দুশ্চিন্তায় রাজশাহীর বাগানিরা

ক্ষরায় ঝরছে আম-লিচুর গুটি

রাজশাহী প্রতিনিধি এপ্রিল ২৫, ২০২১, ০৪:১৫ পিএম
ছবিঃ আগামী নিউজ

রাজশাহীঃ তীব্র ক্ষরা ও অনাবৃষ্টিতে ঝরে পড়ছে আম ও লিচুর গুটি। প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর নির্ভর করে এসবের ফলন। কিন্ত পরিবেশ অনুকূলে না থাকায় এসব ফলের বাগানিরা রয়েছেন চরম দুশ্চিন্তায়।

প্রায় ১৫০ দিন পর গত বুধবার (২১ এপ্রিল) ঘণ্টাব্যাপী বৃষ্টিতে স্বস্তি ফিরলেও আবারো তাপমাত্রা বাড়ায় নাভিঃশ্বাস উঠেছে বাগানিদের। এরইমধ্যে গত মঙ্গলবার (২০ এপ্রিল) জেলায় রেকর্ড করা হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ ৪০ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা।

আর গত ৪ এপ্রিল নগরীতে ধূলিঝড় ও বাঘা-চারঘাট উপজেলায় শিলাবৃষ্টিতে উল্টো ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন বাগানিরা। গতবছর ঘুর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে লোকসান কাটিয়ে এ বছর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও কাঙ্খিত ফলন নিয়ে শঙ্কিত তারা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ফলের মধ্যে রাজশাহীতে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় আম। কিছু কিছু জায়গায় বাণিজ্যিকভাবে লিচুর চাষ হচ্ছে। জেলায় চলতি মৌসুমে আম চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৯৪৩ হেক্টর জমি। গত বছর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৭ হাজার ৫৭৩ হেক্টর। এ বছর বেড়েছে ৩৭৩ হেক্টর জমিতে চাষ। আর এ বছর আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে হেক্টর প্রতি ১১ দশমিক ৯ মেট্রিক টন। অপরদিকে জেলায় লিচু চাষ হয়েছে ৫১৯ হেক্টর জমিতে। এবার মোট লিচু উৎপাদন ধরা হয়েছে ২ হাজার ৯৬৬ মেট্রিক টন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রাজশাহীতে মোট ৪৩টি ফল চাষের উপযোগী পরিবেশ থাকলেও চাষ হচ্ছে ৪০ রকমের ফল। জেলায় আনারশ, বিলাতিগাব ও কাজুবাদাম এখনো উৎপাদন হয়নি। সবশেষ যুক্ত হয়েছে ড্রাগন ফল। আর স্বল্প পরিসরে চাষ হচ্ছে স্টবেরি ফলের। ফলের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কাঁঠাল। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ ফল চাষ হচ্ছে ৫৮৯ হেক্টর জমিতে। আর লিচুর অবস্থান তৃতীয়।

তবে সবচেয়ে বেশি ১৭ হাজার ৫৭৩ হেক্টর জমিতে চাষ হওয়া ১০ জাতের আমের মধ্যে উৎপাদনে লক্ষণভোগ রয়েছে শীর্ষে। এটি ৬ হাজার ৩৬৭ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে। আর গোপাল ভোগ ৭০৫, খিরসাপাত ২ হাজার ৬২১, ল্যাংড়া ১ হাজার ৪৪১, ফজলী ২ হাজার ২০৮, আশি^না ১ হাজার ৬৮১, আম্রপালী ১ হাজার ১৭০, বারি-৪ জাতের আম ৯২, রাণীপছন্দ ২২ এবং গুটি ও অন্যান্য ১ হাজার ৬৩৬ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে।

এদিকে রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের দেয়া তথ্যমতে, এ পর্যন্ত জেলায় মোট ৯ জাতের আম উদ্ভাবন করা হয়েছে। সবশেষ বারি-১৪ এবং বারি ফলশা-১ জাতের আম উদ্ভাবন করা হয়। যেটি গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর সরকারিভাবে স্বীকৃতি পায় এবং তালিকাভূক্ত হয়। আম সংশ্লিষ্টরা এসব জাতের ব্যাপারে ইতিবাচক আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এছাড়া লিচুর চাষ দিনাজপুরে বেশি হলেও বর্তমানে রাজশাহীতেও বাণিজ্যিকভাবে চাষ বেড়েছে এ ফলের।

তীব্র ক্ষরা এবং অনাবৃষ্টির কারণে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন এ অঞ্চলের বাগানিরা। করোনার প্রভাবে উৎপাদন করে সারাদেশে সরবরাহ করা নিয়েও রয়েছেন শঙ্কায়। যদিও এসব পরিবহণে বিধিনিষেধ নেই সরকারের। গতবছর সরকারিভাবে বিশেষ উদ্যোগে ট্রেনে ব্যবস্থা করা হয়েছিল ফল পরিবহণের। তবুও ফল চাষিদের কপালে চিন্তার ভাজ। ফলনও হয়েছে অনেক কম। গুটি যে পরিমাণ ধরেছিল, সেগুলোও অনেকাংশে ঝরে পড়ছে তীব্র ক্ষরা ও অনাবৃষ্টির প্রভাবে।

