ভয়াবহ দূষণকারী শিল্প-কারখানা নদীর তীরে

করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে দূষণ রোধে অভিযান: নৌ-প্রতিমন্ত্রী

তরিকুল ইসলাম সুমন মে ৪, ২০২০, ০৮:৪৪ এএম
ছবি সংগৃহীত

ঢাকা: সৃষ্টির আদি থেকেই নদীর তীরেই গড়ে উঠেছে জনবসতি।এ জনবসতির সুবিধার জন্যই নদীর তীরেই গড়ে উঠেছে হাট-বাজার শিল্প কারখানা। আমাদের দেশেও এর ব্যাত্যয় ঘটেনি।  দেশের ৬৪ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর তীরে প্রায় ৪৯ হাজার নানা ধরনের শিল্প কলকারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। তবে নদী দূষণের শীর্ষে রয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের নদীগুলো। এ অঞ্চলের নদীর তীরে গড়ে উঠা শিল্প প্রতিষ্ঠানরে নেই বর্জ্য শোধনের ব্যবস্থা। অনেক শিল্প বর্জ্য শোধনের ব্যবস্থা থাকলেও খরচের কারণে বর্জ্য শোধনাগার বা ইটিপি না চালিয়ে সরাসরি বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে। 

মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশে জাহাজ ভাঙা শিল্প প্রায় ১০০টি, শিপ বিল্ডিং শিল্প ৫০টির বেশি, এরমধ্যেই রয়েছে ১০টি রফতানিমুখী জাহাজ শিল্প, ২০০ এর অধিক ডকইয়ার্ড, এছাড়াও ২০০ এর অধিক ছোট জাহাজ মেরামত কারখানা রয়েছে নদীর তীরে। এছাড়াও রয়েছে ৭ হাজার ৭৭২টি ইটভাটা। সাভারের ২০০ ট্যানারিও রয়েছে। যার অধিকাংশই নদীর তীরে।

নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী আগামীনিউজ ডটকমকে বলেন, দেশের সকল নদীর দখল ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে একটি মাস্টার প্লান তৈরি করা হয়েছে।  সেখানে কাজ নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে।  এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে চট্টগ্রামের দূষণ রোধে নজর দিতে। তেমনি নৌ মন্ত্রণালয়, স্থানীয়  সরকার মন্ত্রণালয়, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয় সমন্বিত ভাবে দখল ও দূষণ রোধে কাজ করছি। 

তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন নদীর তীর থেকে গত ৯ বছরে প্রায় ১৯ হাজার স্থাপনা উচ্ছেদ করেছি। এখানে অনেক শিল্প বা শিল্পের আংশিক উচ্ছেদ করা হয়েছে।

খালিদ মাহমুদ আরো বলেন, যারা নদী দূষণ করছে তাদের শিল্পে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং শিল্প মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। এছাড়াও সাভারে স্থান্তরিত চামড়া শিল্পে ইটিপি স্থাপনের কাজ দ্রুত করাও তাগিদ দেয়া হয়েছে।  

নৌ-পরিবহণ প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, সারাদেশে ৪৯ হাজার অবৈধ নদ-নদী দখলদার শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেক শিল্প-কারখানা রয়েছে। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেই সারা দেশে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে।

রাজধানীর চারপাশের চারটি নদীর পানি পান ও প্রাণীর বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে বহু বছর আগে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মেঘনা, ধলেশ্বরী ও কর্ণফুলী। এসব নদীর তীরে গড়ে ওঠা দূষণকারী শিল্প-কারখানার বেশির ভাগের মালিক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদেরা। পরিবেশ অধিদপ্তর সেগুলোকে জরিমানাও করেছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সারা দেশে বর্জ্য পরিশোধনযন্ত্র স্থাপন করা উচিত এমন কারখানার সংখ্যা ২ হাজার ৪০০টি। এর মধ্যে ৪০০টি কারখানায় ওই দূষণনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র নেই। আর যাদের ইটিপি আছে, তাদের বেশির ভাগই চালু রাখে না বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে এ বিষয়ে  পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট টিমের মাধ্যমে প্রয়শই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। জরিমানাসহ বর্জ্য নিগর্মন লাইন বন্ধও করে দেয়া হচ্ছে। 

