করোনায় জনশক্তি রপ্তানির ভবিষ্যৎ কী?

ম. শাফিউল আল ইমরান জুলাই ২২, ২০২০, ০৯:৫৬ এএম
সংগৃহীত ছবি

ঢাকা: করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারির ধাক্কায় বিপর্যস্ত সারা বিশ্ব। বিশেষ করে তেল নির্ভর অর্থনীতির দেশগুলোর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। আর সেসব দেশেই আমাদের দেশের শ্রম শক্তির সিংহভাগ। ওই সব দেশে জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় অর্থনীতিতে বিরুপ প্রভাব পড়েছে। আর বাংলাদেশের করোনার ভুয়া টেস্ট রিপোর্ট করার ফলে অনেক দেশ এখানকার শ্রমিকদের বিষয়ে নাক ছিটকানো শুরু করছে। যারফলে একদিকে যেমন অনেক দেশে শ্রমিকরা কাজ হারিয়ে বেকার বসে আছেন।অন্যদিকে, নতুন করে শ্রমিক যাবে সে সুযোগ কমে আসছে। 

শ্রম বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বিমান যোগাযোগ শুরু হলে অনেক শ্রমিক দেশে ফিরে আসবে। এ কারণে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি শ্রমিকরা যেমন হতাশ হয়ে পড়ছেন তেমনি সংকট ঘনিভূত হওয়ায় মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। এ অবস্থায় শ্রম বাজার নিয়ে কঠিন সংকটের দিকেই যাচ্ছে বাংলাদেশ।

জানাগেছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এক কোটি ২০ লাখের মতো বাংলাদেশি কাজ করেন। তাদের সিংহভাগ অর্থাৎ প্রায় ৭৫ শতাংশেরই কর্মসংস্থান মধ্যপ্রাচ্যে।  সূত্র জানায়, গত বছর কাজ নিয়ে বিদেশ গেছেন ৭ লাখের মতো কর্মী। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই গেছেন ৪ লাখ। করোনা সংকটে চাকরি হারানো প্রবাসী ছাড়াও অবৈধভাবে বসবাসকারী বিপুলসংখ্যক কর্মীর দেশে ফেরার আশঙ্কা রয়েছে। চলতি বছর করোনার কারণে শ্রমিকদের যাওয়া সম্ভব হয়নি। উল্টো বিদেশে অবস্থানরত শ্রমিকরা কাজ হারিয়ে বা কাজ না থাকার কারণে দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছে। মধ্যপ্রাচ্যর শুধু সৌদি আরবেই কয়েক লাখ শ্রমিক ফেরার অপেক্ষায়। এর সাথে যোগ হয়েছে, কাতার, কুয়েত, ওমান, ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইনসহ আরো ফিরতে হতে পারে ইউরোপ, আমেরিকা  মালদ্বীপ, আফ্রিকা  ও ব্রনেই থেকে।

বিগত বছরগুলোর দিকে তাকালেই দেখা যায়, সবকিছু ঠিক থাকলে প্রতিমাসে প্রায় অর্ধ লক্ষ শ্রমিক কোননা কোনভাবে বিভিন্ন দেশে যেত। অথচ উল্টো অবস্থায় আছে দেশ। নতুন শ্রমিক না গেলেও ফেরার  অপেক্ষার আছে শ্রমিকরা। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) তথ্যমতে, প্রতি মাসে গড়ে ৬০-৬৫ হাজার কর্মী বিদেশে যান। সে হিসাবে বছরে সাত থেকে আট লাখ কর্মী বিদেশে যান। বর্তমানে মহামারির কারণে গত মার্চ মাস পর্যন্ত ১ লাখ ৫৩ হাজার কর্মীর ইমিগ্রেশন হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১ লাখের মতো কর্মী বিদেশে যেতে পেরেছেন। এ ছাড়া ১ লাখ শ্রমিকের ভিসা হলেও করোনার কারণে যেতে পারেননি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন,  তিন কারণে শ্রমবাজারের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত দেখা যাচ্ছে। প্রথমত, বিশ্ব অর্থনীতি বর্তমান পরিস্থিতি। দ্বিতীয়ত, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে আসা। তৃতীয়ত, বাংলাদেশের করোনা টেস্ট নিয়ে বিশ্ববাজারে ভাবমূর্তি নষ্ট । আশার কথা শোনালেন অর্থনীতিবিদ ইব্রাহীম খালেদ। 