বাগানিরা জানান, গতবছর ঘুর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন তারা। লোকসান কাটিয়ে এ বছর সেটি পুষিয়ে নেয়ার ইচ্ছায় ভালভাবে পরিচর্যা করেছিলেন। কিন্ত জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে অধিকাংশ গাছ থেকেই গুটি ঝরে পড়ছে। এক সপ্তাহ ধরে চলছে এ অবস্থা। ফলে আবারো লোকসানের দুশ্চিন্তায় তারা।

নগরীর ছোট বনগাম এলাকার লিচুচাষি আব্দুল হান্নান বলেন, গতবছর আম্ফানের প্রভাবে লিচুতে কাঙ্খিত লাভ হয়নি। এবার সেসব বাগানের গাছে গাছে নতুন পাতা গজিয়ে গাছগুলো বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়েছিল। কিন্তু লিচুর ফলন তুলনামূলক কম। কিছু গাছে গুটি আসলেও ঝরে পড়ায় তিনি দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। এছাড়া দীর্ঘদিন বৃষ্টির দেখা না থাকায় বাগানে সেঁচ দিয়েও কাজ হচ্ছে না।

বড় বনগ্রাম চকপাড়া এলাকার লিচুচাষি সাহাবির রহমান জানান, বোম্বাই ও দেশী জাতের মোট ২০ বিঘা লিচুর বাগান রয়েছে তার। এরমধ্যে ৯ বিঘায় ৮১ টি গাছের মধ্যে হাতেগোনা ৪-৫টি গাছে লিচু এসেছে। প্রতিটি মাঝারি গাছে ফসফেট,পটাশ, জিঙ্ক, বোরণ, জিপসাম মিলিয়ে ৫ কেজি করে কীটনাশক দিতে হয়। চাষ দিয়ে পরিস্কার করতে হয় আগাছা। ঠিকমতো সবকিছু করেও লিচু ধরেনি। এবার তিনি প্রায় দেড় লক্ষাধিক টাকা লোকসানের মুখে।

জেলার বাঘা উপজেলার মনিগ্রাম এলাকার আম ব্যবসায়ী ও আম চাষী জিল্লুর রহমান আগামী নিউজকে বলেন, এবার আমের গুটি ভাল আছে। পরিচর্যাও হয়েছে বেশ। গাছের গুটি কীটনাশক ও বিভিন্ন ধরনের বালাইনাশক দিয়ে ধুয়ে দেয়ার পরও তাপমাত্রা বেশি হওয়ায় গুটি ঝরে পড়ছে। বাগমারার তাহেরপুর পৌর এলাকার চাষি শামীম রেজা জানান, এ বছর গুটি গতবছরের চেয়ে কম। আবহাওয়া তেমন ভালো না, বৃষ্টিপাত নেই। সামনে আবার কালবৈশাখী ঝড়ের আশঙ্কা রয়েছে। সবমিলিয়ে কাঙ্খিত লাভবান হওয়া নিয়ে শঙ্কিত তিনি।

এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কে জে এম আব্দুল আউয়াল আগামী নিউজকে জানান, ক্ষরা, অনাবৃষ্টি ও ঘুর্ণিঝড়ের প্রভাবে ফল ঝরে পড়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রতিবছরই এসবের প্রভাব ফলের ওপর থাকে। এতে অনেকই ভয় পায়। প্রাকৃতিক এসব বিষয় নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। অতিরিক্ত গুটি ঝরে পড়ে গাছের ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ফল গাছে থেকে যাবে। তবে একবারেই অনাবৃষ্টি দেখা দিলে বাগানে সেচ দিতে হবে। এসব বিষয়ে কৃষি অধিদপ্তর থেকে চাষিদের ধারাবাহিকভাবে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।

এ ব্যাপারে ফল গবেষণা কেন্দ্র রাজশাহীর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আলীম উদ্দীন আগামী নিউজকে জানান, বৈরী আবহাওয়া মোকাবেলা করেই ফল চাষ করতে হবে। সারাদেশে রয়েছে এখানকার সুস্বাদু আমের চাহিদা। এছাড়া চলমান করোনা প্রতিরোধে প্রচুর ভিটামিন খেতে হবে। সেটি পর্যাপ্ত সরবরাহে ভূমিকা রয়েছে এ অঞ্চলের ফল চাষিদের। বিভিন্ন প্রতিকূলতায় তাদেরকে সুপরামর্শ দিয়ে লাভবান হতে ফল গবেষণা কেন্দ্র থেকে সহায়তা করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

আগামীনিউজ/এএস