যে প্রক্রিয়ায় রাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত করা সহজ

প্রভাত আহমেদ জানুয়ারি ৩১, ২০২১, ০২:৩৯ পিএম
ছবি: আগামী নিউজ

ঢাকাঃ ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয় রাজাকার, আলবদর, আল-শামসসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের নামের তালিকা। কিন্তু সেই তালিকায় অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম থাকায় সৃষ্টি হয় তীব্র বিতর্ক।
তিনদিন পরই সেই তালিকা স্থগিত করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। 
 
এবার বিতর্কহীনভাবে রাজাকারের নামের তালিকা প্রকাশ করতে চাচ্ছে মন্ত্রণালয়, তবে সেই তালিকা নিয়েও যদি বিতর্ক হয়? 
এখন নতুন করে স্বাধীনতা-বিরোধীদের তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে এই আস্থার অভাব দূর করা কতটা সম্ভব হবে-তা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
রাজাকার, আল বদরসহ স্বাধীনতা-বিরোধীদের নামের তালিকায় বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার নাম থাকায় এনিয়ে বিতর্কের প্রেক্ষাপটে শেষপর্যন্ত তা প্রকাশের তিনদিন পর গত ১৮ই ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সেই তালিকা স্থগিত করা হয়েছে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনকারী সংগঠনগুলো এই তালিকা তৈরির সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করার জন্য বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ৪৮ বছর পর অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় রাজাকার-

আলবদরসহ স্বাধীনতা বিরোধীদের তালিকা প্রকাশ করেছিল ২০১৯ সালের ১৫ই ডিসেম্বর।
কিন্তু ক্ষোভ-বিক্ষোভের মুখে সেই তালিকা স্থগিত করা হলেও ঐ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এর দায় এড়িয়ে গেছেন।

ক্ষুব্ধ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোর অনেক সদস্য বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধার নাম রাজাকার বা স্বাধীনতা বিরোধীদের তালিকায় দেয়ার কারণে তাদের অপমান করা হয়েছে এবং বিষয়টিতে আস্থার অভাব দেখা দিয়েছে।

তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম আসার পর যাদের নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম সিরাজগঞ্জের একটি আসনের আওয়ামী লীগের প্রয়াত সংসদ সদস্য লতিফ মির্জা। তাঁর মেয়ে সেলিনা মির্জা মুক্তি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এমন একটি বিতর্কিত তালিকা মুক্তিযোদ্ধাদের বা তাদের পরিবারগুলোর মনে যে ক্ষতের সৃষ্টি করলো, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা বেশ কঠিন।

"এই বিতর্কিত তালিকা পুরো জাতিকে নাড়া দিয়েছে। তিনি বলেন, আমার বাবা শুধু মুক্তিযোদ্ধা নন, উনি মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠকও ছিলেন। আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। নিশ্চয়ই আমার মতো সকল মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদেরই এমন অনুভূতি হচ্ছে।"তিনি আরও বলেছেন, "এই খামখেয়ালিপনা মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের, এই কাজটা যে তারা করলো, তারা কেন এটা করলো-কিভাবে করলো? আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর বিচার চাই।"

রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন, এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম সেই তালিকায় ছিল। এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান আইনজীবী গোলাম আরিফ টিপুর নামও আছে সেই তালিকায়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় এই তালিকার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে বিতর্কিত তালিকা তৈরির বিষয় খতিয়ে দেখতে বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি করেছে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনকারী বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধ সর্ম্পকিত বিভিন্ন বিষয়কে অতীতে প্রশ্নবিদ্ধ করে আস্থার সংকটে ফেলা হয়েছে, বিভিন্ন সরকারের সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় হাত দিয়ে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়া হয়েছে।

তারা বলছেন, সেই তালিকার ব্যাপারে মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। এখন স্বাধীনতা-বিরোধীদের তালিকা নিয়েও এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হলো। মুক্তিযোদ্ধা সুলতানা কামাল বলেছেন, এই তালিকা নিয়ে আস্থার সংকট বেড়ে যাওয়ায় নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার সংগ্রাম হোচট খেলো। "মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে আস্থার জায়গায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা একটা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে, এনিয়ে আমরা একটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছি। সেই জায়গায় এই ধরনের একটা ভুলে ভরা তালিকা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রকাশ করে দেয়ার ঘটনা এই সঙ্কাকে আরও তীব্র করেছে।"

তালিকাটি তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী একে অপরের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করেছেন। তাদের বক্তব্য মানুষের ক্ষোভ বাড়িয়ে দিয়েছিল। তখন এই ইস্যুতেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। এই তালিকা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকেও বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে বলে দলটির অনেক নেতা মনে করেন।

আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতা এবং মন্ত্রী ড: আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, আস্থার সংকটের যে কথা উঠেছে, এখন নির্ভুল একটি তালিকা প্রণয়ন করে সেই সংকট কাটানো সম্ভব। "আসলে রাজাকারদের এই তালিকায় এত মারাত্নক ভুল হয়েছে, সেটাতো খুবই দু:খজনক। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক সুন্দরভাবে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে বলেছেন।"

মন্ত্রী আরও বলেছেন, "যেহেতু মারাত্নক ভুল হয়েছে, কাজেই এখন চুলচেরা যাচাই বাছাই করেই নতুন করে তালিকা করতে হবে। সেটা করা হলে আস্থার সংকট কাটবে।" কিন্তু তাতে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকের সন্দেহ রয়েছে।

তারা বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের এত বছর বাদে রাজাকারের তালিকা প্রকাশের পর বিতর্কের মুখে সেটা স্থগিত করতে হয়েছে। ফলে নতুন তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে যত যাচাই বাছাই করা হোক না কেন তাতে এই আস্থার সঙ্কট কতোটা কাটবে তা বলা মুশকিল।

তবে খুব সহজেই সঠিক নিয়মে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারের তালিকা তৈরী করা সম্ভব।

সেটি কেমন করে?

সারাদেশের জেলাগুলোতে জনআদালত বসিয়ে খুব সহজেই চিহ্নিতকরণ করা যেতে পারে জাতীয় বেঈমান রাজাকারদের একই সাথে জাতীর সূর্য সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের।

জনআদালত কি?

জনআদালত হলো জনগনের সমন্বয়ে গঠিত আদালত।

প্রতিটি ইউনিয়ন ভিত্তিক জনআদালত বসানো যায়, এই জনআদালতে জেলাপ্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউ.এন.ও) উপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধসময়কালীন যাদের ৮ উর্ধ্ব বয়স, বর্তমান যারা জিবিত আছেন তাদের হাজির করে সাক্ষ্যগ্রহণের মাধ্যমেই খুব সহজে মুক্তিযোদ্ধা ও জাতীয় বেঈমান রাজাকার চিহ্নিত করা যেত অল্প পরিশ্রমে, কোন প্রকার বাজেট বা অর্থ বরাদ্দ ছাড়াই। কিন্তু সেটা না করে এই তালিকা প্রকাশের জন্য নতুন করে আবার প্রজেক্ট বানানো হলো, অর্থ বরাদ্দ করা হলো। এতে করে রাষ্ট্রীয় অর্থব্যয়ের পাশাপাশি দূর্নীতিরও সুযোগ রয়েছে।

এই তালিকাও আবার বিতর্কিত হবে না তো? নতুন তালিকা দেখার জন্য দেশ ও জাতী অপেক্ষা করছে ধীর আগ্রহে।

আগামীনিউজ/প্রভাত