নারায়নগঞ্জঃ আসছে রমজান। রমজান শেষেই ঈদের আনন্দ। রমজান মাস আর ঈদকে ঘিরে রূপগঞ্জের টুপি পল্লীতে এখন ব্যস্ত সময় পার করছে টুপির কারিগরেরা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, রূপগঞ্জের নারীদের নিপুণ হাতের তৈরি করা টুপি দেশের গন্ডি পেরিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বাজার মাত করেছে। রাজধানী ঢাকার মতিঝিলের বড় একটি অট্রালিটায় দাড়িয়ে পূর্বদিকে তাকালে যে সবুজ-শ্যামল ছায়া এলাকা চোখে পড়বে সেটা রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া এলাকা।
এখানকার অধিকাংশ মানুষই কৃষক ও দিনমজুর। বছরের অর্ধেকটা সময় এলাকাটি থাকে জলমগ্ন। অর্ধাহারে,অনাহারে কাটে তাদের দিন। সংসারের কর্মক্ষম পুরুষটি হয় চাষী,নয়তো দিন শ্রমিক কেউ কেউ ঢাকার রাজপথে রিক্সার প্যাডেল মেরে উৎস খুঁজেন দু-বেলা দু-মুঠো ভাতের। ৯০’র দশকে এই এলাকার রকমতউলাহ এক ব্যবসা নিয়ে এসে এলাকার দৃশ্যপট বদলে দেন। উনুন জ্বালিয়ে আর হাড়ি ঘষে কাটতো এসব এলাকার বৌ-ঝিদের সময়।
রহমতুল্লার বদৌলতে এ এলাকার নারীরা নিপুন সূচীকর্মের শিল্পীর মর্যাদা পান। কুশি কাটা নামক একটি সুই আর এক দলা সুতোর সামান্য সরঞ্জাম দিয়ে তৈরী করা হচ্ছে বাহারি ডিজাইন আর বিভিন্ন নামের টুপি। এই টুপি দেশের বাজার ছাড়িয়ে এখন ওমান,সৌদি,কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের ধনকুবেরদের মন কেড়েছে। এ ইউনিয়নের ১৬ গ্রামের প্রায় ৮০ ভাগ নারী ঘরে বসে মাসে আয় করছেন ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। টুপি তৈরীর বাড়তি আয়ে তাদের সংসারে ফিরে এসেছে স্বচ্ছলতা। সন্তানরা হয়েছে স্কুলমুখি। বেছেড়ে পুরুষদের কর্মসংস্থান।
টুপির গ্রামঃ টুপির গ্রাম বলতে উপজেলার কায়েতপাড়ার মাঝিনা নদীর পাড় এলাকাকে এক নামে চেনেন এখানকার সবাই। শীতলক্ষ্যার তীরঘেষা গ্রামের শুরুতেই টুপির মহাজন আলী হোসেনের বাড়ী। বাড়িতে প্রবেশ করতেই দেখা যায় ১০/১২জন নারী ব্যস্ত হাতে সুতোয় গিটের পর গিট বেধে তৈরী করছেন একেকটি টুপি।
জানা যায় একটি গিট্রু টুপি তৈরী করতে একজন দক্ষ কারিগরের সময় লাগে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট। মাকর, বিস্কিট কিংবা অন্যকোন ডিজাইনের হলে সময় লাগে আরেকটু বেশী। মহাজন আলী হোসেন জানান, রোজা ও ঈদকে সামনে রেখে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে টুপির গ্রামে। কারিগরেরা সবাই ব্যস্ত এই মৌসুমে দু-পয়সা কামিয়ে নেওয়ার জন্য। বর্তমানে যে টুপি তৈরী হচ্ছে এগুলো রপ্তানী হবে মধ্যেপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। সেজন্য নিখুতভাবে তৈরী হচ্ছে একেকটি টুপি। আর পুরো রমজান মাস জুড়ে যেসব টুপি তৈরী হবে সেগুলো আমাদের দেশের জন্য।
