ঢাকা: বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের ধাক্কা পড়েছে বাংলাদেশেও। ভাইরাসটির বিস্তারের সাথে সাথে থমকে গেছে ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, স্থানীয় বাজারের চাহিদা মেটানো এসব উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে নীতি নির্ধারকদের। প্রয়োজন মতো সরবরাহ করতে হবে সহজ শর্তের ঋণ। তবে, ব্যাবসায়ীরা বলছেন, আরএমজি খাতের মতো এ শিল্পের পাশে না দাঁড়ালে সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা ব্যাবসা যেমন বন্ধ হয়ে যাবে তেমনি লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হওয়ার ফলে দেশে অপরাধ প্রবণতাও বেড়ে যাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এইসব কুটির, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পগুলোতে গার্মেন্টস এর চেয়ে কম মজুরিতে কয়েক লাখ শ্রমিক ছাড়াও 'দিন হাজিরা' ভিত্তিতে কাজ করে অনেকেই। বর্তমানে শ্রমিকরা নিদারুন কষ্টে দিনপাত করছে। আবার, বর্তমান প্রেক্ষাপটের কারণে এই শিল্পগুলো অতি জরুরী না হওয়ার কারণে বন্ধ হয়ে আছে।
এ খাতের শিল্প উদ্যোগতারা বলছেন, এই শিল্পের কাঁচামাল বেশীরভাগই দেশেই পাওয়া যায়। এ শিল্প বাঁচলে দেশের টাকা দেশেই থাকে। আপরদিকে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোতে দেশীয় মালিকরা পায় কাটিং আর মেকিং চার্য। আথচ ক্ষুদ্র কুটির ও মাঝারি শিল্পের রপ্তানিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখলেও তাদের সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। সরকার যেসব প্রতিষ্ঠান ও রপ্তানিমুখী বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করলেও দেশের ক্ষুদ্র মাঝারি ও কুটির শিল্প বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে 'দেশীয় শিল্প' বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের জন্য কোনো প্রণোদনার ব্যবস্থা নেই।
অপরদিকে, ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পের মালিকদের উৎপাদিত পণ্য রপ্তানী করার সামর্থ্য না থাকার কারণে তারা বিভিন্ন রপ্তানীকারকের কাছে তাদের পণ্য গুলো বিক্রি করে। এ কারণে লাভের পরিমাণটা তারা সেভাবে ভোগ করতে পারেনা।
এ কারণে সরকারের প্রাণদনা অতি জরুরীভাবে না আসলে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয় বলে ব্যবসায়ীদের অভিমত। এই খাতের ব্যবসায়ীদের আশা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেভাবে রপ্তানীমুখী শিল্পের দিকে নজর দিয়েছেন তেমনি ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পের দিকেও নজর থাকবে সরকারের।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ১৬ থেকে ৩শ' জনের কম কর্মীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কারখানা অনু, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের আওতায় পড়ে। বাংলাদেশের মোট শিল্পের ৯৩ শতাংশই এমন ধরণের উদ্যোগ। এসব শিল্প মূলত স্থানীয় বাজারের বিভিন্ন পণ্য সরবার করে, পাশাপাশি রপ্তানীতেও কিছুটা ভূমিকা রাখে। পুঁজি কম এবং সঞ্চয় সীমিত হওয়ায় উদ্যোক্তাদের ঝুঁকি মোকাবেলার ক্ষমতাও কম । তাই করোনা বিপর্যয়ে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ায় মারাত্মক হুমকিতে পড়তে যাচ্ছে কর্মসংস্থানে বড় ভূমিকা রাখা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো।
এছাড়া, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাজধানীতেই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আছেন প্রায় সাড়ে তিন লাখ। তারা নিয়মিত দোকানপাট খুলতে পারছেন না। ভাসমান ব্যবসায়ীদের কথা বাদই থাকল। পুরো ঢাকা যেন থমকে গেছে। এক ধরণের স্থবিরতার আওতায় মানুষের জীবনের চলাফেরা এবং খাওয়া-দাওয়া।
