী?”

ভাইরাসের জন্যে অতি স্বাভাবিক ঘটনা হলো ভ্যারিয়েন্ট। মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রতিনিয়ত রূপান্তর ঘটছে এবং তৈরি হয় এই নতুন ভ্যারিয়েন্ট বা স্ট্রেইনের। নতুন নতুন তৈরি হওয়া ভ্যারিয়েন্টগুলো সাধারণত নিরীহ হয়ে থাকে কিন্তু অনেক সময় এই স্ট্রেইনগুলোই হতে পারে ভয়াবহ সংক্রামক। হয়ে উঠতে পারে মারাত্মক বেপরোয়া। ফাঁকি দিতে পারে মানুষের রোগপ্রতিরোধ সিস্টেমকে এমনকি ভ্যাকসিন প্রতিরোধী হয়ে উঠতে পারে। এ ধরনের ভাইরাস স্ট্রেইনকে বলা হয় ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’।

এই ধরনের অতি-সংক্রামক ভ্যারিয়েন্টের একটি গেল অক্টোবরেই ভারতে শনাক্ত হয়েছে। ভ্যারিয়েন্টটি হচ্ছে বি.১.৬১৭।

সুত্রমতে, এবছর জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে মহারাষ্ট্রে সংগৃহীত ৬০ শতাংশ পরীক্ষায় শনাক্ত হয়েছে এই বি.১.৬১৭ ভ্যারিয়েন্ট।
গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটা (জিআইএসএআইডি) এর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বি.১.৬১৭ ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে অন্তত ২১টি দেশে। যুক্তরাজ্যেও পাওয়া গেছে বি.১.৬১৭ এর ১০৩টি ভ্যারিয়েন্ট। ইন্ডিয়ান এই ভ্যারিয়েন্টগুলো যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করে ফেব্রুয়ারি থেকেই। ভারতীয় অনেক বিজ্ঞানীদের ভাষায়, এই ভ্যারিয়েন্টটি অতি-সংক্রামক ও ভয়াবহ। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের বিশ্বব্যাপি ঊর্ধ্বগতির জন্য এই ভ্যারিয়েন্টেই দায়ী বলে মনে করেন তারা। মোটা দাগের কথা হলো, এই ভাইরাস ছড়িয়ে পরেছে বিশ্বব্যাপি।
আরো জানা গেছে যে, বি.১.৬১৭ ভ্যারিয়েন্টের স্পাইক প্রোটিনে দুটি প্রধান মিউটেশন ঘটেছে। যার একটি হলো ই৪৮৪কিউ আর এবং অন্যটি এল৪৫২। ‘সেল’ জার্নালে ২০ এপ্রিল প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, এই মিউটেশন নতুন ভ্যারিয়েন্টকে অতি-সংক্রামক ভাইরাসে পরিণত করেছে। এবং এই রূপান্তরিত ভাইরাসটির ভ্যাকসিন-বিরোধী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এখনো তা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়।

মহামারি বিপর্যয়ের কারণঃ নির্বাচনী প্রচারণা!

বছরের শুরুর দিকে ঠিক যেসময় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ হানা দিলো ভারতে, ঠিক সেই সময়েই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে শুরু হলো পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, কেরালা ও তামিলনাড়ুতে নির্বাচনী প্রচারণা এবং ভোটগ্রহণ। নির্বাচনী সমাবেশগুলোতে ঢল নামে মানুষের। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে এই চারটি রাজ্যেই আশঙ্কাজনকভাবে করোনা সংক্রমণ বেড়ে গেছে।

শুধু এই চার রাজ্যে করোনা সংক্রমণ বেড়েছে? বরং এই সময়ে অন্যান্য রাজ্যেও ব্যাপকভাবে সংক্রামন ঘটেছে করোনার। এর মধ্যে রয়েছে মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ, দিল্লি ও কর্ণাটের মত রাষ্ট্র।

অতএব, একথা হলফ করে বলা যায় করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে দেশব্যাপী সৃষ্ট মহামারির পেছনে জনসমাবেশ বা নির্বাচনী প্রচারণা মূল কারণ নয়। ফলাফল আবারও নির্দেশ করে অতি-সংক্রমণশীল ভ্যারিয়েন্টগুলোকে।

ভারতের বিপর্যয়ঃ আমাদের শিক্ষণীয়!

