ঢাকাঃ পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সুন্দর শহর হওয়ার কথা ছিলো ঢাকা শহর, কিন্তু দুর্ভাগ্য যে পৃথিবীর সবচেয়ে নোংরা ও দূষণের শহর বলা হয় রাজধানী ঢাকাকে। ৪শত বছরের পুরোনো এই প্রচীন শহরটি ঘিরে ছিলো অসংখ্য নদী ও খাল যা আজ বিলীন প্রায়।
ইতিহাস বলছে, ‘রামগঙ্গা’ ও ‘নারায়ণীগঙ্গা’ নামে বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী দুটি নদীর নাম উল্লেখ আছে ১৯১২ সালে প্রকাশিত যতীন্দ্রমোহন রায়ের ‘ঢাকার ইতিহাস’ গ্রন্থে। এতে বলা হয়- ”ঢাকা জেলার বক্ষদেশে রামগঙ্গা ও নারায়ণীগঙ্গা উপবীতবৎ (উপকণ্ঠে) শোভা পাইতেছে”। কিন্তু এর ঠিক একশো বছর পর নদী দুটি চিরতরেই অপরিচিত এ জনপদের মানুষের কাছে।
টেমসের তীরে লন্ডন, সেইনের তীরে প্যারিস, দানিয়ুবের তীরে বুদাপেস্ট। তিন নদী এ তিন শহরকে বিশ্বে দেশগুলোকে পরিচিত করলেও রাজধানী ঢাকার চিত্র একেবারেই ভিন্ন। গবেষণা সংস্থা রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের পৃথক দুটি জরিপ থেকে জানা গেছে, স্বাধীনতাকালেও ঢাকা জেলায় নদীর সংখ্যা ছিল ১৫টি। এর মধ্যে আঁটি, কনাই, দোলাই, পান্ডো ও নড়াই- এ পাঁচ নদীর কোনো হদিস এখন নেই। একইসঙ্গে ঢাকাকে ঘিরে রাখা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও টঙ্গী নদীর মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী ১৭টি খালও হারিয়েছে। মহানগরী এলাকায় এক সময় খাল ছিল ৭৫টি।
কোথায় গেল ঢাকার নদীগুলো?
গত কয়েক দশকে একের পর এক দখল-দূষণে নদী ভরাট হয়ে গড়ে উঠেছে শহর ও সুরম্য অট্টালিকা, তৈরি হয়েছে বিনোদনকেন্দ্র, মার্কেটসহ নানা স্থাপনা। অর্ধশত বছরে এসব নদী ও খালের বুকের ওপর গড়ে উঠেছে বড় বড় অট্টালিকা।
ইতিহাসের গ্রন্থে বলা হয়েছে, মোগল আমলেও পশ্চিমে বুড়িগঙ্গা-তুরাগ থেকে পূর্বে বালু নদীতে প্রবাহিত হতো নড়াই নদী। আজকের ধানমন্ডি লেকের পশ্চিমমুখী দুই বাহু আসলে নড়াই নদীর দুই ধারা। কোনো কোনো গ্রন্থে উল্লেখ আছে- পিলখানা হয়ে বুড়িগঙ্গায় মিশে যাওয়া ধারাটি ছিল পান্ডো নদী। আর এখনকার মোহাম্মদপুর হয়ে তুরাগে মেশা ধারাটি ছিল নড়াই। ঢাকায় আরেকটি নদীর নাম ছিল সোনাভান। এ নদীটি তুরাগ থেকে মিরপুর এলাকার মধ্য দিয়ে টঙ্গীর কাছে তুরাগের সঙ্গেই মিলিত হতো।
গবেষণা প্রতিবেদন
রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের তথ্যমতে, পান্ডো নদীর অবস্থান ছিল ধানমন্ডির ঈদগাহ মসজিদ থেকে মোহাম্মদপুরের কাটাশুর পর্যন্ত। নড়াই নদীর অবস্থান ছিল বালু নদী থেকে বর্তমান কারওয়ানবাজার জামে মসজিদ পর্যন্ত। হারিয়ে যাওয়া আঁটি নদীর অবস্থান ছিল বর্তমান বছিলা ব্রিজ থেকে আঁটিবাজার পর্যন্ত। টঙ্গী নদী থেকে উত্তরা ও আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত ছিল কনাই নদীর অবস্থান। আর দোলাই নদীর অবস্থান তেরমুখ থেকে পুরান ঢাকার ধোলাইখাল পর্যন্ত ছিল। নদীটি একসময় মারা গেলেও এটি ধোলাইখাল হিসেবে পরিচিতি পায়। তবে কালের পরিক্রমায় দখল-দূষণে সেই ধোলাইখালও মৃতপ্রায়।
