ঢাকাঃ বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে ধর্ম, বিশেষ করে ইসলাম একটি বড় ‘ফ্যাক্টর'৷ তবে সংখ্যালঘুদের ভোট পেতেও ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে, হচ্ছে৷ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো জোটের অন্তর্ভূক্ত হয়ে সংসদে যায়, এমনকি মন্ত্রীত্বও পায়৷
১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের সংবিধানে সেক্যুলারিজমকে একটি রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। বাংলায় একে বলা হয় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। যেভাবে সেক্যুলারিজমকে তখন দেখা হয়েছিল, তাতে করে জনপরিসরে রাজনীতি ও ধর্মের বিভাজন থাকার কথা ছিল, রাষ্ট্রের এক ধরনের নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার প্রতিশ্রুতি ছিল। এই অবস্থানের কারণ ছিল এই যে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আমলে ইসলাম ধর্মকে আইডিওলজি বা ভাবাদর্শের জায়গায় স্থাপন করে শাসনের হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছিল। কিন্তু ৫০ বছর পরে, আজ বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রে ধর্ম ফিরে এসেছে। রাজনৈতিক নেতাদের বক্তৃতায় ধর্মের উদ্ধৃতির ছড়াছড়ি, ক্ষমতাসীন দল ইসলামপন্থীদের তোষণে ব্যস্ত, বিরোধী দল ইসলামপন্থীদের সঙ্গে তৈরি করা গাঁটছড়ার জালে আটকা পড়ে আছে এবং ধর্মভিত্তিক দলগুলো রাজনীতিতে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে। ধর্ম হয়ে উঠেছে ভাবাদর্শ।
ধর্মের রাজনীতিতে ফিরে আসার যাত্রা কার্যত শুরু হয়েছে ’৭২–এর সংবিধান রচনার অল্প কিছুদিন পর থেকেই। সেক্যুলারিজমের তত্ত্বটি সঠিকভাবে ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে জনসাধারণ কেউ বুঝে উঠতে পারেননি, অথবা সমাজে এই বোঝাপড়া তৈরির কোনো প্রক্রিয়াও শুরু করা হয়নি। ধর্ম এবং রাজনীতির সম্পর্ক এবং রাষ্ট্র ও ধর্মের সম্পর্কের বিভিন্ন জটিল ও অনুপুঙ্খ বিষয় নিয়ে সমাজে আলোচনা হয়নি, বিতর্কের সুযোগ তৈরি করা হয়নি। একার্থে সমাজের এক এলিট অংশ যেভাবে বিবেচনা করেছেন তাকেই সবার মত বলে উপস্থাপন করা হয়েছে। তার পরে সামরিক সরকারগুলো তাদের বৈধতার সংকট মোচনে ধর্ম এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দ্বারস্থ হয়েছে; সংবিধান বদল এবং ধর্মভিত্তিক দলের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছে।
১৯৭৮ সালে সংবিধান থেকে সেক্যুলারিজম বাদ দেওয়া হয় এবং ১৯৮৮ সালে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও ইসলামপন্থী দলগুলো অংশগ্রহণ করে। ১৯৯১–পরবর্তী গণতান্ত্রিক পর্বেও ক্ষমতাসীন ও বিরোধী জোট তাদের ক্ষমতা রক্ষা ও দখলের লড়াইয়ে ইসলামপন্থীদের সঙ্গে মিত্রতা করে; আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সহিংস শত্রুতা ইসলামপন্থীদের উত্থানে এবং শক্তি সঞ্চয়ে সহযোগিতা করেছে এটা অনস্বীকার্য। গত কয়েক দশকে যেমন সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক ডিসকোর্সে ধর্মকে নিয়ে এসেছে এবং ধর্মীয় ক্রীড়নকদের বৈধতা দিয়েছে, তেমনি ইসলামপন্থী সংগঠন ও আন্দোলনগুলো সমাজে ধর্মের প্রভাব বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিকদের জাতীয় আত্মপরিচয়ের সঙ্গে ধর্মের প্রসঙ্গকে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলা হয় যেন নৃতাত্ত্বিক বাঙালি পরিচয়ের সঙ্গে ইসলাম ধর্ম অনুসরণের একটি বিরোধ রয়েছে। অথচ দীর্ঘ দিনের ইতিহাস বাঙালির বহুমাত্রিক পরিচয়ের প্রমাণ দেয়।
