ঢাকায় মশার ঘনত্ব বেড়েছে চার গুণ

প্রভাত আহমেদ মার্চ ৯, ২০২১, ০১:৫৬ পিএম
ছবি: আগামী নিউজ

ঢাকাঃ রাজধানী ঢাকায় গত বছরের এই সময়ের তুলনায় বর্তমানে মশার ঘনত্ব বেড়েছে চার গুণ। আর মশা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেয়া না হলে আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত মশার ঘনত্ব বেড়ে চরমে পৌঁছাবে।
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় এমন তথ্য জানানো হয়েছে। গবেষণাটি পরিচালনা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, প্রতি মাসেই যাতে মশার ঘনত্ব কেমন হচ্ছে তা তুলনা করার জন্য এই গবেষণাটি পরিচালনা করছেন তিনি। এর অংশ হিসেবে জানুয়ারির শেষের দিকে তিনি দেখতে পান যে, মশার ঘনত্ব অন্য সময়ে যা থাকে তার চেয়ে চারগুণ বেশি বেড়েছে।

"গত বছরের এপ্রিল থেকে শুরু করা হলে জানুয়ারিতে অন্যান্য মাসের তুলনায় চারগুণ মশার ঘনত্ব পেয়েছি, বিশেষ করে লার্ভার ডেনসিটি।" মশার ঘনত্ব কেমন বাড়ছে সেটা জানতে ঢাকার উত্তরা, খিলগাও, শনির-আখড়া, শাঁখারিবাজার, মোহাম্মদপুর ও পরীবাগসহ ছয়টি এলাকার নমুনা নিয়ে গবেষণা চলছে। মি. বাশার জানান, "ছয়টা জায়গাতে গড় ঘনত্ব প্রতি ডিপে (মশার ঘনত্ব বের করার পরিমাপক) আমরা মশা পেয়েছি ৬০টিরও বেশি। যেখানে আমরা অন্যান্য সময় পাই ১৫-২০টি।"

এদিকে আঁতুড়ঘরেই মশা মেরে ফেলার চেষ্টায় সফল হতে পারল না ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। মশার চিহ্নিত বড় বড় প্রজননক্ষেত্রের পানিতে সাড়ে চার মাস আগে ওষুধ ডুবিয়ে রেখেছিল ডিএনসিসি। উদ্দেশ্য ছিল, পানিতে থাকা লার্ভা নষ্ট করে মশার বংশ বৃদ্ধি ঠেকানো। ডুবন্ত সেই ওষুধ কাজ করলে এখন মশা থাকত কম। শান্তিতে থাকত নগরবাসীর। কিন্তু মানুষ বলছে, তারা এখন মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ।

নোভালুরন নামের বিশেষ ওই ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে শুরুতেই প্রশ্ন তুলেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা ও কীটতত্ত্ব বিভাগের দুই শিক্ষক। অবশ্য ওষুধ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তাঁদের সঙ্গে দ্বিমত করে বলেছে, ঠিক জায়গায়, ঠিক মাত্রায় ব্যবহার না করায় ওষুধের উপকার পাওয়া যায়নি। সিটি করপোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এই দুই পক্ষের সঙ্গে পুরোপুরি একমত না হলেও ওষুধে আশানুরূপ ফল না পাওয়ার কথা মোটামুটি স্বীকার করেছেন।

গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিএনসিসি কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে ট্যাবলেট বা বড়ির মতো দেখতে নোভালুরন ওষুধ ব্যবহার শুরু করে। মশার প্রজনন ও বংশবিস্তারের জন্য উপযোগী এমন ৬২৯টি স্থান চিহ্নিত করে ওষুধ ব্যবহার করেছিল বলে জানায় সিটি করপোরেশন। এই সব কটি স্থানের তালিকা না দিলেও গুলশান, বনানী, উত্তরা, মিরপুরের মতো এলাকায় লেক, খালসহ বিভিন্ন জলাশয়ে ওষুধ ব্যবহারের তথ্য নিশ্চিত করেছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু এই এলাকাগুলোই এবার শহরের অন্যতম মশাপ্রবণ এলাকা হিসেবে আলোচিত।