দেশীয় শিল্প ও বাণিজ্য রক্ষা জাতীয় কমিটির আহবায়ক ড. মোহাম্মদ আব্দুল হাকিম মন্ডল আগামীনিউজ ডটকমকে বলেন, এই মহুর্তে দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করতে হলে সরকারের জরুরী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এই শিল্প বন্ধ হয়ে গেলে প্রচুর লোক বেকার হয়ে যাবে। আর বেকারত্ব বেড়ে গেলে সমাজে অপরাধ প্রবণতাও বেড়ে যাবে।
বর্তমানে এই খাতের ব্যাবসায়ীদর হাতে শিল্প চালিয়ে নেওয়ার মতো টাকা নেই উল্লেখ করে ড. হাকিম আরো বলেন, এ খাতের অনেক উদ্যোক্তারা ব্যাংকের সিসি লোন নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছে। সরকার আগামী জুন পর্যন্ত লোনের কিস্তি স্থগিত করে রাখলেও বর্তমানে অর্থের সংকটের কারণে অনেক নতুন উদ্যোক্তাকে ব্যবসা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। কুটির ক্ষুদ্র এবং মাঝারি এই ব্যবসায়ীরা তাদের মজুদ কাচামাল,ভাড়া ক্রীত ফ্যাক্টরি এবং পণ্য বিক্রি করতে পারছে না বিধায় শিল্পটি ক্ষতির মুখে পড়ছে। এ অবস্থায় এই শিল্পটি বাঁচিয়ে রাখতে সরকারকে বিশেষ প্রাণদনা দেবার দাবি করছি।
ক্ষুদ্র ব্যবসায় মন্দা চলছে। ঋণ প্রবাহ কমে গেছে উল্লেখ করে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। সেখানে আরো বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে গত কয়েক মাস ধরেই ক্ষুদ্র ব্যবসায় মন্দার পাশাপাশি ঋণ প্রবাহ কমে গেছে।
ফলে, এখাতের ব্যবসায়ীরা একেবারেই ধরাশায়ী হয়ে পড়েছেন। জানুয়ারিতে কৃষি ও গ্রামীণ অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পে ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল ২ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারিতে বিতরণ করা হয়েছে ১ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। ওই ১ মাসের ব্যবধানে এসব খাতে ঋণ বিতরণ কমেছে ৩১৫ কোটি টাকা। একই সময়ে ঋণ আদায়ও কমেছে।
জানুয়ারিতে ঋণ আদায় হয়েছিল ২ হাজার ২৮ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। এক মাসের ব্যবধানে ঋণ বিতরণ কমেছে ৪৮ কোটি টাকা। একই অবস্থা এসএমই খাতে। এ খাতে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল ৪৩ হাজার কোটি টাকা। জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বিতরণ করা হয়েছে ৩৯ হাজার কোটি টাকা। ওই সময়ে এ খাতে ঋণ বিতরণ কমেছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বৈশ্বিক এ সংকটকালে দেশের কয়েক লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (এসএমই) জন্য প্রাণোদনা দেবার পাশাপাশি সরকারকে 'বিশেষ ফান্ড' গঠন জরুরী। এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, করোনার কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা বেশি সমস্যায় পড়বে। তাদের প্রতি সরকারের বিশেষ নজর দিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, শুধু মাত্র বড় খাত গুলোকে না দিয়ে ছোট খাত গুলো (যারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে) তাদের যাতে দেয়া যায়, সেভাবে সরকারি ভর্তুকি পুনর্বিন্যাস করা প্রয়োজন। উৎপাদন খাতে, কৃষি খাতে, ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পখাতে যারা নতুন করে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের দিকে নজর রাখতে হবে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, সরকার যথাসময়ে বিশেষ পদক্ষেপ না নিলে এ ব্যবসায় টিকে থাকাই দায় হয়ে দাঁড়াবে।
আগামীনিউজ/ইমরান/নাঈম