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক আগামীনিউজ ডটকমকে বলেন, আমাদের অন্যতম কাজ হলো নদী দূষণ রোধ করে নদীকে স্বাভাবিক রুপে নিয়ে আসা। শুধু ঢাকার চার পাশের চার নদীর তীরে ( বুড়িগঙ্গা, তুরাগ শীতলক্ষ্যা ও বালু) কয়েক হাজার শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যাদের অধিকাংশেরই ইটিপি নেই। তারা তাদের বর্জ্য সরাসরি সুয়ারেজ লাইনে ফেলছে, অনেকের থাকলেও তা চালু করছে না। 

বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান আরো বলেন, আমরা নিজ উদ্যোগে ১৪৮টি উৎস্য মুখ দিয়ে সুয়ারেজ বর্জ্য, শিল্প-কারখানার বর্জ্য নদীর পানিতে মিশছে যার তালিকা করেছি। এর  মধ্যে ছয়টি উৎস মুখ সিসি ঢালাই দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এছাড়াও আমরা নিজেরাই সদরঘাটে দুটি সুয়ারেজ মুখে সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন করেছি। এছাড়াও ঢাকার বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু এবং তুরাগ নদীর যে সকল প্রবেশ মুখ দিয়ে বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে তার একটি আলাদা তালিকাও করা হচ্ছে। এজন্য কাজ করছে পরিবেশ অধিদপ্তরও। 

নদী দূষণ নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে সরকারের দায়িত্ব প্রাপ্ত সংস্থা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সার্বক্ষনিক সদস্য মো. আলাউদ্দীন আগামীনিউজ ডটকম কে বলেন, আমরা দখল ও দূষণকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করে নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। দেশে করোনা সংক্রমণের আগে পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় এবং নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় অভিযান শুরু করেছিল। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারো অভিযান শুরু হবে। 

সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে নদী দূষণকারী এসব উৎসের তালিকা সরকারের উচ্চপর্যায়ে দেয়া হয়েছে। ওই তালিকায় জায়গা পেয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ওয়াসা, হাসপাতালসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ট্যানারি, সিমেন্ট কারখানা, ডকইয়ার্ড, গার্মেন্টস কারখানা, সিটি করপোরেশনসহ নানান প্রতিষ্ঠান। খুব শিগগিরই সরকার এসব নদী দূষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছে। নদী দূষণ রোধে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বৈঠক হয়েছে। 

সূত্র জানায়, কর্ণফুলী নদীর তীরে শিল্প কারখানা রয়েছে প্রায় আড়াই হাজার। এর মধ্য থেকে প্রায় ২০০ প্রতিষ্ঠান থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলছে। দূষণ তালিকার শীর্ষে রয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। কর্ণফুলী নদীর পাড়ের অধিকাংশ শিল্প কারখানার বর্জ্য পরিশোধন যন্ত্র বা ইটিপি নেই। যেসব প্রতিষ্ঠানের ইটিপি আছে তারাও এ যন্ত্র ব্যবহার করে না। নদীতে চলাচলরত ৩ হাজার ছোট জাহাজ, তেলের ট্যাংকারবর্জ্যে প্রতিনিয়ত কর্ণফুলী দূষণ হচ্ছে। 

পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) গবেষণা মতে, নদীর দুই তীরে স্থাপিত প্রায় ২১৭টি প্রতিষ্ঠান তাদের বিষাক্ত বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলে। এগুলোর মধ্যে ১৯টি ট্যানারি, ২৬টি টেক্সটাইল মিল, দুটি রাসায়নিক কারখানা, চারটি সাবান ফ্যাক্টরি, দুটি তেল শোধনাগার, পাঁচটি মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা, বিটুমিন প্লান্ট, সিইউএফএল, কাফকো, চন্দ্রঘোনা কর্ণফুলী পেপার মিল অন্যতম। দূষণ তালিকার শীর্ষে রয়েছে সরকারি চারটি প্রতিষ্ঠান।

আগামীনিউজ/তরিকুল/মিজান