পার্বত্য চট্টগ্রামের সংঘাতময় পরিস্থিতি: জনসংহতি সমিতি ৪টি দলে বিভক্ত

নিউটন চাকমা, রাঙামাটি জেলা প্রতিনিধি এপ্রিল ২২, ২০২১, ০৩:০৪ পিএম
ছবিঃ সংগৃহীত

রাঙ্গামাটিঃ পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘ ২ যুগের বেশী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও সংঘাতের অবসানের লক্ষ্যে বর্তমান ও তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার বিগত ২রা ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় এক অনাড়ম্বর পরিবেশে পার্বত্য শান্তি চুক্তি নামে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস)  সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করেন।

এ চুক্তির ফলে পাহাড়ী অধ্যূষিত অঞ্চল পার্বত্য রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার পাহাড়ী আদিবাসীদের স্বাভাবিক জীবন যাত্রার মানোন্নয়ন ও পার্বত্য চট্টগ্রামের  জুম্ম জনগোষ্ঠীদের সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)-ও সকল নেতা-কর্মীরা আত্বসমর্পনের মধ্যে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন।

সে লক্ষ্যে অত্র অঞ্চলের পাহাড়ী আদিবাসীদের ও বাঙ্গালীদের দীর্ঘ দিনের সংঘাত, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, হানা-হানির ঘটনা অনেকটা অবসান ঘটে। কিন্তু পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদনের সমকালীন হতে আগামী ২রা ডিসেম্বর ২০২১ ইং সালে ২যুগের অতিক্রান্ত হতে যাচ্ছে। অথচ চুক্তির আগে ২যুগের বেশী জনসংহতি সমিতি সশস্ত্র বাহিনী (শান্তি বাহিনী নামে পরিচিত) অবস্থায় এবং চুক্তি সম্পাদনের পর প্রায় ২যুগ অতিবাহিত হলেও আজো পর্যন্ত পার্বত্য শান্তি চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ায় এবং সরকারের হস্তক্ষেপ গরিমসিতে পার্বত্য চুক্তির যথার্থ অবাস্তবায়নে পার্বত্য পশ্চাৎ এলাকায় কঠিন থেকে কঠিন রূপে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।

অপরদিকে, পার্বত্য অঞ্চলে এখনো সেই সেনা বাহিনীর কর্তৃত্ব অপারেশন উত্তোরণের নামে জারি রয়েছে। অথচ যেখানে পার্বত্য পুলিশির শাসনব্যবস্থা থাকার কথা থাকলেও এ অঞ্চলে চাঁদাবাজি, খুন ও সন্ত্রাসীদের আস্তানা চিহ্নিত করে অপারেশন উত্তোরণ নামে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীদেরকে নির্যাতন, হয়রানি ও গ্রেফতার করেএ অঞ্চলেসেনাশাসন বলবৎ জারি করেছে। যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল বলে আদিবাসী নেতৃবৃন্দ ও সচেতন মহল দীর্ঘদিন দাবি জানিয়ে আসছেন।অবশ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামের চেয়ে সমতলে প্রতিদিন যেহারে খুন, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, ঘুম, ছিনতাই ও বন্ধুক যুদ্ধের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটেতার এক অংশেরও পার্বত্য অঞ্চলে ঘটেনা বলে একাধিক সুত্র দাবী করেছেন।

উল্লেখ্য যে, বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক সহিংস ঘটনার অবসানের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সঙ্গে পার্বত্য শান্তি চুক্তি নামে স্বাক্ষরের মধ্যে দিয়ে পার্বত্যবাসীরা অনেক আশা বেঁধেছিল। যা পরবর্তী প্রজন্ম এ অঞ্চলের পাহাড়ী-বাঙ্গালী মিলেমিশে একযোগে কাজ করবে। কিন্তু কিছু দুঃস্কৃতকারী একটি মহল এ শান্তি চুক্তিকে প্রভাবিত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এখনো ঐ শ্রেণীর দালাল চক্রটি জনসংহতি সমিতির সঙ্গে সরকারের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করিতে পাহাড়ের দলবেঁধে আনাচে-কানাচে অবস্থান করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা, অপহরণ, চাঁদাবাজি, খুন ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জেএসএস ওসচেতন মহল আশংকা করছেন।

একদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিরদাবী, যতদিন পার্বত্য শান্তি চুক্তির ধারা-উপধারা পুর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়ন না হবে ততোদিনপর্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ী আদিবাসী ও আদিবাঙ্গালীদের মধ্যে এলাকায় শান্তি বিরাজ করবে না। কেননা, পাহাড়ী জুম্মজনগোষ্ঠী ও স্থানীয়বাঙ্গালীদের চেয়ে অস্থায়ী অনুপ্রবেশকারীর (সেটেলার) সংখ্যা বেশী। কাজেই অনুপ্রবেশকারীরা অত্র অঞ্চলে চিহ্নিতকারী মূলহোতা বলে স্থানীয় বাসিন্দা ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দাবি।

গত ৪ ও ৫ এপ্রিল সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার তবলছড়ি নামক স্থানে কিছু দুঃস্কৃতকারী পাহাড়ী যুবক বাঙ্গালীদের কাছ থেকে চাঁদা দাবি করলে পাহাড়ী-বাঙ্গালীদের মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার রূপ নেয়। এক পর্যায়ে ঐ এলাকায় উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহায়তায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। বর্তমানে পরিস্থিতি থমথমে বিরাজ করছে।

অপরদিকে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকারের রাঙ্গামাটির স্থানীয় সাংসদ দীপংকর তালুকদারএমপি সভা ও সমাবেশে বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধ অস্ত্র ওচাঁদাবাজির আনাঘোনা রয়েছে। অবৈধ অস্ত্রের কারনে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরীহ জনসাধারণ আজ তাদের কাছে জিম্মি। সুতরাং চাঁদাবাজি বন্ধ ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে সরকারকে কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীদের অভিযানে অক্লান্ত প্রচেষ্টায় অবৈধ অস্ত্র ও চাঁদাবাজি কিছুটা কমেছে। চাঁদাবাজি ও অবৈধ অস্ত্রের উদ্ধারের বিষয়ে বিগত সংসদ অধিবেশনেও তুলে ধরেএ দাবী জানান।

উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম এন লারমা) নেতৃত্বে জনসংহতি সমিতি রাজনৈতিক সংগঠন ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী ১৯৭৫ সালে সশস্ত্র বাহিনীতে রূপ নেয়। শুরু হয় জুম্ম জনগোষ্ঠীদের সশস্ত্র আন্দোলনের অধিকার-স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রাম। তারই  ফলশ্রুতিতে বিগত ২রা ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

কিন্তু এ চুক্তির প্রেক্ষিতে পূর্ণ-শায়িত্বশাসন নামে বিগত ২৬শে ডিসেম্বর ১৯৯৮ সালে প্রসিত বিকাশ খীসা ও সঞ্চয় চাকমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে আরেক নতুন সূচনা করে আত্বপ্রকাশ ঘটে ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)নামে। এ সংগঠনটি বর্তমানে ৩ পার্বত্য জেলাসহ রাজধানীতে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। দলটি গঠনের পর পরই এলাকায় চাদাবাজি, খুন, এলাকা দখলসহ নানা অপকর্মে জড়িত থেকে জেএসএসের সঙ্গে তারা রক্তক্ষয়ীর সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। ২০০৩ সালে ইউপিডিএফের প্রতিষ্ঠাতাদের দু’জন কীর্তি শংকর চাকমা জাপানে এবং সঞ্চয় চাকমা সুইজারল্যান্ডে চলে যান। সে সময়ে দলটির আরও কয়েকজন নেতা-কর্মী দলত্যাগ করেন।

অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম আঞ্চলিক দল ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ভেঙ্গে আরও একটি নতুন দল গঠিত হয়েছে। নতুন দলটির আহ্নবায়ক তপন জ্যোতি চাকমা (বর্মা)-র নেতৃত্বে বিগত ১৫ই নভেম্বর ২০১৭ সালে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আত্বপ্রকাশ করা দলটির নাম ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (গণতান্ত্রিক)। তারা দাবি জানান, প্রসিত ও সঞ্চয় চাকমার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ সংগঠনটি নিজেদের মধ্যে আদর্শচ্যুত হয়ে প্রগতিশীল রাজনীতি, দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে নতুন দল ও কমিটি গঠন করেন।