টুপির বানিজ্যিক প্রতিনিধি আলী হোসেন মহাজন আরো জানান, রপ্তানীকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে টুপির ডিজাইন ও উপকরন সরবরাহ করা হয়। এ জন্য প্রতিনিধিকে নির্ধারিত পরিমানে জামানত দিতে হয়। প্রাপ্ত উপকরন দিয়ে প্রশিক্ষিত নারী কর্মীদের মাধ্যমে নক্শা অনুযায়ী টুপির দুই অংশ (ঘিরা ও তালু)তৈরী করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঐ প্রতিষ্ঠানের কাছে পৌছে দিতে হয়।
সরেজমিনে টুপি তৈরীর গ্রাম রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নের মাঝিনা নদীরপাড় এলাকায় গিয়ে জানা যায়, কায়েতপাড়া ইউনিয়নের ইছাখালী, ছাতিয়ান, হনিরা,পাড়াগাও,মাঝিনা, নাওড়া, পূর্বগ্রাম, বড়ালু, পশ্চিমগাঁও, পূর্ব চনপাড়া, ভাওলিয়াপাড়া, কেওঢালা, খামারপাড়া, তালাশকুর, নগরপাড়াসহ ১৬টি গ্রামের প্রায় ৪ হাজার নারী কারিগর প্রতিনিয়ত টুপি তৈরী করে যাচ্ছে। রফতানীকারী প্রতিষ্ঠান গুলোর প্রচেষ্ঠায় টুপির বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। টুপির বাজার সম্প্রসারিত হওয়ায় বাড়ছে টুপির চাহিদা, বাড়ছে কারিগরের সংখ্যা। কায়েতপাড়া ইউনিয়নের এ গ্রামগুলো এখন এক কর্মমূখর জনপদ। অন্যদিকে রাজধানীর ডেমরা থানার নড়াইপুর, মীরপাড়া, রাজাখালী, কামার পাড়া, আমুলিয়া, ঠুলঠুলিয়া, দূর্গাপুর, খলাপাড়া, ধিৎপুর প্রায় ১২টি গ্রামেও চলছে টুপি তৈরীর কাজ। এলাকার গৃহবধূরা সংসারের কাজকর্মের পাশাপাশি টুপি তৈরী করে আয় করছেন বাড়তি পয়সা।
শুরুর কথাঃ রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের ইছাখালী এলাকার টুপির মহাজন রকমতউলাহ জানান, ১৯৯০ সালে তিনি ঢাকার চকবাজারের একটি প্রতিষ্ঠানের উৎসাহে ওয়ার্কসপের কাজ ছেড়ে টুপি তৈরীর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ শুরু করেন। প্রথমে স্থানীয় এলাকায় ২০/২৫ জন দরিদ্র নারীকে ডিজাইন অনুযায়ী বিশেষ ধরনের টুপি তৈরীর প্রশিক্ষন দিয়ে উৎপাদন শুরু করান। আস্তে আস্তে আশেপাশের গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে টুুপি তৈরির কাজ। কেউ শখের বশে,কেউবা প্রয়োজনে আকড়ে ধরেন এটাকে। নেশা আর পেশা মিলিয়ে বর্তমানে পেশাদার কারিগর রয়েছে প্রায় ৪ হাজার । তাদের সবাই নারী। মহাজন বা প্রতিনিধি রয়েছে ২০/২৫জন। যাদের অধিনে তৈরী হয় টুপি।
