গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে ১০ শতাংশ মা

মাহমুদা ডলি ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২০, ০৮:২৮ পিএম
প্রতীকী ছবি

রাজধানীর মিরপুর ডিওএইচএসের বাসিন্দা তানিয়া আহমেদ (৩০) বললেন, ‘আমার নিজের ওজন বেশি। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তা প্রথম জানতে পারি সন্তান গর্ভধারণের আট সপ্তাহে রক্ত পরীক্ষায়। শুরুতে একটি ইনসুলিন তিনবার খাওয়ার আগে নিতে হতো এবং আরেকটি ইনসুলিন নিতে হতো রাতে খাওয়ার পর। সেই সঙ্গে মেনে চলতে হয়েছে খাবারের সুষম পরিমাণ।’

তানিয়া আহমেদ এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানান, নিয়ম মেনে চলার সুফল পাচ্ছেন। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে, নিয়ম মেনে চলেছি বলেই, গর্ভের সন্তান আর আমি ঝুঁকিমুক্ত ও টেনশনহীন জীবনযাপন করছি।

তিনি আরো জানান, অন্য সব খরচ বাদ দিয়ে গর্ভাবস্থায় তাঁর প্রায় ৩০ হাজার টাকার শুধু ইনসুলিনই কিনতে হয়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এটা অনেক বেশি খরচ। তবে চিকিৎসকের পরামর্শে সম্পূর্ণ নিয়ম মেনে চলায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ছিল। সন্তান একদম সুস্থ অবস্থায় নির্ধারিত সময়েই জন্ম নিয়েছে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, বর্তমানে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের বিপদে রয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ মা। ডায়াবেটিক মায়ের গর্ভস্থ শিশুর হৃদরোগের ঝুঁকি সাধারণ শিশুর তুলনায় ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি। এই সব শিশুর জন্মগত হার্টের ছিদ্র, হার্টের ভাল্বের ত্রুটি, হার্টেও গঠন ও রক্ত নালীর ত্রুটি, হার্ট মাসলের বাড়তি বৃদ্ধি (HCM) Ges Persistent Pulmonary Hypertention (PPH) এর মতো হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই সময় নিয়ম না মানলেই মা ও শিশুর স্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকিতে পাড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলেও জানান সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ডায়াবেটিক মায়ের শরীরে গ্লুকোজের আধিক্যই শিশুর হৃদরোগের কারণ। এছাড়া গ্লুকোজ কমানোর জন্য শিশুর অগ্নাশয় যে অতিরিক্ত ইনসুলিন নিঃসরণ করে তা থেকে শিশুর হার্ট মাসলের বাড়তি বৃদ্ধি ঘটে(HCM)। জন্ম পরবর্তী শিশুর রক্তে গ্লুকোজের স্বল্পতা, জন্মকালীন সময়ে অক্সিজেনের অভাব, শ্বাসকষ্ট, Polycythemia-এই বিষয়গুলো শিশুর PPH এর আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দেয়।

জাতীয় অধ্যাপক শাহলা খাতুন বললেন, আগের চেয়ে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। গর্ভাবস্থায় হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়, তাই যাদের ডায়াবেটিসের প্রবণতা থাকে, তাদের গর্ভধারণের সময় ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। গর্ভের প্রথম ১২ সপ্তাহে ডায়াবেটিস ধরা পড়লে বলা হয় তাদের আগেই ডায়াবেটিস ছিল, কিন্তু তারা জানতেন না।

গর্ভকালীন সময়ে এই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে মা ঝুঁকিতে পড়েন। সে ক্ষেত্রে জন্মগত ত্রুটি নিয়ে সন্তান জন্ম নেওয়ার ঝুঁকি ৮ শতাংশ বেশি থাকে। জাতীয় অধ্যাপক শাহলা খাতুন আরো বলেন, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে গর্ভাবস্থায় মা ও গর্ভের সন্তানের ক্ষতি হয়, তা মাকে জানাতে হবে। মাকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে যে, তিনি ভালো থাকবেন, গর্ভের সন্তানকে সুস্থ রাখবেন।