একই সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া খালগুলো সংযোগ করেছিল রাজধানীর প্রধান চারটি নদীকে। সূত্রাপুর-লোহারপুল হয়ে বুড়িগঙ্গা, মোহাম্মদপুরের বছিলা হয়ে বুড়িগঙ্গা, উত্তরার আবদুল্লাহপুর ও উত্তরখান হয়ে তুরাগ, খিলক্ষেত-ডুমনি হয়ে বালু ও মানিকনগর হয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছিল এসব খাল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে ঢাকার আশপাশে দশটি নদী বহমান থাকলেও দখল-দূষণে তা মৃতপ্রায়। অনেক নদী শুষ্ক মৌসুমে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যায়। বছরের পর বছর ধরে দখলদাররা নদীতে মাটি ভরাট করে বানিয়েছে অট্টালিকা। কোথাও কোথাও নদীর অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না। এর বাইরে কল-কারখানার রাসায়নিক বজ্য, পয়োবর্জসহ নানা কারণেই নদী দূষিত হচ্ছে। ফলে দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে নদীর গতিপথ।
নদী আর খাল দখলের প্রভাব পড়েছে রাজধানীর জীবনযাত্রায়। অল্প বৃষ্টিতেই সড়কগুলো রূপ নেয় জলাশয়ের। কোথাও কোথাও জলাবদ্ধতা থাকছে দিনের পর দিন। ঢাকার আশপাশের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাচ্ছে সামান্য বন্যায়। কেবল নদী আর খালই নয়, বিলীন হয়েছে রাজধানীতে থাকা অসংখ্য পুকুরও। গত ৯৬ বছরে পুরান ঢাকার ৯৬টি পুকুর বিলীন হয়ে গেছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। আদি ঢাকার পুকুর নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার। এতে ১৯২৪ সালের টপোগ্রাফি মানচিত্র ব্যবহার করা হয়।
নদী গবেষকদের ভাষ্য
“ব্রিটিশ আমলে ঢাকার সীমানা ছিল অনেক ছোট। মানচিত্র অনুসারে তখন ঢাকা বলতে উত্তরে শাহবাগ, দক্ষিণে চর ইউসুফ ও চরকামরাঙ্গী, পশ্চিমে ধানমন্ডি এবং পূর্বে মতিঝিল ও ইংলিশ রোডের মধ্যবর্তী এলাকাকে বোঝানো হতো। এই ছোট এলাকার মধ্যেই ছিল ১২০টি পুকুর। সেই সংখ্যাটা এখন মাত্র চব্বিশে এসে দাঁড়িয়েছে। আদি ও নতুন ঢাকা মিলিয়ে বর্তমানে পুকুর রয়েছে মাত্র ২৪১টি। ধর্মীয় উপাসনালয়ের সঙ্গেই আছে ৪৩টি। এর বাইরে ৮৬টি বিল ও লেক রয়েছে। পুকুর, বিল ও লেক মিলিয়ে জলাশয়ের সংখ্যা ৩২৭টি,” জানান সংস্থাটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ।
তিনি বলেন, ”নদী ও খালগুলো দখলের পেছনে অপরিকল্পিত নগরায়ণের দায়। উত্তরা, বনানী, বনশ্রী, নিকুঞ্জসহ বড় বড় প্রজেক্টগুলো তৈরির সময় কোনো পরিকল্পনা ছিল না। এতে পানি নিষ্কাশনের সুযোগ রাখা হয়নি। বৃষ্টির পানি পুন:ব্যবহারের ব্যবস্থা রাখা দরকার ছিল। শহরের মাইলের পর মাইল হাঁটলেও এখনো মাটি পাওয়া যায় না। ফলে পানি পুন:ব্যবহারের সুযোগ নেই।”
মোহাম্মদ এজাজের ভাষ্য, ”ঢাকা ও তার আশপাশের গত ৫০ বছরে পাঁচটি নদী হারিয়ে গেছে। বেড়িবাঁধের মাধ্যমে নদীর প্রবাহ নষ্ট করেছি। এরপর আবার বেড়িবাঁধের দুপাশেই দখল করা হয়েছে। ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর অনেক শাখা নদী ছিল, সেগুলো দখল হয়ে গেছে। আর নদী হারিয়ে যায় তখন চেষ্টা করলেও নদীকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা কষ্টকর।”
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিলের মতে, ”নদীর ঢাল, পার ও প্লাবন অঞ্চল সব দখলদারদের কাছে দিয়ে তলদেশকে গভীর করে নৌ চলাচল ও বর্জ্য নিষ্কাশনের রাস্তা তৈরি করেছে সরকার। আমাদের নদীগুলোকে রক্ষা করতে হলে নদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারের যে পরিকল্পনা তা জনসম্পৃক্ত করতে হবে, স্বচ্ছতা ও বিজ্ঞানসম্মত করাসহ অতীত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে।”