রাজনীতিতে অভিনয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে নির্বাচনের মৌসুমে এই অভিনয়ে কে কতটা পারদর্শিতার সাক্ষর রাখতে পারেন, তার উপর নির্ভর করে ভোটাররা তাকে কতটা আস্থায় নেবে অথবা নেবে না। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারও নতুন কিছু নয়। কিন্তু ধর্মকে কে কতটা সাফল্যের সাথে ব্যবহার করতে পারলেন, তার উপরে নির্ভর করে ধর্মীয় অনুভূতি তার পক্ষে থাকবে কি থাকবে না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ধর্ম, ধর্মীয় পোশাক ও অভিনয়কলার চর্চা বহুদিনের। অভিনয়প্রিয় বাঙালিও এসব বেশ খায়। বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় এই ধর্মীয় লেবাসের ব্যবহার বেড়ে যায়। যে কারণে দেখা যায়, ব্যক্তিজীবনে ধর্মীয় রীতি-নীতির ধারেকাছে না গেলেও বা ধর্মে বিশ্বাসী না হওয়া সত্ত্বেও ভোটের রাজনীতিতে তারা মাথায় টুপি এবং অন্যান্য ধর্মীয় পোশাকে নিজেদের আচ্ছাদিত করেন। যেহেতু বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ, সে কারণে ধর্মীয় পোশাক বললে মাথায় টুপি এবং এ জাতীয় পোশাককেই বোঝায়। যারা সারা বছর ওয়েস্টার্ন স্যুট-বুট-টাই পরে থাকেন, তারাও মাথায় টুপি দিয়ে জনগণের কাছে ভোট চাইতে যান।
গরু জবাই করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রেখে ভারতের গুজরাট রাজ্যে যেদিন পশু সংরক্ষণ আইন সংশোধনের খবর আসে, একই সময়ে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে একটি ভাস্কর্য (মূর্তি) অপসারণের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। প্রতিবেশি দুটি রাষ্ট্রের এ দুটি তৎপরতার মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া কঠিন।
সন্ত্রাস পৃথিবীব্যাপী পরিচিত, বহুল আলোচিত শব্দ। সন্ত্রাস ও জঙ্গি তৎপরতা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অভিশাপ এবং মানবতার প্রতি চরম হুমকি। রাজনৈতিক কারণে হোক বা অন্য কোন ব্যাপারে স্বার্থসিদ্ধি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করার নিমিত্তে বোমা বিস্ফোরণ, অপহরণ, ভয়-ভীতি বা গুপ্ত হত্যার মত ঘৃণ্য কাজই হলো ‘সন্ত্রাসবাদ’; যা সভ্য সমাজে সাধারণত গ্রহণযোগ্য নয়। সন্ত্রাসের কোন ধর্মীয় ভিত্তি নেই, ইসলাম ধর্মে এটি ঘৃণ্যতম কাজ। ভীতি তথা ফিতনা সৃষ্টি হত্যার চাইতেও মারাত্মক। ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্ম, বর্ণ, জাতিগোষ্ঠী নির্বিশেষে সব মানুষের প্রাণ, সম্পদ, মর্যাদা অত্যন্ত পবিত্র। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কারো জীবন রক্ষা করে, সে যেন সবার জীবন রক্ষা করল।’
জোর করে, শক্তি প্রয়োগ করে বা অস্ত্রের বলে ইসলামের আদর্শ কোথাও প্রচারিত হয়নি। ইসলাম টিকে আছে এবং টিকে থাকবে তার কালজয়ী আদর্শ, অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার কারণে। ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে পারস্পরিক সহ-অবস্থান, সহিষ্ণুতা, মানবিক আচরণ ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। ইসলামে সন্ত্রাসের ঠাঁই নেই, প্রকৃত মুসলমানরা কখনও সন্ত্রাস করতে পারে না। ইসলাম হচ্ছে শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম। তাই এর অনুসারীরা মানুষ হত্যা করতে পারে না, সম্পত্তি বিনষ্ট করতে পারে না। শুধু তাই নয়, কোন মুসলমান নিছক রাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে মানুষ তো দূরের কথা অন্য কোন প্রাণীও হত্যা করতে পারে না।