নজরদারির ক্ষেত্রে সন্তানসম্ভাবা মায়ের সেবাদানকারীকেও সচেতন হতে হবে। তার মতে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সদিচ্ছাই যথেষ্ট। শাহলা খাতুনের পরামর্শ হলো, প্রজননক্ষম প্রত্যেক নারীর ডায়াবেটিস পরীক্ষা করে রাখা জরুরি। ডায়াবেটিসের কথা আগে থেকে জানা থাকলে গর্ভধারণের সময় চিকিৎসা দিতে সুবিধা হয়। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মায়েদের ৫০ শতাংশের সন্তান প্রসবের পর ছয় সপ্তাহের মধ্যে ডায়াবেটিস আর থাকে না। তবে তাদের ৮০ শতাংশের ক্ষেত্রে পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক স্ট্যানফোর্ড চিলড্রেনস হেলথের চিকিৎসাবিষয়ক জার্নালে ডায়াবেটিস ও গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ে বলা হয়েছে। অনেক নারীর গর্ভধারণের আগে ডায়াবেটিস হতে পারে। আবার অনেক নারীর শুধু গর্ভধারণের সময়েই ডায়াবেটিস হতে পারে। গর্ভধারণ করা নারীদের প্রতি ১০০ জনে ৩ থেকে ৯ জনের ডায়াবেটিস ধরা পড়ে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, বছরে দেশে মোট সন্তান প্রসবের ঘটনা ঘটে ২১ লাখ ৯০ হাজার। তবে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের সঠিক পরিসংখ্যান নেই।

ডায়াবেটিস শনাক্তকারী পরীক্ষা:
গর্ভাবস্থায় চিকিৎসকের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই ঝুঁকিপূর্ণ সকল গর্ভবতী মহিলার ডায়াবেটিস শনাক্তকারী পরীক্ষা OGTT (ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট) করে ডায়াবেটিস শনাক্ত করতে হবে। এই পরীক্ষায় খালি পেটে ও ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর রক্তের সুগার পরীক্ষা করা হয়। প্রথম সাক্ষাতে এই পরীক্ষা স্বাভাবিক থাকলে গর্ভকালীন ২৪-২৮ সপ্তাহে আবার একই ভাবে পরীক্ষা করে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস আছে কিনা নিশ্চিত হতে হবে।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসা
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূল বিষয়গুলো হলো সঠিক খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, পরিমিত হাল্কা ব্যায়াম, নিয়মিত ডায়াবেটিসের মাত্রা নিরূপণ ও ওষুধের ডোজ নির্ধারণ, নিয়মিত গাইনি ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ।

খাদ্য তালিকা : গর্ভাবস্থায় সকলেরই সঠিক পরিমাণে সুষম খাদ্য গ্রহণ করা প্রয়োজন। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকলে ওজন অনুযায়ী একটি খাদ্য তালিকা মেনে চলা প্রয়োজন, সাধারণভাবে খাদ্যতালিকা মেনে চলা প্রয়োজন। সাধারণভাবে খাদ্যতালিকায় দৈনিক শতকরা ৪০ ভাগ শর্করা, ৪০ ভাগ আমিষ ও ২০ ভাগ চর্বি জাতীয় খাদ্য বা ফ্যাট খাওয়া যেতে পারে। গর্ভকালীন সময়ের ওপর নির্ভর করে একজন পুষ্টিবিদ অথবা ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ প্রদত্ত খাদ্য তালিকা মেনে চলা প্রয়োজন।

ব্যায়াম : ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য গর্ভাবস্থায় নিয়মিত হাল্কা হাঁটার অভ্যাস থাকা ভালো, তবে কোনো অবস্থাতেই কোনো ভারি ব্যায়াম করা যাবে না।

ইনসুলিন : এখনও পর্যন্ত গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের প্রধান চিকিৎসাই হচ্ছে ইনসুলিন। সঠিক খাদ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেও যদি ডায়াবেটিস নির্ধারিত মাত্রার (খালি পেটে ৫.৫ মিলি মোল/লি: এর বা খাবার ২ পর ৬.৫ মিলি মোল/ লি:) বেশি থাকে তবে সঙ্গে সঙ্গে ইনসুলিনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস সুনিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন।

মনিটরিং : গ্লুকোমিটারের সাহায্যে নিয়মিত রক্তের সুগার পরীক্ষা ও ইনসুলিনের মাত্রা নির্ধারণ গর্ভকালীন ডায়াবেটিস চিকিৎসার অন্যতম প্রধান ভিত্তি, সকল গর্ভবতী মহিলারই এ বিষয়ে সঠিক শিক্ষা ও চর্চা থাকা প্রয়োজন। এছাড়াও নিয়মিত রক্তচাপ মাপা, গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধি পরিমাপ করাও একজন গর্ভকালীন ডায়াবেটিক মহিলার জন্য অত্যাবশ্যকীয়।