এদিকে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদী দখল হওয়া থেকে রক্ষা করতে সীমানা পিলার নির্মাণ করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআইডব্লিউটিএ। কিন্তু স্থাপিত পিলারের ১৪শ ২৩টিই ভুল জায়গায় নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি রিভার এন্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টার-আরডিআরসি নামক একটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদনে এ অভিযোগ করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “দখল রোধ করতে বিআইডব্লিউটিএ বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদের সীমানায় তিন হাজার ৮৪টি পিলার স্থাপন করে, যার মধ্যে ১৪শ ২৩টি নদীর মধ্যেই স্থাপন করা হয়েছে। এই ভুল কারণ নদীগুলোকে সরু করে উলটো দখলদারের সুবিধা করে দেয়া হয়েছে। বুড়িগঙ্গা নদীর পশ্চিম প্রান্তে ২২৮টি এবং পূর্ব প্রান্তে ৮৪টি মিলিয়ে ৩১২টি পিলারের অবস্থান ভুল। তুরাগ নদের এক হাজার ১১১টি ভুল পিলারের মধ্যে পূর্ব প্রান্তে রয়েছে ৪০৯টি ও পশ্চিমের বন্যাপ্রবণ এলাকায় রয়েছে আরো ৭০২টি।
এতে আরো বলা হয়, ”২০০৯ সালে হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী ঢাকার চার নদী হতে দখলদার উচ্ছেদের নির্দেশ দেয়া হয়। টেকসইভাবে দখল্মুক্ত করার উদ্দেশ্য সীমানা পিলার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। এই অনুযায়ী তৎকালীন গাজীপুর, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীতে প্রায় ছয় হাজার পিলার স্থাপন করেন। যেগুলোর অধিকাংশই নদীতে বা তীরেই স্থাপন করা হয়।”
সংস্থাটির দাবি, ভুল বিষয়টি নিয়ে শোরগোল হলে ২০১৪ সালে একজন ডেপুটি সেক্রেটারির নেতৃত্বে গঠিত কমিটি একটি রিপোর্ট পেশ করে। এতে পিলার স্থাপনার ভুলের দিকটি উঠে আসে। পরবর্তীতে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে বিআইডব্লিওটিএকে নদী দখল মুক্ত করে নতুন করে সীমানা পিলার স্থাপনের দায়িত্ব দেয়া হয়। গবেষণায় আরো ৩৯০টি পিলার বিতর্কিত রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এমনকি কোথাও কোথাও পোর্ট আইন ১৯৬৬ ও বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩ না মেনে পিলার নির্মাণের অভিযোগও করা হয়েছে।
সংস্থাটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ ‘আগামী নিউজ’কে বলেন, “পিলার নির্মাণে ভুল নিয়ে দ্বিতীয় দফায়ও একই অভিযোগ উঠলে ২০২০ সালের ১৫ই অক্টোবর আরডিআরসি’র পক্ষ থেকে একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। এ সময় বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীর প্রায় ৩৭ কিলোমিটার ঘুরে সীমানা পিলারগুলো সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা হয়। তিনি বলেন, এ বছরের জানুয়ারির শুরুতে জরিপের ফল বিশ্লেষণ করে তৈরি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে পিলার স্থাপনের ভুলগুলো দুর্নীতি প্রকাশ করছে। যা দখলেরও সুযোগ করে দিচ্ছে দখলদারদের।”
