পাম, সয়াবিন, সানফ্লাওয়ার ও রাইস ব্র্যান অয়েল স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর

ম. শাফিউল আল ইমরান জুন ২২, ২০২০, ১০:৩১ এএম
সংগৃহীত ছবি

ঢাকা: পামঅয়েল, সয়াবিন, সানফ্লাওয়ার ও রাইস ব্র্যান অয়েলের মধ্যে বিভিন্ন রাসায়নিক মেশানোর ফলে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতি করছে। রান্নার কাজে ব্যবহৃত এসব তেলে বেশির ভাগেই মাত্রাতিরিক্ত এসিড ও ক্ষতিকর চর্বির উপস্থিতি রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহারের ফলে আমাদের শরীরে নানা জটিল রোগ তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। সাম্প্রতিক সময়ে ভোজ্যতেলের উপর কয়েকটি পরীক্ষায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। 
অপরদিকে, দেশে উৎপাদিত সরিষা ও তিশির তেলে কোন ভোজাল না থাকার পরও প্রচারণা না থাকা ও সয়াবিন, পাম তেল আমদানিকারকদের চটকদার বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে ভেজাল তেল দেদারছে গ্রহণ করছে মানুষ।  

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ভোজ্যতেলের ৭৫ ভাগ সয়াবিন তেলই আগাগোড়া ভেজাল। বিক্রি হচ্ছে নতুন তেল হিসেবে। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভেজালবিরোধী তৎপরতার মধ্যেও থেমে নেই অসাধু ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা চক্র। অপ্রতিরোধ্য দুষ্টব্যবসায়ীরা প্রায় সব খাদ্যসামগ্রীতেই ভেজাল দিচ্ছে।

অপরদিকে, আমাদের দেশে সরিষা ভাঙ্গা হয় ঘানিতে বা মেকানিকেল স্কপ্লেরে। সেখানে তেল আহরণের সময় কোন ক্যামিকেল ব্যবহার করা হয়না। পুরোটা প্রেশার দিয়ে তেল বের করা হয়। সরিষা থেকে যে তেল বের করা হয় সেখানে ১৮ থেকে ২০ শতাংশ তেল সরিষার খলের মধ্যে থেকে যায়। আবার সেটি কোন কোন ক্ষেত্রে ২২ শতাংশ গিয়েও ঠেকে। এর ফলে এই তেল বা আমাদের দেশে যেসব তেল নিজেরা তৈরি করি তাতে স্বাস্থ্যের কোন ক্ষতি হয়না। অর্থাৎ এ তেল ব্যবহারে গ্যাস্ট্রিক, আলসার, পেপটিক আলসার বা কোন রকম বদহজম বা শরীরের ক্ষতি হয়না। কিন্ত আমরা বিভিন্ন মিডিয়ার বদৌলতে বা বৈজ্ঞানিকদের গবেষণায় বিভিন্ন প্ররচণায় পাম, সয়াবিন বা রাইস ব্র্যান তেল ব্যবহার করে স্বাস্থ্যকে হুমকির মধ্যে ফেলছি। তারা, সবসময় নানান ধরণের স্বাস্থ্য সুবিধার কথা বলে বা কোলেষ্ট্ররল ফ্রি জাতীয় নানান প্রলোভনের মাধ্যমে এই তেল খেতে উৎসাহিত করছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পাম, সয়াবিন, সানফ্লয়ার ও রাইস ব্র্যান অয়েল এই ৪টি তেল কোন ধরণের প্রেশার দিয়ে তৈরি করা হয়না। এটা তৈরিতে ‘স্লভেন্ট এট্রাকশন’ ক্যামিকেলের ভিতর দিয়ে সিদ্ধ করে বের করা হয়। এর স্লভেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয় হেক্সেন (হেক্সেনের রাসায়নিক সংকেতঃ C6H14; গাঠনিক সংকেতঃ CH3-CH2-CH2- CH2- CH2-CH3) । এই হেক্সেন ক্যামিকেলের ভিতরে দিয়ে সিদ্ধ করে তেল আহরণ করা হয়। ক্যামিকেলের মধ্য হেক্সেন দিয়ে ৪৮ শতাংশ তেল বের করে নিয়ে আসা যায়। কিন্তু যেহেতু হেক্সেন মেশানো হয় সেহেতু আহরিত তেলের মধ্যে .০৫ শতাংশ থেকে .০২ শতাংশ “হেক্সেন” থেকে যায়। এই হেক্সেন মানব শরীরে প্রবেশ করার ফলে, গ্যাস্ট্রিক, আলসার, পেট জ্বালা, বুক জ্বালা ই্ত্যাদি অসুখের সৃষ্টি হয়। ফলে বাংলাদেশে প্রতি চারজনের এক জনের মধ্যে এ সমস্ত রোগ আছে। এর কারণ আমরা প্রতিনিয়ত অহরহ এই হেক্সেন মেশানো তেল রান্নার কাজে ব্যবহার করে নিজের অজান্তেই শরীরের ক্ষতি করছি।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এ্টা একটা আর্ন্তজাতিক চক্রান্ত। আমাদের দেশ বা ভারতীয় উপমহাদেশে যে সরিষা চাষ হয় তা যেন বন্ধ হয়ে যায়। এই সরিষা চাষ বন্ধ হলে তাদের পেসক্রিপশন অনুযায়ী তেল চলবে। 

