ব্রাহ্মনবাড়িয়াঃ ছেলের চিকিৎসার টাকা যোগাতে ঋণ নিয়ে উঠানো ঘরটি ও ঘরের জায়গা বন্ধক দিয়ে দিয়েছেন এক প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী জুহেরা বেগম।
তার অসুস্থ ছেলে মুসলিম মিয়া ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। তিনি ঢাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার উত্তর সুহিলপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা নদু মিয়া দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ বছর পর স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তান রেখে মারা যান। বীর মুক্তিযোদ্ধা নদু মিয়ার মৃত্যুর পর দুই সন্তানকে নিয়ে জুহেরা দিশেহারা হয়ে পড়েন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, তখন বীর মুক্তিযোদ্ধা নদু মিয়ার পরিবারের বসবাস করার মতো নিজের বাসস্থান ছিল না। থাকতেন স্থানীয় ভূঁইয়া বাড়িতে অন্যের আশ্রয়ে।
স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা নদু মিয়ার মৃত্যুর পর স্ত্রী জুহেরা বেগম জীবন-জীবিকার জন্য যুদ্ধ শুরু করেন। অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করে ছোট ছোট দুই সন্তানকে নিয়ে জীবন-জীবিকার সংসার গড়ে তুলতে শুরু করেন। এভাবেই কেটে যায় তার দীর্ঘদিন। এসব টানাকাড়া জীবন নিয়ে তার দুই সন্তানকে পড়াশোনা করাতে পারেননি।
একমাত্র মেয়েকে গ্রামবাসীর সহযোগিতায় বিয়ে দেন। একদিন তার ছেলে মুসলিম মিয়া (৪৫) সিএনজি-চালিত অটোরিকশা চালিয়ে হাল ধরেছিল পিতৃক সংসারের। ছেলে মুসলিম মিয়াও বিয়ে করেছেন। তার রয়েছে তিন মেয়ে ও দুই ছেলে রয়েছে। জুহেরা বেগম স্বামীর মুক্তিযোদ্ধার ভাতার টাকা জমিয়ে এক শতাংশ জায়গা কিনেছিলেন। ওই জায়গায় ৩ লাখ টাকা ঋণ করে নিজেরা বসবাস করতে একটি ঘরও তুলেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধার ভাতার যে টাকা পান সেই টাকার একটি অংশ ঘরের ঋণ হিসেবে পরিশোধ করে যাচ্ছিলেন।
ঋণ করে মাথা গোঁজার ঠাই হতে না হতেই আবার নেমে আসে অশনিসংকেত । তার একমাত্র ছেলে মুসলিম মিয়া পাইলসে আক্রান্ত হন। সেই পাইলস ইনফেকশন হয়ে এখন ক্যান্সারে পরিণত হয়েছে। ছেলের ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে শেষ সম্বল ঋণ নিয়ে তৈরি করা ঘর ও ভিটা স্থানীয় একজনের কাছে বন্ধক রেখে দেড় লাখ টাকা নিয়েছেন।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ক্যান্সার ধরা পড়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগের ডা. আবু তাহেরের অধীনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিলেন।
শুক্রবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) তাকে কেমোথেরাপি দিতে নতুন করে আবার জাতীয় ক্যান্সার ইন্সটিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। এখন অপারেশন করাতে প্রয়োজন প্রায় তিন লাখ টাকা।
কিন্তু এই অপারেশন করার সক্ষমতা নেই মুসলিম মিয়ার এবং জুহেরা বেগমের। সিএনজি চালানো বন্ধ রয়েছে তার। ছেলের স্ত্রী, সহ পাঁচ সন্তানসহ 'মা'কে নিয়ে আটজনের পরিবারে উপার্জনকারী এখন কেউ আর নেই। যে কারণে খেয়ে বেঁচে থাকাই এখন কষ্টকর হয়ে পড়েছে তাদের। বীর মুক্তিযোদ্ধা নদু মিয়ার স্ত্রী জুহেরা বেগম ৭৭ বছর বয়সে আবার এলাকার মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ শুরু করেন। পুনরায় আবার তিনি মানুষের বাড়িতে কাজ করে ছেলে মুসলিম মিয়ার চিকিৎসার খরচ ও পরিবারের খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই বিষয় প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা নদু মিয়ার স্ত্রী জুহেরা বেগম বলেন, ‘কিছু করার নেই এখন আমার। এখন আমি মানুষের বাড়িতে কাজ না করলে কে খাওয়াবে আমাদের ? আমার জীবনটাই শুধু যুদ্ধের। ছেলে সিএনজি চালিয়ে সংসারের হাল ধরেছিল। কিন্তু সে নিজেই এখন অসুস্থ। কেউ সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে আসেনি। তাই ঋণ নিয়ে তৈরি করা ঘর ও ভিটার দলিল দিয়ে টাকা নিয়ে ছেলেকে ঢাকায় চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছি।’
জুহেরা বেগমের ছেলে মুসলিম মিয়া বলেন, ‘নিজের মা মানুষের বাড়িতে কাজ করবে তা সন্তান হিসেবে দেখতে খুব কষ্ট লাগছে। কিন্তু আটজনের সংসারে আয় করার মতো কেউ নেই। ঋণের টাকা এখনো পরিশোধ করতে পারিনি, এরই মধ্যে এই বিপদে ভিটাসহ ঘরটি বন্ধক দিয়ে চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে হচ্ছে।’ তিনি বিত্তবানদের কাছে সহায়তা কামনা করেন।
সুহিলপুর ইউনিয়নের পরিষদ চেয়ারম্যান আজাদ হাজারী আঙ্গুর বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা নদু মিয়ার পরিবারের বিষয়টি আমি শুনেছি। তারা আমাকে কিছু জানায়নি। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হওয়ায় আমি আমার সাধ্যমতো সহায়তা করার চেষ্টা করব।’
এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পঙ্কজ বড়ুয়া বলেন, ‘বিষয়টি অত্যন্ত মানবিক। তাদের পরিবারের একজন যোগাযোগ করেছিল। আমি সমাজ সেবার মাধ্যমে সহায়তার আবেদন করতে বলেছি, তারা আবেদন করেছে। সহায়তা সংক্রান্ত জেলার পরবর্তী সভায় মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হবে। আমি তাদের পাশে সার্বক্ষণিক থাকব।
আগামীনিউজ/জনী