রকমতউলাহ জানান, তার অধীনে দু’শ নারী টুপি তৈরীর কাজ করছে। এলাকার সবচেয়ে বড় মহাজন বা প্রতিনিধি হচ্ছেন কায়েতপাড়ার মাঝিনা নদীর পাড় গ্রামের আলী হোসেন। মহাজন আলী হোসেনের অধীনে প্রায় ১ হাজার নারী টুপি তৈরীর কাজ করছেন। এ ছাড়া আরও ২০/২৫ জন মহাজনের অধীনে প্রায় দুই আড়াই হাজার নারী টুপি তৈরীর কাজ করছেন বলে তিনি জানান। এছাড়া রয়েছে বেশ কয়েকজন দাদন ব্যবসায়ী।
টুপির কারিগর পূর্বগ্রাম দক্ষিনপাড়া এলাকার মাহফুজা আক্তার জানান, টুপির কারিগরদের বেশীর ভাগই আর্থিক ভাবে অসচ্ছল হওয়ায় তারা দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে সুতা কিনে টুপি তৈরী করে থাকে। দাদন ব্যবসায়ীদের মধ্যে ডেমরার নড়াইপুর এলাকার নয়ন মিয়া ও ফারুক হোসেনের কাছ থেকেই কারিগররা বেশীর ভাগ দাদন নিয়ে থাকে। তারা দু’জন টুপির বড় ব্যবসায়ী হওয়ায় তাদের কাছ থেকেই করিগররা,বেশী দাদন নিয়ে থাকে।
টুপি কারিগরদের কথাঃ ইছাখালী গ্রামের লাল মাসুদ এলাকার দুঃস্থ নারীদের নিয়ে ইট ভাংগা থেকে শুরু করে মাটি কাটা ক্ষেত খামারে রোজের শ্রমিক আরো বিভিন্ন ধরনের কাজ করতেন। ১৯৯৬ সালে তিনি পেশার পরিবর্তন ঘটিয়ে সেইসব নারীকেই প্রশিক্ষনের মাধ্যেমে দক্ষ করে টুপির কারিগর হিসেবে গড়ে তুলেন। বর্তমানে তার অধীনে ৩’শ নারী টুপি তৈরীর কাজ করছেন। তিনি জানান, এখন শুধু দরিদ্র নারীরাই নয়, মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীরাও টুপি তৈরীর কাজে এগিয়ে এসেছে। এর মাধ্যমে বাড়তি আয় করছে তারা। তার দুই পুত্র বধূ নাসিমা, রেহেনা নিজেরা টুপি তৈরী করছে এবং অন্যান্য নারীদের টুপি তৈরীর প্রশিক্ষন দিচ্ছে। এতে সংসারে এসেছে স্বচ্ছলতা।
নগরপাড়া গ্রামের টুপি কারিগর রাহাতুর বেগমের স্বামী নজরুল ইসলাম একজন দিনমজুর। স্বামীর একার আয়ে সংসারের অভাব-অনটন কাটে না। এ অবস্থায় ২০০৫ সালে রাহাতুর বেগম ও তার মেয়ে লিজা আক্তার টুপি তৈরী শুরু করেন। মা ও মেয়ে মিলে মাসে গড়ে ৬’শ টুপি তৈরী করে অতিরিক্ত ৪/৫ হাজার টাকা আয় করছেন। যা তার সংসারে সচ্ছলতা এনেছে। বড়ালু গ্রামের টুপির কারিগর গুলেনূর বেগমের স্বামী রতন মিয়া পেশায় দিনশ্রমিক।
গুলেনুর বেগম জানান, গত ৩ বছর যাবৎ টুপি তৈরী করে সাংসারিক খরচের পাশাপাশি ব্যাংকে ২৩ হাজার টাকা জমিয়েছেন। জমানো টাকা দিয়ে নতুন টিনের ঘর করবেন বলে তিনি জানান। ইছাখালী গ্রামের মাসুমা বেগমের স্বামী লোকমান রিক্সা চালক। মাসুমার টুপি তৈরীর আয় দিয়ে বাড়ি করার জন্য জমি কিনেছেন বলে জানান। একই এলাকার এসএসসি পাস শারমীন আক্তার, রত্না, জিনিয়ার মতো শিক্ষিত সচ্ছল পরিবারের মেয়েরাও টুপি তৈরী করছেন অনেকটা শখের বশে। এতে তাদের হাতে বাড়তি যে টাকা আসছে, তা দিয়ে তারা শখের পোষাক ও প্রসাধনী ছাড়াও মোবাইল ফোন কার্ড কিনতে পারছেন সহজেই। মাঝিনা নদীরপাড় গ্রামের শিমলা, আয়েশা, যুথি, হাসিনা, সাবেরা, ফাতেমা, নীলিমা, স্বর্ণা, পূর্বগ্রাম দক্ষিনপাড়া এলাকার মাহফুজা আক্তার, লতা, তুলিসহ অনেকে টুপি তৈরীর অর্থ দিয়ে নিজেদের পড়াশুনার ব্যয় মেটাচ্ছেন বলে জানান।