তবে পিলারের অনিয়মের বিষয়টি নিয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র প্রকল্পটির পরিচালক নুরুল আলম গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, “নদী নিয়ে গবেষণা করার এখতিয়ার ওই বেসরকারি গবেষণা সংস্থার (আরডিআরসি’র) নেই।”
তিনি বলেন, “সরকারি ভূমি মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে দক্ষ গবেষকদের সহায়তায় নদীর সীমানা নির্ধারণ করা হয়, যাতে ৩-৪ বছর সময় লেগেছে। এই জরিপ মেনেই পিলার স্থাপন করা হয়েছে। কয়েক মাসের গবেষণার উপর ভিত্তি করে দেয়া রিপোর্ট মেনে উন্নয়ন প্রকল্পকে ভুল মানার কোনো যথার্থতা নেই।”
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান হাওলাদার আগামী নিউজকে বলেন, “বিআইডব্লিউটিএ নদীর সীমানা নির্ধারণের সময় নদী কমিশন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তা না নিয়ে করায় এই প্রকল্পে সরকারি অর্থ অপচয় হয়েছে এবং তৈরি হয়েছে নদী দখলের সুযোগ।”
তিনি বলেন, দখল-দূষণে জর্জরিত নদী রক্ষা এবং পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি নানা উদ্যোগ নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। উচ্ছেদ অভিযান, ভূমি উদ্ধার, ওয়াকওয়ে ও ইকোপার্কসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ এসব প্রকল্পের মধ্যে আনা হয়েছে।
সরকারের উদাসীনতা, প্রভাবশালীদের দখলে হারিয়ে গেছে ঢাকার অধিকাংশ খাল। যে কটি টিকে আছে সেগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ নেই। নদীর সঙ্গে সংযোগও কাটা পড়ছে। জলাবদ্ধ হয়ে পরিণতি ভোগ করছে ঢাকার পৌনে দুই কোটি মানুষ। ঢাকাকে বাঁচাতে খাল উদ্ধারে নামতে হবে ।
চারপাশে নদী। মাঝখানে ভূমিতে জালের মতো বিছিয়ে থাকা আঁকাবাঁকা খাল, বিল, ঝিল। একসময় এই ছিল রাজধানী ঢাকা। বৃষ্টি হলে পানি খাল-ঝিল হয়ে বেরিয়ে গিয়ে পাশের নদীতে পড়ত। পানির সঙ্গে ময়লা-আবর্জনা ধুয়ে গিয়ে পরিষ্কার হয়ে যেত শহর। কিন্তু গত দুই যুগে রাজধানীর এসব খাল-জলাভূমির অধিকাংশ দখল হয়ে গেছে। এখন সামান্য বৃষ্টিতে ডুবে যাচ্ছে ঢাকার রাস্তাঘাট। কিছু কিছু এলাকায় দিনের পর দিন জমে থাকছে পানি।
জেলা প্রশাসনের হিসাবে ঢাকায় খালের সংখ্যা ৫৮টি। এর মধ্যে অন্তত ২৬টি এখনো সচল করা সম্ভব বলে মনে করছে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)। তারা এই ২৬ খালকে ঢাকার চার নদীর সঙ্গে যুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছে। তবে এর জন্য খালগুলোকে দ্রুত দখলমুক্ত করতে হবে।
সিইজিআইএস ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা দূর করতে করণীয় ঠিক করার লক্ষ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও বিশ্বব্যাংকের জন্য ২০১৫-১৬ সালে দুটি গবেষণা করেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন এই গবেষণাপ্রতিষ্ঠানটি রাজধানীর জলাবদ্ধতা দূর করতে ‘প্রতিবেশ প্রকৌশল’ পদ্ধতি অনুসরণের জন্য সুপারিশও করেছে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) রিভিউ কমিটিতে এই গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এরপর এ নিয়ে আর কোনো কথা শোনা যায়নি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন আরেক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) ঢাকার পূর্বাংশের জলাবদ্ধতা নিয়ে পৃথক গবেষণা করেছে রাজউকের জন্য। ২০১৫ সালে ওই গবেষণা শেষ করে প্রতিবেদন রাজউককে হস্তান্তর করা হয়। এরপর আর কোনো অগ্রগতি জানা যায়নি।
