নারায়নগঞ্জঃ গ্রাম বাংলার এক কালের ঐতিহ্য মাটির ঘর আজ আর তেমন একটা চোখে পড়ে না। প্রাচীন কাল থেকেই মাটির ঘরের প্রচলন। বেশি দিন আগের কথা নয়, রূপগঞ্জের প্রতিটি গ্রামে নজরে পড়তো সুদৃশ্য অসংখ্য মাটির ঘর। কালের আবর্তে আধুনিকতার ছোঁয়ায় প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছে মাটির তৈরি ঘরগুলো।
অত্যান্ত আরামদায়ক মাটির আবাস দরিদ্র মানুষের পাশাপাশি বিত্তবানেরাও তৈরি করে এক সময় পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করতেন। উপজেলার নাওড়া এলাকার মাটির ঘর তৈরির কারিগর সিরাজ মিয়া বলেন, ভাইরে এ দুইটা হাত দিয়া যে কত রঙ-বেরঙের, একতলা-দুতলা, নকশা আঁকা মাটির ঘর বানাইছি- তার কোনো সীমানা নাই। এখন মানুষ মাটির ঘর তৈরি করে না। সবাই পাকা দালান বাড়িঘর তৈরি করে। তাই পেশা পরিবর্তন করে এখন কল (সাম্বারসিবল, কমপেশার) মেরামতের কাজ করি।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন সে মাটির ঘরে আর কেউ বসবাস করতে চায় না। তাই সে মাটির ঘর ভেঙ্গে এখন সেখানে নির্মাণ হচ্ছে ইটের তৈরি পাকা দালান। এক সময়ের মাটির ঘরগুলো ছিল গরমে ঠান্ডা আর শীতে গরম। যাকে বর্তমান সময়ে বলা হয় শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘর। এখন সেই মাটির ঘরে থাকতে চায় না বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরাও। বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিস্কারের ফলে আরাম-আয়েসের জন্য মানুষও নতুন নতুন প্রযুক্তি গ্রহন করছে। মানুষ সুশিক্ষিত হচ্ছে। নতুন নতুন জ্ঞান অর্জন করছেন। দেশ-বিদেশ ভ্রমন করে নতুন অনেক কিছু শিখছে। আধুঁনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। মাটির তৈরি ঘরের জায়গা দখল করে নিয়েছে ইট-পাথরের তৈরি পাকা ঘর। এছাড়া গ্রামাঞ্চলের মানুষও স্যাটেলাইট ডিজিটাল যুগে পূর্বের তুলনায় অনেক সচেতন, যার ফলে পাকা ঘরবাড়ি নির্মাণ করছে।
রূপগঞ্জের গ্রামাঞ্চলগুলো মাটির ঘরের গ্রাম হিসেবে খ্যাত ছিল। এই মাটির ঘরে অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের নকশা আঁকা থাকতো। পুরনো ঐতিহ্যের অনেক ছঁবি দেওয়ালগুলোতে আঁকা হতো। এই দেয়াল তৈরির কাজ যারা করতো তাদেরকে কারিগর বলা হতো। অনেকে দু’তালা মাটির ঘরও বানাতো। তারপর এতে বিভিন্ন ধরনের রং করতো। মাটির ঘরের কারিগর উপজেলার বরুনা গ্রামের নবী হোসেন বলেন, অনেক সুন্দর করে মাটির ঘর বানাতাম। আমার হাত দিয়াই হাজার হাজার মাটির ঘর বানইছি। এখন এগুলাইন শুধুই স্মৃতি। এখন আর কেউ মাটির ঘর বানায় না , তাই পেশা পরিবর্তন করে ফেলেছি।
জমি অথবা পুকুরের কাদা মাটি দিয়ে ৪/৫ ফুট চওড়া দেয়াল নির্মাণ করে মাটির ঘর তৈরি করা হতো। উচ্চতা প্রায় ১২-১৫ ফুট পর্যন্ত হতো। কাঁঠ বা সুপারি ও বাঁশের সিলিং তৈরি করে তার উপরে খড় অথবা টিনের ছাউনি দেয়া হতো। গৃহিনীরা হাতের স্পর্শে সেই মাটির ঘরের সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি করতো। মাটির ঘর বিলুপ্তির কারন হিসেবে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক আবহাওয়ায় মাটির ঘরগুলো বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশেষ ক্ষতি সাধন হচ্ছে। তাছাড়া গ্রামের মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক আধুনিক।
বর্তমানে রূপগঞ্জের প্রতিটি গ্রামেই আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন এসেছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সাহায্যে কায়িক পরিশ্রম করে হত দরিদ্র পরিবারগুলো ছোট্ট আকারের দালান নির্মাণ করছেন। দালানের উপর তুলছেন টিনের চালা। নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া, রূপগঞ্জ সদর,ভোলাব, দাউদপুর,ভুলতা, গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই ও কাঞ্চন এবং তারাবো পৌরসভাতে এ মাটির ঘর চোখে পড়ত। লাল মাটি বা আটালো মাটি সহজলভ্য সেখানে এই ঘরগুলো তৈরি করা হতো।
এই মাটির ঘরগুলোকে স্থানীয়ভাবে কোঠা ঘর বলা হতো। ঘরের গাঁতুনি দেওয়ার সময় কারিগররা মাটিকে ভালভাবে পিষিয়ে তাতে ছোট্ট ছোট্ট টুকরো করে পাটের আঁশ বা খড় বা ধানের চিটা বা কুঁড়া মিশিয়ে দিত। এতে করে মাটি দীর্ঘস্থায়ীভাবে আঁকড়ে ধরে থাকতো। কারিগররা একটি ঘরের চারিদিকে একস্তরে ২ ফুট প্রস্থে মাটি দিয়ে দু’ এক দিন রোদে শুকিয়ে আবার গাঁথুনি শুরু করেন। এ ঘর তৈরির উপযুক্ত সময় ছিল শুষ্ক মৌসুম। এভাবে মাটির ঘর তৈরি করে ছাঁদ হিসেবে বাঁশ ও তার উপরে অন্তত ১ ফুট মাটির প্রলেপ দেয়া হতো। কেউবা ছনের ছাঁদও দিত। অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছলরা অবশ্য টিনের ছাঁদ দিত। ফলে এ ঘরটিতে সবসময় ঠান্ডা আবহাওয়া বিরাজ করতো। এমনকি আগুন লাগলেও ঘরের সব আসবাবপত্র পুড়ে যেত না।
ঘরের ভেতর ও বাইরে আকর্ষনীয় করার জন্যে গ্রামীন আল্পনায় কাদা-পানি দিয়ে প্রলেপ দিয়ে থাকেন। কেউবা এই মাটির ঘরে সিমেন্টের প্রলেপ দিয়ে আরও মজবুত করে তাতে রং বা চুন লাগিয়ে দিত। দুর থেকে দেখে মনে হতো এটি একটি পাকা দালান বাড়ি। এ ব্যাপাওে উপজেলা পরিসংখ্যান অফিসার মোঃ নুরুদ্দিন মিয়া বলেন, এক সময় রূপগঞ্জে কয়েক লক্ষাধিক মাটির ঘর থাকলেও আজ হাতে গোনা দু’একটা চোখে পরে। তাও আবার ঝড়াজীর্ণ, বসবাসের অযোগ্য। পরিতাপের বিষয় কালের আবর্তে কয়েক বছর ধরে এই মাটির ঘর কেউ নতুন করে আর তুলছেন না। ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে হাজার বছরের গ্রামীন ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর।
আগামীনিউজ/জনী