নিজ ধর্মের ইমাম ও অন্য ধর্মের পুরোহিতদের হত্যা, হুমকি, বোমাবাজি, আতঙ্ক সৃষ্টি, বিদেশীদের জিম্মি বানিয়ে হত্যার মত সন্ত্রাসবাদের দূরপ্রসারী প্রভাব তো আছেই, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াও ব্যাপক। যেমন এতে বিশ্ববাসীর কাছে ইসলাম সম্পর্কে ভুল বার্তা যায়। নাম, টুপি-দাড়ি, হিজাব, বোরকা-জিলবাব মুসলমানদের পরিচয় ও ঐতিহ্য বহন করে। বিদেশ বিভূঁইয়ে বসবাসরত মুসলমান নারী-পুরুষ এই ঐতিহ্য লালন ও ধারণে ভীতিসন্ত্রস্ত হচ্ছেন। পথে অপদস্থ হওয়ার বহু ঘটনা ইতোমধ্যে ঘটেছে।
যে দেশে বিদেশী ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী ও দাতাসংস্থার পরামর্শক সন্ত্রাসীদের হাতে মারা যায়, স্বাভাবিকভাকে সে দেশে বৈদেশিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও বিদেশী সাহায্য বাধাগ্রস্থ হয়। এতে দেশের ভাবমূর্তির মারাত্মক ক্ষতি হয়। তখন জঙ্গিদমনে সহায়তা দানের প্রস্তাব নিয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গি তৎপরতা আগে নির্দিষ্ট কতিপয় দেশে বা অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। ইদানিং পশ্চিম এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত সশস্ত্র লোকেরা হামলা করার জন্য মার্কেট, হোটেল, গণপরিবহণের স্টেশন, বিমান বন্দর, ধর্মীয় উপাসনালয় বেছে নেয়। আত্মঘাতী বোমার আঘাতে নিজেও উড়ে যায় অন্যদেরকেও উড়িয়ে দেয়। এখন পৃথিবীর কোন জায়গাই আর নিরাপদ নয়। সবাই ঝুঁকিতে। সন্ত্রাসবাদের সাথে ধর্মের সম্পর্ক নেই।
ধর্মকে ব্যবহার করা হয় স্বার্থ হাসিলের জন্য। ধর্ম এখানে মূল অবলম্বন নয় আনুষঙ্গিক মাত্র। কেউ নিজেদেরকে সুন্নি, মুজাহিদ, আল্লাহর পথের যোদ্ধা, হকপন্থী, তাগুতের যম, বখতিয়ারের তলোয়ার, সালাহুদ্দিনের ঘোড়া, তিতুমীরের কেল্লা, খিলাফত প্রতিষ্ঠার সৈনিক ইত্যাদি পরিভাষায় পরিচয় দিলে খোঁজ খবর নিতে হবে, চালাতে হবে অনুসন্ধান। উৎস কোথায়, উদ্দেশ্য কী? ইসলামের মৌল আদর্শ-শিক্ষার সাথে তাঁদের কর্মতৎপরতার সাদৃশ্য ও বৈশাদৃশ্য কী? জানতে হবে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামদের মহিমান্বিত জীবনধারার সাথে তাদের কর্ম প্রয়াস ও তৎপরতার মিল আছে কি না। কেউ যদি কপালে ‘আল্লাহু আকবার’ ব্যাজ লাগিয়ে অথবা ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে সশস্ত্র অভিযান চালায় তাৎক্ষণিক পুলকিত হওয়ার কোন কারণ নেই। কেবলমাত্র ধর্মীয় পরিভাষার উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিলে সমূহ বিপদে পড়ার আশঙ্কা বিদ্যমান।
আমাদের মনে রাখতে হবে হযরত আলী (রা.)-এর জামানায় ধর্মীয় উগ্রগোষ্ঠী খারিজী সম্প্রদায় ‘ইনিল হুক্মু ইল্লালিল্লাহ’ শ্লোগান দিয়ে বিদ্রোহ করেছিল। মুসলিম বিশ্বে তারা সমূহ বিপর্যয় সৃষ্টি করে। তাঁদের হাতে বহু মুসলমান শাহাদত বরণ করেন। হযরত আলী (রা.)-কে শহীদ করার পর ঘাতক আবদুর রহমান ইবন মুলজিম উচ্চৈঃস্বরে আল্লাহ আল্লাহ যিকির করছিল।