‘প্রতিবেশ প্রকৌশল’ পদ্ধতি অনুসরণের সুপারিশ করে করা সিইজিআইএসের গবেষণায় মূলত প্রাকৃতিক প্রবাহকে সক্রিয় করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এতে কোন খাল কতটুকু গভীর ও প্রশস্ত রাখতে হবে, তারও একটি পরিকল্পনা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ওই খালগুলোকে ঢাকার চারপাশের প্রধান চার নদ-নদী—বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ, শীতলক্ষ্যার সঙ্গে আবার যুক্ত করে দিতে হবে। এটা করলে এরপর খালগুলো প্রাকৃতিকভাবেই ধলেশ্বরী ও টঙ্গী খালের সঙ্গেও যুক্ত হয়ে যাবে।
ঢাকার চার পাশের নদী থেকে ভেতরের খালগুলো বিচ্ছিন্ন হওয়ার আরেকটি কারণ ৯০ এর দশক তৈরি করা ৩৪ কিলোমিটার শহর রক্ষা বাঁধ। বন্যার পানি যাতে শহরে ঢুকতে না পারে সে জন্য এই বাঁধ দেওয়া হয়। খালের পানি নদীতে নেওয়ার জন্য নির্মাণ করা হয় পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো বা রেগুলেটর। রেগুলেটরগুলো অকার্যকর হওয়ায় খালের পানি আর নদীতে যাওয়ার সুযোগ থাকেনি।
অবৈধ দখলের কারণে নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ২৬ খালের মধ্যে শহরের পশ্চিমাংশে আছে কাটাসুর, হাজারীবাগ, ইব্রাহিমপুর, কল্যাণপুর, আবদুল্লাহপুর, রামচন্দ্রপুর, বাউনিয়া, দ্বিগুণ, দিয়াবাড়ি, ধোলাই, রায়েরবাজার, বাইশটেকি ও শাহজাহানপুর খাল। পূর্বাংশে আছে জিরানী, মান্ডা, মেরাদিয়া-গজারিয়া, কসাইবাড়ি, শাহজাহানপুর, শাহজাদপুর, সুতিভোলা, ডুমনি, বোয়ালিয়া, রামপুরা, গোবিন্দপুর, সেগুনবাগিচা, খিলগাঁও-বাসাবো খাল।
এসব খালের দুই পাশে দুই থেকে তিন মিটার আয়তনের সবুজ বেষ্টনী ও হাঁটার পথ করে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে সিইজিআইএসের প্রতিবেদনে। আর বেশির ভাগ খাল দখলমুক্ত করে ১৫ থেকে ২০ ফুট প্রস্থে নিয়ে আসার জন্য বলা হয়েছে। তবে বাস্তব অবস্থার কারণে কয়েকটি খাল ৮ থেকে ১০ ফুটের বেশি চওড়া করা সম্ভব নয় বলেও মনে করছে সিইজিআইএস।
সিইজিআইএসের সুপারিশে ঢাকা শহরের পানিনিষ্কাশন ও সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য হাতিরঝিলের মতো বড় প্রকল্প নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এমনকি বড় ভবনের মধ্যে কংক্রিটবিহীন খোলা মাটির এলাকা রাখা বাধ্যতামূলক করার জন্যও বলা হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে রাজধানীর জলাবদ্ধতা দূর হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
শুথু খাল নয়, রাজধানীর চারপাশের নদীগুলো খনন ও দখলমুক্ত করার কাজ কঠোরভাবে বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে সিইজিআইএস। সেই সঙ্গে নদীগুলোর দুই পাড়ে সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকায় কোনো ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে। ওই এলাকাগুলোকে নদীর জন্য নিরাপদ এলাকা হিসেবে তৈরির জন্য বলা হয়েছে।
কোন খাল কোন নদীতে সংযুক্ত হবে
সোয়া পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ কাটাসুর ও রামচন্দ্রপুর খালটি কল্যাণপুর খাল হয়ে তুরাগ নদে পড়েছিল। কিন্তু খাল ও নদের সংযোগস্থলে মোহাম্মদপুর হাউজিং ও মোহাম্মদিয়া হাউজিং নামে দুটি আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে। তারা খালের যে অংশ দখল করেছে, তা মুক্ত করে তুরাগের সঙ্গে খালটিকে যুক্ত করতে বলেছে সিইজিআইএস।