এদিকে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার (মূল ধারা) দল থেকে বেরিয়ে এসে ২০০৭ সালে গঠিত জনসংহতি সমিতি (সংস্কার) তাতিন্দ্র লাল চাকমা (পেলে) সভাপতি ও বিমল কান্তি চাকমা(মুর্ত)-কে সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করে আবারও একটি নতুন দল আতœপ্রকাশ ঘটে। ঠিক সেই মুহুর্তে ঐদল গুলো নিজেদের জনবল ও সমর্থনের লক্ষ্যে জনসংহতি সমিতি(সন্তু)-র সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে এবং চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন, ক্ষমতা দখলদারিত্বের কাজে লিপ্ত থাকে। ত্রিমূখী আঞ্চলিক দলের সংঘর্ষে অনেক নিরীহ কিশোর-যুবক, বৃদ্ধসহ দলের অনেক নেতা কর্মী মারা গেছেন। তারপরও থেমে নেই এ অঞ্চলের এলাকা দখল, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও নিজেদের আঞ্চলিক সংঘাতের ঘটনা।গুনতে হচ্ছে সরকারী, আধাসরকারী, এনজিও ও ব্যবসায়ীদের মাসিক কিংবা বাৎসরিক হারে চাঁদা।

বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল চারটি গ্রুপে বিভক্ত। এ দল গুলো হলো- পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (সন্তু লারমা-মূল ধারা), জনসংহতি সমিতি (সংস্কারপন্থী-এমএন লারমা) তাতিন্দ্র লাল চাকমা গ্রুপ, ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-মূল ধারা) প্রসিত গ্রুপ ও ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট) তপন জ্যোতি চাকমা গ্রুপের বিভক্ত হয়ে ৩টি দলের পার্বত্য চট্টগ্রামসহ রাজধানীব্যাপী সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন বলে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও স্থানীয়রা জানিয়েছেন ।

পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন ও পাহাড়ী জনগোষ্ঠীদের স্বাধিকার অধিকার দাবী আদায়ের লক্ষ্যে বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনসংহতি সমিতির দলীয় মনোনীত রাঙ্গামাটি ২৯৯নং আসন থেকে উষাতন তালুকদার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে হাতি মার্কায় বিপুল ভোটে জয় লাভ করেন। তখনি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও এলাকাবাসীর ধারনা ছিল এবারে পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতির রূপ নেবে।

কিন্তু তৎকালীন ও বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার পার্বত্য চুক্তি কিছু অংশ বাস্তবায়ন করেই চুক্তির প্রধান সমস্যাগুলো বাস্তবায়ন করেনি। পরবর্তী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনসংহতি সমিতির প্রার্থী উষাতন তালুকদার আওয়ামী লীগ প্রার্থী দীপংকর তালুকদারের কাছে বিপুল ভোটে হেরে যায়।

জনসংহতি সমিতির সুত্রে আরো জানাগেছে, পার্বত্য শান্তি চুক্তির অবাস্তবায়নের প্রধান ভূমি বিরোধ নিস্পত্তির সমস্যা, স্থায়ী বাসিন্দাদেরনিয়ে ভোটার তালিকার প্রণয়ন, উদবাস্তুদের পূর্নবাসন প্রক্রিয়া, অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারসহ চুক্তি মোতাবেক বাস্তবায়ন অগ্রগতির পদক্ষেপ না হওয়াতে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়েছে। সেক্ষেত্রে অনতিবিলম্বে পার্বত্য শান্তি চুক্তি পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবী জানিয়েছেন। পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জনসংহতি সমিতি(সন্তু লরামা) ও অঙ্গ সংগঠন ছাড়া অন্যান্য দলগুলোর রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধের জন্য সরকারের প্রতি সহযোগিতার দাবী জানিয়েছেন। এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘ দিনের সংঘাতময় পরিস্থিতি পাহাড়ী বাঙ্গালীদের সহাবস্থান স্বাভাবিক জীবন যাপন করিতে এলাকায় অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকারের প্রতি আহ্নবান জানান।

এব্যাপারে পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসরত সকল পাহাড়ী জনগোষ্ঠী ও বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীদেরকে সজাগ থেকে সবধরনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে প্রতিহত করসহ সকল ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়াতে একযোগে এগিয়ে আসার আহ্নবান জানিয়েছেন।

আগামীনিউজ/এএস