সন্ত্রাসবাদের যারা মূলহোতা তারা দূর থেকে পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। তাদের অর্থের অভাব নেই। দুনিয়াজুড়ে তাদের নেটওয়ার্ক। তাদের পরিচয় কী তদন্ত ছাড়া স্পষ্ট করে বলা যাবে না। তবে আঁচ করা যায়। এক দিন তাদের মুখোশ খসে পড়বে। তরুণ ও যুবকরা তাদের টার্গেট। মানুষ চেতনা ও আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয়। বৃদ্ধদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত তরুণদের মন মগজে চেতনা-আবেগ থাকে অধিক সক্রিয়। পবিত্র জিহাদের ডাক, তাগুতের উৎখাত, জান্নাতের প্রত্যাশা, খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে সামনে রেখে বাছাইকৃত তরুণদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এবং তুলে দেয়া অস্ত্র, বোমা ও গ্রেনেড। তারুণ্যের উচ্ছ্বাসজনিত দুঃসাহসিকতাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুসলমানের ছেলেরা বুঝতে পারে না যে তারা অন্যের হয়ে কাজ করছে।
এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবি ও মিডিয়া প্রচারণা চালাত যে, মাদরাসার ছাত্রগণ সন্ত্রাস ও জঙ্গি তৎপরতার সাথে জড়িত। তাঁদের মতে যেহেতু অধিকাংশ মাদরাসার ছাত্র সমাজের দরিদ্র শ্রেণী থেকে উঠে আসা; সহজেই মোহনীয় টাকার হাতছানি তাদের সন্ত্রসবাদের সাথে যুক্ত করে। তাঁদের এ অভিযোগে সম্পূর্ণ অসত্য, মিথ্যা ও কাল্পনিক। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি প্রমাণ করে যে, এখন সন্ত্রাসী তৎপরতার সাথে যুক্ত তরুণরা সমাজের অতি বিত্তশালীদের সন্তান, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে উত্তীর্ণ ও দেশ-বিদেশের নামি-দামী সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া। এখন এর কী জবাব আছে? আমরা মনে করি সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী তৎপরতার জন্য কোন বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দায়ী নয়।
কূটনৈতিকপাড়া নামে খ্যাত ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গিদের হাতে ২০জন দেশী-বিদেশী প্রাণ হারানোর ঘটনায় দেশবাসী স্তম্ভিত, বেদনাহত ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। পবিত্র রামাযান মাসে নিরীহ মানুষদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড কেউ সহজে মেনে নিতে পারেননি। ইতালীর যেসব ব্যক্তি আমাদের দেশে গার্মেন্টস ব্যবসার সাথে জড়িত এবং ঢাকার মেট্রোরেলের পরামর্শক হিসেবে জাপানের যেসব প্রকৌশলী কর্মরত আমরা তাঁদের জিম্মি বানিয়ে জবাই করে দিলাম। তাঁরা তো কোন পক্ষ-বিপক্ষের লোক নয়, অপরাধী নয় বরং উন্নয়ন সহযোগী। এ হত্যাকাণ্ড কোন ধর্ম, আদর্শ, নৈতিকতা ও রাজনীতির মাপকাঠিতে পড়ে না।
এর ফলে ইসলাম ও বাংলাদেশ সম্পর্কে বহির্বিশ্বে ভুলবার্তা গেছে- কোন সন্দেহ নেই। পবিত্র ঈদের দিন শোলাকিয়া ঈদগাহের অনতিদূরে পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে দুজন কনস্টেবলসহ চার ব্যক্তি প্রাণ হারালেন। ঈদের দিনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই প্রথম। কারা আমার দেশের কম বয়সী তরুণদের হাতে অস্ত্র দিয়ে ইসলামের চেহারা কালিমা লিপ্ত করার প্রয়াস চালাল তাদের খুঁজে বের করে আইনের হাতে সোপর্দ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাজনৈতিক দোষারোপের পুরনো খেলায় মেতে উঠলে প্রকৃত অপরাধী গা ঢাকা দেবে, নির্দোষ মানুষ শাস্তি পাবে।