টুপির বাজারঃ টুপির সবচেয়ে বড় বাজার রয়েছে চকবাজারে। এ ছাড়া বায়তুল মোকারমে রয়েছে আরেকটি বাজার। ঢাকার ফুটপাত গুলোতেও পসরা সাজিয়ে বসে টুপি বিক্রেতারা। এসব মার্কেটে যায় রূপগঞ্জের টুপি। চকবাজারের সাউদিয়া ট্রেডার্সের মালিক বদির উদ্দিন ইরান বলেন, আগে টুপির ব্যবসা ভালো ছিল। এখন মেশিনে কাপড়ের টুপি তৈরী হওয়ায় সুতার টুপির কদর কমে গেছে। তবে যারা চেনেন তারা হাতের টুপিকেই বেশী মূল্যায়ন করেন। হাতের টুপির সবচেয়ে বেশী ক্রেতা শৌখিন মানুষেরা। চকবাজারের ওসমানীয়া ট্রেডার্সের মালিক ওসমান গনী শফি জানান, আমরা দেশের বাইরে যেসব টুপি এক্সপোর্ট করছি সবই হাতের তৈরী। তবে মাঝখানের মহাজন আর দাদন ব্যবসায়ীরা না থাকলে আমরা আরেকটু ভালো লাভ করতে পারতাম। কারিগররাও দু‘পয়সা বেশী পেতো।
বাহারি নামে টুপিঃ বাহারি নামের টুপি এখানকার কারিগররা তৈরী করে থাকেন। এর মধ্যে তারকা টুপি, হাফলং টুপি, বিস্কুট টুপি, মাকর টুপি, গিট্টু টুপি তৈরী হয় বেশী। একটি গিট্টু টুপি তৈরীতে খরচ পড়ে ৩০/৩২ টাকা। আর এ টুপি বিক্রি হয় চকবাজারে ৪৫/৫০ টাকায়। তবে কারিগররা ৭/৮ টাকার বেশী পায়না। মাঝখানে মহাজন বা প্রতিনিধি এবং দাদন ব্যবসায়ীরা লাভের অর্ধেক অংশ নিয়ে নেয়।
শেষের কথাঃ যেখানে রাজধানীর বুভুক্ষ মানুষেরা জীবন জীবিকার জন্য যেভাবে সংগ্রাম করে বেড়াচ্ছেন। সেখানে রাজধানী ঢাকার মাত্র ৫ কিলোমিটার দুরে রূপগঞ্জের কায়েতপ্ড়াায় নারীদের বাড়িতে বসে বাড়তি আয়ের কারনে ঘটে গেছে সামাজিক বিপ্লব। মাত্র ২০ বছর আগেও এলাকার মানুষ খেয়ে না খেয়ে থাকতো। কিন্তু এখন আর সেদিন নেই। এখন তাদের ছেলে মেয়েরাও স্কুলে যায়। বাড়িতে এসেছে ইলেকট্রিসিটি, ফ্রীজ, রঙ্গীন টেলিভিশন। সবই পরিশ্রমের ফসল।
সময়ের আবর্তে টুপি শিল্পে খানিকটা ভাটা এলেও সঠিক পৃষ্টপোষকতা আর আর্থিক সহায়তার আশ্বাস পেলে টুপি শিল্প হতে পারে রপ্তানির মাধ্যেমে বৈদেশিক মূদ্রা উপার্জনের অন্যতম উৎস। এজন্য প্রয়োজন সরকারি কিংবা বেসরকারি উদ্যোগ। যদি সামান্য প্রশিক্ষন আর পৃষ্টপোষকতা করে অভাবি ছিন্নমূল মানুষের হাতে কাজটা ধরিয়ে দেয়া যায়। তাহলে বাংলাদেশের টুপি শিল্প হতে পারে রপ্তানীর অন্যতম উপাদান।
আগামীনিউজ/এএস