গতকাল সোমবার উত্তর সিটি এলাকায় চিরাচরিত মশকনিধন কার্যক্রম শুরু করেছে ডিএনসিসি। ১০ অঞ্চলে একযোগে লার্ভা ও মশা নিধনের এই কার্যক্রম অন্তত ১০ দিন চলবে বলে ঘোষণা করেছেন মেয়র আতিকুল ইসলাম।

ডিএনসিসির স্বাস্থ্য ও ভান্ডার বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষে ইংল্যান্ড থেকে ৪৫ লাখ ৫ হাজার ৫৪৪ টাকা ব্যয়ে ৪৮০ কেজি নোভালুরন ওষুধ কেনা হয়। এ পর্যন্ত ২৫০ কেজি ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছে। ইংল্যান্ডে রাসেল আইপিএম নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ওষুধ কেনা হয়। দরপত্রের মাধ্যমে ডিএনসিসিকে এই ওষুধ সরবরাহ করে ট্যাক ইন্টারন্যাশনাল। প্রতিটি নোভালুরন বড়ি এক গ্রাম ওজনের এবং একেকটি ১০ লিটার পানিতে কাজ করবে।

ডিএনসিসির ব্যবস্থাপনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাহমিনা আক্তারের তত্ত্বাবধানে তিন মাসব্যাপী নোভালুরন ওষুধের পরীক্ষা চালানো হয়। তখন বলা হয়েছিল, যেসব প্রাণীর দেহে ‘কাইটিন’ নামের উপাদান রয়েছে, শুধু সেসব প্রাণীর লার্ভার বৃদ্ধি ঠেকিয়ে দিতে পারে এই ওষুধ। মশার লার্ভায় কাইটিন থাকায় নোভালুরন তার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত করে মশার জন্ম রোধ করতে সক্ষম। ওষুধটি পানিতে প্রায় ৯০ দিন পর্যন্ত কার্যকর থাকবে বলেও তখন জানানো হয়েছিল।

এ হিসাবে এখন নগরে কিউলেক্স মশার উপদ্রব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী ও উত্তরা থেকে শুরু করে অপেক্ষাকৃত অনুন্নত মিরপুর, মোহাম্মদপুর, মহাখালী, খিলক্ষেত, এমনকি ঢাকার পূর্বাঞ্চলে সিটি করপোরেশনে নতুন যুক্ত বেরাইদ, ডুমনি, উত্তরখান, দক্ষিণখান—সর্বত্র বাসিন্দারা এখন মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। নগরবাসীর অনেকেই মশার এই উপদ্রবকে স্মরণকালের সর্বোচ্চ বলে মন্তব্য করেছেন।

গুলশান সোসাইটির মহাসচিব শুক্লা সারাওয়াত প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা তো অধিক শোকে পাথর হওয়ার মতো অবস্থা। আমার বয়সকালে এবারের মতো মশার আক্রমণ আর দেখিনি। যেন মশার কাছে মানুষের পরাজয়।’ গুলশান লেকে নোভালুরন ওষুধ ব্যবহারের বিষয়টি তিনি জানতেন না বলে জানান প্রথম আলোকে।

নোভালুরন ওষুধটি যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুরে ব্যবহৃত হয় বলে জানান সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান টেক ইন্টারন্যাশনালের সমন্বয়ক তানভীর আহমেদ। তিনি জানান, তিন মাস পর্যবেক্ষণের পর নোভালুরনকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা আইইডিসিআর এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পৃথকভাবে ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা করেছে। গবেষণাগার ও মাঠপর্যায় ওষুধটি শতভাগ কার্যকর হওয়ার পরই ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওষুধটি সরাসরি ইংল্যান্ডে প্রস্তুত করা।

অন্যদিকে কীটতত্ত্ববিদ ও ওষুধ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ভাষ্যের বিষয়ে করপোরেশনের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, ‘কারও মতামতকে অবজ্ঞা করছি না। তবে সিটি করপোরেশন যেহেতু এ বিষয়ে কাজ করে আসছে, তাই বিষয়টিতে করপোরেশনের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা যথেষ্ট হয়েছে।’ তিনি জানান, ওষুধটি যাতে পানির নিচে তলিয়ে না যায় বা ভেসে অন্যত্র চলে না যায়, সে জন্য এটিকে মশারির কাপড় পেঁচিয়ে বাঁশের কঞ্চিতে বেঁধে পানিতে রেখে দেওয়া হয়েছিল।

আগামীনিউজ/প্রভাত