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ওষুধ বিক্রি হয় গ্যাস্ট্রিকের। ফলে এই ওষুধ বিক্রিও বেড়ে গেছে। কারণ এই ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল উৎপন্নকারী বৈশ্বিক মাফিয়াদের একটা যোগসাজস রয়েছে যাতে এই উপমহাদেশে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদিত সরিষা ও তিশি যেন বিলীন হয়ে যায়।

জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (আইপিএইচ) পরীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে বিদ্যমান সয়াবিন তেলের মাত্র ১৩ শতাংশ খাঁটি। বাকি ৮৭ শতাংশই ভেজাল। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সয়াবিন তেলের ৪০০টি নমুনা সংগ্রহ করে আইপিএইচ। এই ভেজাল সয়াবিন তেল মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এতে এসিটিক এসিডের মাত্রা অনেক বেশি, যা মানবদেহ ক্ষয়কারী এসিড। এটি চোখে জ্বালা সৃষ্টি করে, নাকে শুষ্কতা ও প্রদাহ তৈরি করে এবং ফুসফুসে চাপ সৃষ্টি করে।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল ফোরাম ফর নিউট্রিশনের তথ্যানুযায়ী, মানবদেহে দৈনিক প্রয়োজনীয় ক্যালরির ৩০ শতাংশ ভোজ্যতেল থেকে আসা উচিত। অথচ দেশে মাথাপিছু বার্ষিক ভোজ্যতেল ব্যবহারের হিসাবে দৈনিক প্রাপ্ত ক্যালরির মাত্র ৯ শতাংশের উৎস ভোজ্যতেল। কিন্ত ব্যবহৃত তেলে ভেজাল থাকার কারণে উপকারের চেয়ে ক্ষতিই হচ্ছে বেশি।

স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সয়াবিন তেলে এ ধরনের ভেজাল মানবদেহে শক্তির যোগান ও টিস্যু গঠনে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। এসিটিক এসিডের অতিরিক্ত মাত্রা হার্টের জন্য ভয়ংকর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমনকি ক্যান্সারের মতো রোগও শরীরে বাসা বাঁধতে পারে। এ ছাড়া হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিসসহ শরীরের ওজন অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দিতে পারে।  

গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের ফুড অ্যাণ্ড নিউট্রেশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শম্পা শারমীন খান আগামীনিউজ ডটকমকে  বলেন,  আমাদের দেশে যেসব সয়াবিন আমদানি করা হয় সেগুলো অত্যান্ত নিম্ন মানের। মূলতঃ মেক্সিকান থার্ড গ্রেড সয়াবিন অত্যান্ত নিম্ন মানের কম দামে এনে সেগুলো রিফাইন করে স্বচ্ছ তেল আকারে দেশের বিভিন্ন কোম্পানি বিক্রি করে।

তিনি আরো বলেন, আমদানিকৃত রিফাইন করা তেলের বোতল বা জারে যে লেখা থাকে, ভিটামিন ‘এ বা ডি’ যুক্ত এগুলো কিছুনা। কারণ, ন্যাচারালি তেল হলে সেগুলোর মধ্যে ভিটামিন এ বা ডি থাকার কথা কিন্তু তারা যখন রিফাইন করে স্বচ্ছ করছে তখন ঐ তেলের মধ্যে এগুলোর অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায়না। এগুলোর চেয়ে রাইস ব্র্যান ওগুলো একটু ভালো কারণ আমাদের দেশে ধানের উৎপাদন ভালো।

তবে, সরিষা ও তিশির তেল সবচেয়ে ভালো এবং স্বাস্থসম্মত বলেও উল্লেখ করেন তিনি।এসব দেশীয় তেল কম ব্যবহার করলে খাবারটা ভালো হয়। আমরা তো রান্নায় সয়াবিন বেশি করে দেই কিন্তু সে তুলনায় সয়াবিন ও তিশির তেল কম করে দিলেও রান্নাটা ভালো হয়।

তিনি আরো বলেন,  একজন পুষ্টিবিদ হিসেবে আমরা তেলের মধ্যে আয়োডিন মানটা বেশি দেখি। আয়োডিনের মান ঠিক থাকলে সেই তেলটাকে স্বাস্থসম্মত হিসেবে মনেকরি। কিন্তু আমরা একটা গবেষণায় ‍দেখেছি বাজারে যেসব ব্রান্ডের সয়াবিন তেল আছে সেগুলোতে বোতলের গায়ে আয়োডিনের পরিমাণ দুই দশমিকের সামথিং লেখা থাকলেও আমরা পেয়েছি শুণ্য দশমিক সামথিং।    

তিনি মনে করেন, দেশীয় তেল ব্যবহার করলে একদিকে যেমন রোগব্যাধী থেকে মুক্ত থাকা যায় অপর দিকে, চাহিদা বাড়লে উৎপাদন বাড়বে তাতে কৃষক লাভবান হবে ও দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।   

আগামীনিউজ/ইমরান/তরিকুল/মিজান