প্রসব সময় নির্ধারণ : কোনো জটিলতা না থাকলে একজন গর্ভকালীন ডায়াবেটিক মহিলারও স্বাভাবিক প্রসব হতে পারে। ‘গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকলেই সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে প্রসব করানো প্রয়োজন’- এ ধারনাটি সঠিক নয়। প্রসবের পর পরই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুকে মায়ের বুকের দুধ দিতে হবে। মায়ের  ডায়াবেটিস থাকা এর জন্য কোনো বাধাই নয়।

ডেলিভারির সময় সতর্কতা :
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রেও কিন্তু স্বাভাবিক ডেলিভারি হতে কোনও বাধা নেই। যদি মায়ের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, প্রি-এক্লাম্পশিয়া, দীর্ঘস্থায়ী কোনো জটিলতা থাকে, বেশি ওজনের বাচ্চা অথবা গর্ভস্থ ভ্রূণের বৃদ্ধি কম হয়, এসকল ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই (১-২ সপ্তাহ) নরমাল অথবা সিজারের মাধ্যমে ডেলিভারি করে ফেলা উচিৎ। ডেলিভারির সময় অবশ্যই মায়ের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ৪.৫-৫ মিলিমোল/লিটার রাখতে হবে।
প্রসব পরবর্তী চিকিৎসা

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রসবের পর পরই ইনসুলিনের প্রয়োজনীয়তা কমে যায়। এজন্য প্রসবের পর পরপরই মায়ের রক্তের সুগার পরীক্ষা করে পরবর্তীতে ইনসুলিন দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এসময় রক্তের সুগার স্বাভাবিক মাত্রায় থাকলে ইনসুলিন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এবং প্রসবপরবর্তী ৬-১২ সপ্তাহে আবার ডায়াবেটিস শনাক্তকারী পরীক্ষা করে ডায়াবেটিস আছে কিনা নিশ্চিত করতে হয়। একবার গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকলে পরবর্তীতে ডায়াবেটিস হবার ঝুঁকি বেশি থাকে। সেজন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়ামের মাধ্যমে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখলে, ভবিষ্যত ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা:
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস গর্ভকালীন সময়ে মা ও শিশু দুজনের জন্যই ঝুঁকির কারণ হতে পারে। ডায়াবেটিস সুনিয়ন্ত্রিত না থাকলে গর্ভপাত, গর্ভে শিশুর মৃত্যু, শিশুর জন্মগত ত্রুটি, শিশু মৃত্যু এবং জন্মপরবর্তী শিশুর বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে। এছাড়াও যে শিশুর গর্ভাবস্থায় মায়ের ডায়াবেটিস থাকে পরবর্তী জীবনে সে শিশুর ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা অন্যদের চেয়ে বেশি থাকে। সুতরাং গর্ভাবস্থায় নির্দিষ্ট সময়ে ডায়াবেটিস নিরূপণ ও সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে একজন ডায়াবেটিক মা সুস্থ শিশুর জন্ম দিতে পারেন এবং সঠিক জীবনযাত্রা মেনে চলার মাধ্যমে নিজেকে ও শিশুকে ভবিষ্যতে ডায়াবেটিসমুক্ত রাখতে পারেন।

মা ও সন্তানের ঝুঁকি :
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের চিকিৎসকদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বংশে ডায়াবেটিসের ইতিহাস থাকলে, অধিক ওজন, বয়স ২৮ বছরের বেশি এমন মায়েদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি। সাধারণত ২০ বা ২৪ সপ্তাহের পর যে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে, তা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস। আগে থেকে ডায়াবেটিস রয়েছে এমন মায়েদের গর্ভধারণের সময় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে উচ্চ রক্তচাপ থেকে মায়ের একলাম্পশিয়া বা খিঁচুনি হতে পারে। সময়ের আগে প্রসববেদনা শুরু বা অপরিপক্ব সন্তান প্রসবের ঝুঁকি থাকে। মায়ের দেহ থেকে গর্ভের সন্তানের দেহে গর্ভফুলের মাধ্যমে রক্ত চলাচল ব্যাহত হতে পারে। প্রসব-পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে গর্ভের সন্তানের ওজন অনেক কম অথবা অনেক বেশি (ম্যাক্রোসেমিয়া) হতে পারে। জন্মের পর সন্তানের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে গিয়ে খিঁচুনি, শ্বাসকষ্ট এবং দেহে তাপমাত্রা বজায় রাখার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। এতে সন্তান জন্ম নেওয়ার পরপরই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, এমনকি মৃত্যুঝুঁকিও বেড়ে যায়।


আগামীনিউজ/ডলি/মামুন