আমরা এতক্ষণ শুধুমাত্র ভারতকে নিয়েই আলোচনা করলাম। কারণ, এটি আমাদের (বাংলাদেশ) প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছে। তবে এই মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে এর থেকেও বেশি বিপর্যস্ত ও উচ্চ সংক্রমণ ঘটেছে ব্রাজিল, যুক্তরাজ্য, জার্মানি এমনকি ফ্রান্সেও। এ সবগুলো দেশেরই চিত্র প্রায় একই। করোনার প্রথম ঢেউয়ের থেকে দ্বিতীয় ঢেউ বহুগুনে মারাত্মক। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, প্রতিটি দেশেই করোনার এই দ্বিতীয় ঢেউয়ের জন্য দায়ী করা হচ্ছে নব্য এসব ভ্যারিয়েন্টকে।
বাংলাদেশেও ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে।

বাংলাদেশে যেসব ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে তার মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের সংখ্যা বেশি। ঠিক ঐ সময়গুলোতে অর্থাৎ মার্চ থেকে এপ্রিলে দ্বিতীয় ঢেউয়ে করোনার ভয়ংকর উত্থান ঘটেছে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশের এই উত্থানের পেছনে ইউকে ভ্যারিয়েন্টের ভূমিকা থাকতে পারে এমন ধারনা গবেষকদের।

যদিও হঠাৎ করে উর্ধমুখি করোনার দ্বিতীয় ঢেউ অনেকটাই নিয়ন্ত্রনে চলে এসেছে সরকারি কিছু উদ্যোগ ও ৫ এপ্রিল থেকে নেয়া ‘লকডাউন’র কারণে। তবে, এই নিম্নমুখী সংক্রমণের ধাপ ক্ষণস্থায়ী হতে পারে এবং প্রতিবেশি রাষ্ট্রের মত আচমকা বেড়ে যেতে পারে সংক্রমণ। যদিনা এখনই কোন কার্যকরী প্রশমন ব্যবস্থা প্রয়োগ বা গ্রহণ করা না হয়। ঠিক ভারতের মত বাংলাদেশও মহা বিপর্যয়ের মধ্যে পরে যেতে পারে।
এসকল বিষয়,তথ্য ও ‍উপাত্ত বিশ্লেষন করে আমাদের দ্রুত বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরীঃ

প্রথমত, যেহেতু ভারতে এই ভ্যারিয়েন্ট ব্যাপক আকার ধারণ করেছে তাই ভারতের সঙ্গে সকল সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া। যাতে ভারত থেকে কোন ব্যক্তি বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে। তবে, বিশেষ ক্ষেত্রে কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, একই নিয়মে উচ্চ সংক্রামনশীল দেশ বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের সাথেও সকল যাতায়াত বন্ধ করতে হবে।

তৃতীয়ত, করোনার সংক্রামন কমলে যদিওবা দেশব্যাপী লকডাউন শিথিল করা হয় তবুও কমপক্ষে তিন মাসব্যাপি অঞ্চলভিত্তিক কয়েক ধাপে দীর্ঘমেয়াদী লকডাউন ও প্রশমন পদ্ধতি নিশ্চিত করা। সরকারের উচিত হবে কঠোরভাবে জনগনকে লকডাউন এবং বিধিমালা মানতে বাধ্য করা অন্যথায় উদ্যোগ সফল হবেনা।

চতুর্থত, ভ্যাকসিন প্রদান কার্যক্রম দেশব্যাপী আরও জোরদার করা উচিত। ভ্যাকসিন ছাড়া করোনা মোকাবিলা যেহেতু সম্ভব নয় তাই দেশের ৭০ভাগ মানুষের ভ্যাকসিন গ্রহন নিশ্চিত করতে হবে।

পঞ্চমত, আমরা দেখতে পেয়েছি ভারতে চরম অক্সিজেন এবং আইসিইউ সংকট। সেদিকে লক্ষ্য রেখে দেশের হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত সাধারন বেড, আইসিইউ ও অক্সিজেন মজুদ রাখা।

সবশেষে, করোনা বিপর্যয় এড়াতে ভ্যারিয়েন্ট মনিটরিং অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ভ্যারিয়েন্ট সার্ভে চালাতে হবে। থার্মোফিশার কোম্পানির ‘মিউটেশন প্যানেল’ আরটি-পিসিআরের জন্যে বেশ সহজলভ্য।