কল্যাণপুর খালও তুরাগ নদের সঙ্গে যুক্ত। সিইজিআইএস বলছে, এই খালের ক, খ, ঙ, ঞ ও চ শাখা মিলিয়ে মোট ১৫ দশমিক এক কিলোমিটার এলাকা খনন করতে হবে। কিন্তু গাবতলী, দারুসসালাম, কল্যাণপুর, শ্যামলী, আদাবর, পীরেরবাগ, আগারগাঁও তালতলা, শেওড়াপাড়ার একাংশ, মাজার রোড, আনসার ক্যাম্প, লালকুঠি, টোলারবাগ, পাইকপাড়া, আহমেদাবাদ, শাহআলী বাগ, বড়বাগ ও মণিপুর এলাকায় খালটির বিভিন্ন অংশে বাড়িঘরসহ নানা স্থাপনা গড়ে উঠেছে।
দিগুণ খাল প্রবাহিত হয়েছে মিরপুর-১, ২, ৬, ১১, ১২ নম্বর আবাসিক এলাকা, রূপনগর ও জাতীয় চিড়িয়াখানা এলাকার মধ্য দিয়ে। এটিও তুরাগে গিয়ে পড়েছে। খালটির বেশির ভাগ অংশ ময়লা ফেলে ও ছাপড়াঘর তুলে দখল করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি আবাসিক এলাকাও ওই খালের জমিতে গড়ে উঠেছে।
মিরপুরের বাউনিয়া খালের সঙ্গে মিরপুরের সাংবাদিক কলোনি খাল, বাইশটেকি খাল ও মিরপুর হাউজিং এলাকার খালগুলো সংযুক্ত। সব মিলে এটি ১৪ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ লম্বা। দখলের কারণে বর্তমানে এই খালগুলো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। এগুলোকে যুক্ত করতে হবে। মিরপুরের পল্লবী, কালশী, মিরপুর ১০ নম্বর, ১৩ ও ১৪ নম্বর এবং মিরপুর ডিওএইচএস আবাসিক এলাকার সব নিষ্কাশন নালা খালের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় নালার পানি খালে পড়লেও তা তুরাগে যাচ্ছে না। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেও মিরপুরের ওই এলাকাগুলোতে পানি জমে যায়।
উত্তরা ও বিমানবন্দর এলাকার সব নিষ্কাশন নালা যুক্ত হয়েছে ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ আবদুল্লাহপুর খালের সঙ্গে। খালটি উত্তরার কাছে টঙ্গী খালের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু তা এখন বিচ্ছিন্ন। ফলে ১০ থেকে ২০ মিলিমিটার বৃষ্টিতে উত্তরা আবাসিক এলাকায় পানি জমে যাচ্ছে। পানি সরতে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগছে। তাই আবদুল্লাহপুর খালের সঙ্গে টঙ্গী খালের সংযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে সিইজিআইএস।
ঢাকার একসময়কার অভিজাত আবাসিক এলাকা ধানমন্ডি এলাকার সব নিষ্কাশন নালার পানি ধানমন্ডি লেক হয়ে হাতিরঝিলে গিয়ে পড়ত। কিন্তু পান্থপথ সড়ক নির্মাণের সময় ধানমন্ডি লেক ও হাতিরঝিল বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। হাতিরঝিলের সঙ্গে সংযোগ ছিল বালু নদীর। সেই সংযোগও প্রায় বিচ্ছিন্ন।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, রাজধানীর পশ্চিমাংশের ৪৫ শতাংশ এলাকাজুড়ে খালগুলো বয়ে গেছে। রাজধানীর বৃহত্তম আবাসিক এলাকা পুরান ঢাকা, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, উত্তরা এই অংশে অবস্থিত। ফলে এখানকার খালগুলোর প্রবাহ ফিরিয়ে নদীর সঙ্গে যুক্ত করলে রাজধানীর প্রায় অর্ধেক এলাকার জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। নয়তো ঢাকা শহরে জলাবদ্ধ এলাকার সংখ্যা দিনের পর দিন বাড়বে।
আগামীনিউজ/প্রভাত