ঢাকাঃ শীলা রানী গুহ। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি মিলিটারিরা তাকে ক্যান্টনমেন্টে আটকে রেখে বর্বর শারীরিক নির্যাতন চালায়। যুদ্ধ শেষে ঘরে ফিরেও বাবা-মায়ের কাছে মেলেনি তার ঠাঁই। স্বামীও ত্যাগ করেছিলেন বীরাঙ্গনা বলে। সেই বেদনাময় অধ্যায় তুলে ধরে শীলা বললেন- মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, আমার বয়স তখন ১৭-১৮ বছর। কাজ করতাম যাত্রাদলে। আমি তখন জনপ্রিয় নায়িকা। ১০ বছর বয়সেই যাত্রাদলে যোগ দিয়েছিলাম। একটু একটু করে নিজেকে গড়ে নিয়েছি। তার পরই হয়েছি নায়িকা। তখন আমি ছিলাম ‘মুন লাইট অপেরা’ দলে। খেলাঘর, মা ও ছেলে, কসাই নদীর তীরে, রমজানের চাঁদ ইত্যাদি পালা তখন মানুষের মুখে মুখে। সবার মুখে মুখে আমার নামও। আমাদের দল তখন উলিপুরে। চারপাশে ভীষণ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। কেবল শুনছি পাঞ্জাবি মিলিটারিরা আসছে। মানুষ মারছে। মানুষের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ উলিপুর অস্থায়ী ওয়্যারলেস অফিস আক্রমণ করল তারা। সে কী দৌড়াদৌড়ি শুরু হলো। সবার মধ্যেই তখন অস্থিরতা। চিন্তা করছি কীভাবে বাড়ি যাব। শুনলাম অনেকেই কলকাতার দিকে যাচ্ছে। এদিকে রেলগাড়ি বন্ধ। রেডিওতে খবরে বলে- আজ খুলবে, কাল খুলবে। কিন্তু খোলে না। এদিকে পয়সা-কড়ি হাতে নেই। কেবল ৯ টাকা আছে শাড়ির আঁচলে বাঁধা। মালিকের কাছে ছয় মাসের বেতন পাই। বাড়ি যাওয়ার সময় একসঙ্গে নিয়ে যাব বলে বেতন তুলিনি এতদিন। এখন কী হবে এ চিন্তায় অস্থির হয়ে আছি। তখনই হঠাৎ যমদূতের মতো কয়েকজন মিলিটারি আর রাজাকার পেছন থেকে এসে আমার মুখ বেঁধে ফেলল গামছা দিয়ে। একজন জাপটে ধরল। ছাড়া পাওয়ার জন্য আমি আঁকুপাঁকু করছি। কিন্তু ওদের শক্তির সঙ্গে আমি কি পারি! ওরা আমাকে নিয়ে গেল ক্যান্টনমেন্টে। টানা ছয়-সাত দিন সেখানে আটকে রেখে ওরা আমার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালায়। সে নির্যাতন ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। একজনের পর একজন আসত। অত্যাচার সইতে না পেরে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলতাম। তখন ওরা গরম চায়ের কাপে আমার হাত চুবিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনত। শরীরে সিগারেটের ছ্যাঁকা দিত। বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়েও রক্তাক্ত করেছে আমাকে। আমার শরীরের এমন কোনো জায়গা ছিল না যেখানে আঘাতের চিহ্ন নেই। কত আর সহ্য করা যায়। মৃতপ্রায় আমি আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। ওরা তখন ভাবল আমি মরে গেছি। এই ভেবে আমাকে ধানক্ষেতে ফেলে দিয়ে এলো। সেই পথে সাত্তার নামে পরিচিত এক লোক যাচ্ছিলেন। তিনি আমাকে পড়ে থাকতে দেখে তার বড় ভাই আবুলকে গিয়ে জানান। দুই ভাই তখন এসে আমাকে তুলে নিয়ে যান তাদের বাড়িতে। ডাক্তার দেখিয়ে, ওষুধ দিয়ে আমাকে কেবল একটু সুস্থ করে তুলেছে, তখনই আবার ওরা (পাকবাহিনী) খবর পেয়ে আমাকে ধরতে এলো। আবুল ভাই ওদের আসার খবর পেয়ে বাড়ির পেছনের চ্যাগারের বেড়া কেটে মধু নামের এক লোকের সঙ্গে আমাকে বের করে দেন। আর আবুল ভাই তার বউকে বলেন- মিলিটারিরা এসে মেয়ে চাইলে তুমি আমাদের নিজের মেয়েকে ওদের হাতে তুলে দিয়ো। কিন্তু আশ্রিতাকে দিও না। আমরা তো পালিয়ে গেলাম। কিন্তু মিলিটারিরা আমাকে না পেয়ে আবুল আর সাত্তার ভাইকেই ধরে নিয়ে গেল। আমরা নদী পার হয়ে যাচ্ছি। নদীতে হাঁটুজল। হেঁটেই পার হচ্ছি। মাঝ নদীতে গেছি। তখন খবর পেলাম মিলিটারিরা আবুল আর সাত্তার ভাইকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমাকে রক্ষা করতে তারা নিজের জীবন দিলেন। এই ঋণ আমি কী দিয়ে শোধ করব?
