ঢাকা : মায়ের দোয়া এন্টাপ্রাইজ এর স্বত্বাধীকারী রংপুরের ফারুক আহমেদ এমন অবস্থা আগে দেখেননি। এতো বছর শীত মৌসুমে বাজারে অনেকটা উৎসব লেগে থাকতো কিন্ত চীনের করোনার ভাইরাসের প্রভাবের কারণে রফতানি বন্ধ হয়ে যাবার পর ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। কর্মীদের চলে যেতে বলেছেন। কুঁচিয়া-কাঁকড়ার রফতানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে ঢাকার ব্যবসা গুটিয়ে রংপুরে চলে গেছেন। প্রায় এক যুগের ব্যবসায় এমন পরিস্থিতি তিনি আগে দেখেননি।
শুধু ফারুক আহমেদ নয়, সারাদেশের হাজার হাজার চাষী ও ব্যবসায়ীদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে। চাষী ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, রফতানি বন্ধ থাকার কারণে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায় থেকে সহযোগীতা করেনি কেউ। তাছাড়া, আমরা কি অবস্থায় আছি সে খোঁজ রাখারও প্রয়োজন মনে হয়না।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, একদিকে শুষ্ক মৌসুম চলায় পানি শুকিয়ে যাওয়ায় ফলে কুঁচিয়া ও কাঁকড়ার খামারে প্রতিদিন পানি দিতে হচ্ছে। এর ফলে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে দাম ও অর্ডার না থাকায় চাষীদের পরিচর্যা করার আগ্রহ কমে যাচ্ছে। ফলে, মরে, পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শতভাগ রফতানিমুখী কুঁচিয়া ও কাঁকড়া। অন্যদিকে, করোনার প্রভাবে ৯০ শতাংশ চীনা অর্ডার বন্ধ হয়ে গেছে। এরপর সিঙ্গাপুর, হংকং এবং মালেশিয়ায়ও নতুন করে রফতানির অর্ডার আসছেনা। ফলশ্রুতিতে সারাদেশে বিশেষ করে- সুন্দরবনের নিকটবর্তী পাঁচ জেলা ছাড়াও কক্সবাজার-চট্টগ্রাম অঞ্চলের কাঁকড়া ও কুঁচিয়ার নতুন উৎপাদন বন্ধ রেখেছে চাষীরা। চাষী ও ব্যবসায়ীরা আগামীতে এ ব্যবসায় বড় ক্ষতির মুখে পড়বে ভেবে খরচ কমাতে অনেকে তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছাঁটাই করছে। সবচেয়ে বিপদে কাঁকড়া ও কুঁচিয়া খামারের হাজার হাজার শ্রমিক। তারা একদিকে যেমন বেকার হয়ে আছেন অন্যদিকে নতুন কোনো কাজ না পাওয়ায় সংসার সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছে।
অপরদিকে আগামীনিউজ ডটকমের আগৈলঝড়া প্রতিনিধি জানিয়েছেন যে, করোনাভাইরাসের কারণে চীনের সাথে আমদানি-রফতানি বন্ধ হওয়ায় কোটি কোটি টাকার ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে পড়েছে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার কুঁচিয়া ব্যবসায়ীরা। কুঁচিয়া সংগ্রহকারী ও ব্যবসার সাথে জড়িত কমপক্ষে পাঁচ শতাধিক পরিবার ব্যাংক ঋণ ও দাদন পরিশাধ নিয়ে মহাবিপদে পরেছেন। উপজেলার কুঁচিয়া ব্যবসায়ী সুশীল মন্ডল, জয়দেব মন্ডল, অর্জুন মন্ডল, জহর মন্ডল, ভীম মন্ডল ও প্রদীপ বাড়ৈ জানান, আগৈলঝড়া থেকে আগে প্রতিমাসে কমপক্ষে চার কোটি টাকার কুঁচিয়া রফতানি হতো বিদেশে। বিশেষ করে রফতানির তালিকায় থাকা চীনেই রফতানি হতো ৯০ শতাংশ কুঁচিয়া।