তিনি আগামীনিউজ ডটকমকে বলেন, বাংলাদেশের একটা সুবিধা আছে যে পণ্য রফতানি না হলেও শ্রম রফতানি থেকে আয় ভালোই হচ্ছে। কারণ দুইটাই রফতানি। করোনার কারণে শ্রম আয়ের যে ট্রেণ্ড বজায় আছে সেটা যদি বজায় থাকে তবে এক্ষেত্রে আমাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যেন বিভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলোকে জোর পদক্ষেপ নিতে বলে। পৃথিবীর কোথাও যেন স্ব স্ব কর্মক্ষেত্র থেকে কোন শ্রমিকের চাকরি চলে না য়ায়।

কাজ হারিয়ে দেশে ফেরা বা ফেরার অপেক্ষায় থাকা শ্রমিকদের নিয়ে বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। তারা বলছে, বিদেশ ফেরত কর্মহীন এসব মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি অথবা উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করে সরকার তাদের পুনর্বাসন করতে চায়। এ লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তারা যেসব দেশ থেকে ফেরত এসেছেন, সেখানে আবার যেন কাজে ফিরতে পারেন, সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।  ইতোমধ্যে ফেরত আসা শ্রমিকরা যেন আবার ওই দেশের কর্মস্থলে যোগ দিতে পারে। সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলেও জানিয়েছে মন্ত্রণালয়টি। 

মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ রাখছে যেন শ্রম বাজার টিকিয়ে রাখার যায়। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব  ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, আমরা আশায় আছি পরিস্থিতি অনুকূলে আসবে। আর বিদেশের মাটিতে আমাদের শ্রমীকদের আলাদা একটা বিশ্বাসযোগ্যতা আছে। বর্তমান যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে আশা করছি অচিরেই কেটে যাবে। তবে, যে পরিমাণ শ্রমিক ফিরে এসেছেন তুলনামূলকভাবে কম।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) প্রেসিডেন্ট বেঞ্জির আহমেদ বলেন, করোনাকালে শ্রমিকদের সাথে সাথে আমরও খুব কষ্টে আছি। আমরা চাই কোন শ্রমিক যেন কাজ না হারায়। এই করোনাকালে শ্রমিকরা যেন ভালোভাবে থাকতে পারে সেজন্য আমাদের তৎপরতা চালু আছে। তবে, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তাদের সাথে যোগাযোগ রাখছেন যাতে শ্রমিকরা যেন ভালো থাকে। এসব ক্ষেত্রে আমরা সরকারকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।

কিছু শ্রমিক ফিরে আসলে তাদের জন্য দেশীয় বাজারে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা , উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকার বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছেন উল্লেখ করে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেন, যারা বিদেশে আছেন তাদের নিজ নিজ কর্মস্থলে রাখার জন্য সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।  দেশে যে অল্প সংখ্যক শ্রমিক ফেরত এসছেন তাদের সরকার বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছে।

অনেকেই মনে করছেন, বাংলাদেশের সাথে বিভিন্ন দেশের বিমান চলাচল শুরু হলে বিপুলসংখ্যক শ্রমিককে দেশে ফিরতে হতে পারে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসগুলো যেন শ্রমীকদের জন্য তৎপরতা চালায়। এছাড়া, পাপুল কাণ্ড ও করোনা ভাইরাসের জাল সনদের খবরটি বিশ্ব গণমাধ্যমগুলোতে ঢালাওভাবে প্রচার হওয়ার পর বেকায়দায় খাতটি। করোনা পরবর্তী শ্রম বাজার নিয়ে অস্বস্থিতে পড়তে হবে বাংলাদেশকে তা অনেকেই এখন থেকেই বলতে শুরু করেছেন।    

আগামীনিউজ/এসএআই/এমআর