তার পর আমি মধুর বাড়িতে কয়েক দিন থাকলাম। ওখানে আরও দুজন মেয়ে ছিল। আবারও মিলিটারিরা খবর পেয়ে মধুর বাড়িতে এলো আমাদের নিয়ে যেতে। মধুদার একজন বয়স্ক চাচা ছিলেন। উনি খাটের নিচে গর্ত করে আমাদের লুকিয়ে রাখলেন। সেখান থেকেও আমাদের পালাতে হলো। রাস্তায় যেতে যেতে একটা দৃশ্য দেখেছিলাম। এখনো চোখে ভাসে। মিলিটারিদের অত্যাচারে একজন মা পাগল হয়ে গেছে। তার কোলের বাচ্চা পানিতে ভেসে যাচ্ছে। অথচ তিনি বালিশ কোলে নিয়ে ওটাই তার বাচ্চা ভেবে আদর করছেন। কিছু দূর যাওয়ার পর দেখি একটা গর্তে এক গর্ভবতী মা প্রসব ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। কিন্তু আমার সন্তান জন্মদানে সাহায্য করার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু কিছু তো করার নেই। সন্তানের মাথা চলে এসেছে। তখন আমিই তার ডেলিভারি করাই। কিন্তু নাড়ি কাটব কী দিয়ে। ব্লেড, ছুরি, কাঁচি তো নেই। তখন দাঁত দিয়েই নাড়ি কেটে শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে বেঁধে দিলাম। তার পর হাঁটতে শুরু করলাম। এক সময় স্টেশনে পৌঁছাই। এক টাকায় খিচুড়ি কিনে খেলাম। খাওয়ার পর আমার এমন ঘুম পেল যে, গাড়ি কখন যে ছেড়েছে জানিই না। গিয়ে নামলাম আশারাম বাড়ির খোয়াই নদীর কাছে। কিন্তু সেখান থেকে আমি বাড়ি যাব কেমন করে? সমস্ত শরীরে প্রচ- ব্যথা। আমি একটা গাছের নিচে বসে কাঁদছিলাম। তখন এক লোক এসে বললেন- মা আপনি কাঁদছেন কেন? আমি তাকে বললাম- আমি বাড়ি যাব। তিনি জানতে চাইলেন বাড়ি কোথায়? বললাম বাগেরহাট। তিনি তখন আমাকে বাড়ি পাঠাবেন বলে সঙ্গে নিয়ে গেলেন তাদের ক্যাম্পে। কমান্ডার সব শুনে বললেন- এখন তো পাঠানোও নিরাপদ না। দেশ তো আমাদের স্বাধীন হবেই একদিন। তখন বাড়ি যাবে। তখন আমি সেখানেই থেকে গেলাম। এর কিছু দিন পর শুনলাম দেশ স্বাধীন হয়েছে। অন্য অনেকের সঙ্গে আমিও দেশে ফিরলাম। গেলাম আমার নিজের বাড়ি। তত দিনে আমার গ্রামের সব লোক জেনে গেছে, আমাকে পাঞ্জাবিরা ক্যান্টনমেন্টে আটকে রেখেছিল। বাবা দুদিন রেখে বলল- তুই মা বাড়ি থেকে চলে যা। তুই থাকলে তোর ছোট দুই বোনের বিয়ে দিতে পারব না। তোর ভাই সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না। তুই কি তাই চাস?
আমি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। বাজারে কালাম খাঁ নামে এক লোক ছিল। সে যাত্রাদলের সঙ্গে কাজ করত। পরে সে-ই আমাকে ‘জামান অপেরা’য় ভর্তি করে দিল। বেতন না পেয়ে ওই দলও ছেড়ে দিলাম। যোগ দিলাম ‘বঙ্গশ্রী’ দলে। সেখানেই আমার বাচ্চার বাবার সঙ্গে পরিচয় হয়। সে-ই আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। তবে আমার সম্পর্কে সে কিছু জানত না। আমিও যেচে বলি নাই। আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। বড় মেয়ের জন্ম হলো। ঠিকই চলছিল সংসার। আমার ছোট মেয়ে তখন পেটে ছয় মাসের। একদিন বাজার থেকে আমার স্বামী সব শুনে এসে জানতে চাইল- পাঞ্জাবিরা কি তোমারে ধরে নিয়ে গেছিল? আমি আর মিথ্যে বলব ক্যামনে? বললাম- হ্যাঁ। সব শুনে সে বলল- শীলা তোমারে নিয়া ঘর করার চেয়ে তো বেশ্যারে নিয়া ঘর করা ভালো। আমি তোমার সঙ্গে থাকতে পারমু না। এই বলে সে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। সেখানে কিছু দিন থেকে আমি চলে গেলাম জামালপুরে। একটা যাত্রা দলে যোগ দিলাম। সেই দল থেকেই বায়না হলো শ্রীমঙ্গলে। তখন শ্রীমঙ্গলের লোকেরা বলল- শীলাদি তুমি এখানেই থেকে যাও। তোমার কাজের অভাব হবে না। আমি তখন থেকে এখানেই থেকে গেলাম। মেয়েদের নিয়ে অভাব অনটনে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি। সেটাও আমার দুঃখ না। আমার দুঃখ এইটাই যে, নারীর জীবনের সবচেয়ে যে সম্পদ, সেই সম্মান বিসর্জন দিতে হইছিল আমার। কিন্তু আমি বীরাঙ্গনা বা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিটা পাই নাই। কতবার কাগজপত্র জমা দিয়েছি। কিন্তু এখনো গেজেটে আমার নাম ওঠেনি। এখন প্রতি মাসে বয়স্ক ভাতা পাই। সরকার একটা ঘরও আমাকে করে দিয়েছে। শেখের বেটির কাছে আমার এখন একটাই চাওয়া- মৃত্যুর আগে আমি যেন গেজেটে আমার নামটা দেইখ্যা যাইতে পারি।
আগামীনিউজ/এএইচ