বাকি ১০ শতাংশ রফতানি করা হতো হংকং ও তাইওয়ানসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশে। ফলে এ ব্যবসার সাথে জড়িত থেকে ভাগ্য পরিবর্তন করেছিল অনেকেই। ব্যবসায়ীরা আরো জানান, চীনের নাগরিকদের দৈনন্দিক খাদ্য তালিকায় কুঁচিয়া অন্যতম একটি জনপ্রিয় খাদ্য। কিন্তু দেশটিতে সম্প্রতি করোনাভাইরাস মারাত্মক আকারে বিস্তারের কারণে চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি থেকে চীনের সাথে কুঁচিয়া রফতানি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে চরম বিপাকে পরেছেন উপজেলার কুঁচিয়া সংগ্রহকারী, ব্যবসায়ী ও রফতানির কাজের সাথে জড়িত আড়ৎদারসহ প্রায় পাঁচ শতাধিক ব্যবসায়ী পরিবার।
রংপুরের পীরগঞ্জের চতরা এলাকার কুঁচিয়া শ্রমিক বোনোমালী দাসের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত দুই সপ্তাহ থেকে বন্ধ হয়ে গেছে তাদের কাজ। ঠিক কী কারণে বন্ধ হয়ে গেছে তিনি জানেন না। তবে এটুকু জানেন কুঁচিয়ার বাজার পড়ে গেছে এজন্য মালিক খামার বন্ধ করে দিবে।
বাংলাদেশ লাইভ অ্যান্ড চিলড ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলসিএফইএ) হিসাব অনুযায়ী, কাঁকড়া ও কুঁচিয়া রফতানির মাধ্যমে বাংলাদেশের বছরে ১ হাজার ১শ কোটি টাকা আয় হয়ে থাকে। কিন্ত এ খাতের অন্য ব্যবসায়ীরা বলছেন, অ্যাসোসিয়েশনের হিসেবের চেয়ে অনেক বেশি কুঁচিয়া-কাঁকড়া রফতানি করা হয়। আর প্রতিবছর শীত মৌসুমে আরো নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি হয়। মৎস্য অধিদফতরের হিসাব মতে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে কুঁচিয়ার উৎপাদন ১৪ হাজার মেট্রিক টন, যা পরের অর্থবছরে আরো ৩ হাজার মেট্রিক টন বেড়েছিলো।
বিএলসিএফইএ আরো জানায়, কাঁকড়া ও কুঁচিয়া রফতানির মাধ্যমে বাংলাদেশ বছরে যে টাকা আয় করে থাকে তার ৯০ শতাংশ আসে চীন থেকে। কিন্তু বর্তমানে করোনাভাইরাসের কারণে চীনের বাজারে রফতানি বন্ধ থাকার কারণে এই খাত থেকে আয় শূন্য থাকতে হবে সরকারকে।
বিএলসিএফইএ এর মহাসচিব কাজী মাহাবুবুল আলম আজাদ আগামীনিউজ ডটকমকে বলেন, ‘চীনের কারোনাভাইরাসের কারণে আমাদের রফতানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে আমরা ক্ষতির মুখে পড়েছি। এছাড়া সারা বছর ছোট খামারীদের যে লোন দিয়েছি সিজনের সময় পরিশোধ করার কথা থাকলে তারা তা দিতে পারছেনা এজন্য আমরা ডাবল ক্ষতির মুখে পড়েছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘চীনে করোনা পরিস্থিতির কবে উন্নতি হবে সেদিকে তাকিয়ে আছি আমরা। অবস্থার উন্নতি না হলে আমরা একদম পথে বসে যাবো। এখন যে পরিস্থিতি এ থেকে উত্তরণের কোন পথ আছে কিনা জানিনা। রফতানি বা নতুন বাজার ধরতে সরকারের কিছু করার আছে কিনা সেটাও এ মুহুর্তে বলতে পারছিনা। শুধু এটুকু বলতে পারি আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি, সরকার বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে।’
আগামীনিউজ/ইমরান/ডলি/সবুজ