ইসলাম আগ বাড়িয়ে কাউকে আঘাত করে না, করেওনি। আমরা যদি রাসুলের জামানার কয়েকটা যুদ্ধ নিয়ে বিশ্লেষণ করি তবে দেখবো, প্রতিটি যুদ্ধই সংঘটিত করেছে কোফেরেরা, ইসলাম বা মুসলমানরা কখনোই যুদ্ধ সংঘটিত করেনি। বর্তমানে বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলাম যে নব্য ইসলাম প্রচার করছে তা মুসলমানদের জন্য এক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
ধর্মের নামে মানুষ হত্যা, জ্বালাও পোড়াও, ভাঙচুর সহ যে অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে হেফাজতীরা ইসলামের নাম ব্যবহার করে তা মুসলমানদের জন্য অশনিসংকেত! হেফাজতে ইসলাম কখনো ইসলাম হতে পারে না, ওরা নব্য ইয়াজিদী। রাষ্ট্রীয়ভাবে এই নব্য ইয়াজিদদের টুটি চেপে ধরতে হবে।
উল্লেখ্য, ধর্মভিত্তিক দল ও গ্রুপগুলো ভেতরে ভেতরে শক্তি সঞ্চয় করছে। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ও মোদীর বাংলাদেশে আগমনকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বড় বড় শোডাউনসহ সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনার মধ্যদিয়ে বিষয়টি দৃশ্যমান হয়েছে। হামলা ভাঙচুর জ্বালাও পোড়াওসহ নানান অপতৎপরতা চালিয়েছে।
এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনেও আলোচনা চলছে। ধর্মীয় ইস্যু ছাড়াও রাজনৈতিক স্পর্শকাতর অনেক বিষয় নিয়ে দলগুলো কথা বলছে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণ বন্ধের দাবি তুলেছে তারা, যা নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রীতিমতো অস্বস্তিতে পড়েছে। ধর্মভিত্তিক দলগুলোর এ ধরনের তৎপরতায় বিএনপিসহ বড় দলগুলোও চাপের মুখে। কারণ বিভিন্ন ইস্যুতে তারাও এভাবে শোডাউন করতে পারছে না। কিন্তু কি কারণে বাড়ছে অতি রক্ষণশীলদের প্রভাব? এই প্রশ্নের উত্তর বের করার চেষ্টা করছেন অনেকে। কেউ বলছেন- রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগে কট্টর ডানপন্থার উত্থান হচ্ছে।
বামপন্থী তথা প্রগতিশীদের আগের মতো তৎপরতা নেই। বিএনপিসহ বিরোধী অন্যান্য দলগুলোর তৎপরতাও সেভাবে নেই। এই সুযোগে ডানপন্থীদের তৎপরতা বেড়েছে শহর-গ্রাম সর্বত্র। তারাই এখন শূন্যস্থান পূরণের চেষ্টা করছে। রক্ষণশীলরা এখন আর ধর্মীয় বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নাই। রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছে। কর্মসূচিও পালন করছে। আবার কেউ মনে করছেন- আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে শুধুই ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণে ধর্মভিত্তিক দক্ষিণপন্থী দলগুলোর তৎপরতা বেড়েছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মাদ্রাসাভিত্তিক কিছু দল ও গ্রুপকে নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আস্কারা দিয়ে চলছে। এর মধ্যদিয়ে আসলে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের কবর নিজেরাই খনন করছেন। তার প্রমাণ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা। মাদ্রাসাভিত্তিক এই দল ও গ্রুপগুলো যদি কোনোদিন ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ পেয়ে যায়, তারা সব ভাস্কর্য তো গুড়িয়ে দেবেই, এ দেশ থেকে মুছে ফেলবে বঙ্গবন্ধুর নাম।
আগামীনিউজ/প্রভাত