ঢাকাঃ একজন সেলিব্রেটি বা সংবাদমাধ্যমগুলোর ফেসবুক পেইজের পোস্টগুলোর কমেন্ট চেক করে দেখেছেন কখনো? পোস্টগুলোতে প্রাসঙ্গিক এবং গঠনমূলক সমালোচনার বাইরে সিংহভাগ কমেন্টই থাকে ব্যক্তি আক্রমণমূলক।
অশালীন ভাষার ব্যবহার এবং ছবি এডিট করে অহরহ কমেন্ট করা হয় পোস্টগুলোতে। গেল কয়েক বছরে এই ধরনের বুলিংয়ের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই তাই প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশ কি তবে সাইবার বুলিংয়ে ভয়াবহ সময় পার করছে?
বুলিং কী?
বুলিং বলতে আমরা বুঝি দুইজন ব্যক্তির মধ্যে তর্ক বা কথা–কাটাকাটির জের ধরে একজন ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্টভাবে সবার সামনে দোষারোপ বা খারাপ ভাষায় আক্রমণ করা। আবার একজনের ছবি বা ভিডিও বিকৃতি করে অনলাইনে তুলে ধরাও বুলিংয়ের মধ্যে পড়ে। কেউ আপনাকে হেয় প্রতিপন্ন (এমনকি বডি শেমিং বা বর্ণবৈষম্যমূলক মন্তব্য করলেও) করলে সেটিও বুলিংয়ের আওতায় পড়ে।
সাইবার বুলিংয়ের ঘটনা সাধারণত বেশি ঘটতে দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটারের মতো প্লাটফর্মগুলোর পোস্টের কমেন্টে অহরহ দেখা যায় এই ঘটনা। এছাড়া মেসেন্জারে, ফোনের টেক্সটে, ই-মেইলে কিংবা অনলাইনে অ্যাপসেও দেখা যায় বুলিংয়ের ঘটনা।
সাইবার বুলিং কেন ভয়াবহ?
অনলাইনে হয়রানি বা সাইবার বুলিংয়ের কারণে অনেকেই হতাশায় ভোগেন৷ এদের একটি অংশ হতাশা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন৷ দুইটি উদাহরণ জানাতে চাই। জাপানের ২২ বছর বয়সি হানা কিমুরা একজন পেশাদার কুস্তিগীর ছিলেন৷ এছাড়া ভিডিও স্ট্রিমিং প্লাটফর্ম নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয় রিয়েলিটি টিভি শো ‘টেরাস হাউস’-এ অভিনয় করেছেন তিনি৷ গেল বছরের ২৩ মে আত্মহত্যা করেন কিমুরা৷ অনলাইনে টেরাস হাউসের দর্শকদের ক্রমাগত সমালোচনার প্রতিক্রিয়ায় আত্মহত্যা করার আগে বেশ কয়েকটি টুইট করেছিলেন তিনি৷ কিমুরার টুইটগুলোতে আত্মহত্যার আভাস ছিল।
দক্ষিণ কোরিয়ার ২৫ বছর বয়সি সল্লি একাধারে একজন অভিনেত্রী, গায়িকা ও মডেল ছিলেন৷ মেয়েদের বিখ্যাত কে-পপ ব্যান্ড ‘এফ (এক্স)’-এর সাবেক সদস্য ছিলেন তিনি৷ তবে তার আরেক পরিচয় তিনি ‘নো-ব্রা’ বা বক্ষ বন্ধনী না পড়ার আন্দোলনের একজন সমর্থক ছিলেন৷ এ কারণে তাকে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হতে হয়েছে৷ এসবের কারণে হতাশায় ভুগে ২০১৯ সালে আত্মহত্যা করেন তিনি৷ ২০১২ সালের ১৭ জুন সাইবার বুলিংয়ের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রথমবার সারাবিশ্বে Stop Cyberbullying Day উদযাপন করা হয়। এরপর থেকে প্রতি বছরের জুন মাসের তৃতীয় শুক্রবার দিবসটি উদযাপন করা হচ্ছে।
পরিসংখ্যান কি বলে?
পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৫১ শতাংশই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে থাকেন। জেনে অবাক হবেন, এর মধ্যে ৬০ শতাংশই নিয়মিত কোনো না কোনো ভাবে সাইবার বুলিং, আপত্তিকর মন্তব্য কিংবা হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন৷ ইউনিসেফের ২০১৯ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, দেশে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া ৩৮ শতাংশ ১০-১৩ বছর বয়সের, ৩৬ শতাংশ ১৪-১৫ বছর এবং ১৬-১৭ বছর বয়সী ২৫ শতাংশ। ঢাকায় অনলাইনে হয়রানির শিকার নারীদের ৭০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে৷
বাংলাদেশ সহ এশিয়ার কয়েকটি দেশের ওপর চালানো এক জরিপের বরাত দিয়ে ২০১৭ সালে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয় - এসব দেশে সাইবার বুলিং-এর ঝুঁকি উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে এবং নারী ও অপ্রাপ্তবয়ষ্ক কিশোরীরা সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছেন বুলিংয়ের। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ফেসবুকে যেসব নারী হয়রানির শিকার হয় তাদের মধ্যে মাত্র তিনভাগের একভাগ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করতে চায়। বাকিরা বিষয়টিতে পুলিশের কাছে কোন অভিযোগ করতে চায় না।
বুলিং বৃদ্ধির কারণ কি?
তথ্য-প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের অজ্ঞতার কারণে দিনকে দিন এ ধরণের অপরাধ বেড়েই চলছে বলে অভিমত সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও আহ্বায়ক কাজী মুস্তাফিজের। তিনি বলছেন, "সহজে হাতের কাছে ইন্টারনেট পাওয়ার কারণে ইন্টারনেটের অপব্যবহার বাড়ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাইবার হামলায় শিকার হন। সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের একমাত্র ওষুধ হলো সচেতনতা বাড়ানো। প্রযুক্তির সুবিধাগুলো ভোগ করার পাশাপাশি এর সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে প্রতিটি পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।"
প্রযুক্তির ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সঠিক মনিটরিংয়ের পাশাপাশি বাবা-মা ও অভিভাবকদের সচেতন ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. মেখলা সরকার। তিনি বলেন, "সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে এই ধরণের অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। সাইবার অপরাধের ব্যাপারে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো প্রয়োজন। এক্ষেত্রে পরিবারকেই এগিয়ে আসতে হবে।" নারীদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে তাদের সামাজিক দক্ষতা বাড়ানো গেলে এ ধরণের অপরাধ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে মত তার।
সাইবার বুলিং এর শাস্তিঃ
বাংলাদেশে ২০০৬ সালে প্রথম সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ আইন (আইসিটি অ্যাক্ট) প্রণয়ন করা হয়৷ এরপর ২০১৩ সালে এই আইন সংশোধন করা হয়। সে বছর ঢাকায় স্থাপন করা হয় দেশের একমাত্র সাইবার ট্রাইব্যুনাল। এই আইনে কারো অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও তোলা এবং তা প্রকাশ করার অপরাধে ১০ বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। তবে পোস্টে অশালীন বক্তব্য বা অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্যের জন্য দেশে এখনও কোনো আইন নেই।
এছাড়া, সাইবার হয়রানি থেকে সুরক্ষা দিতে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগে একটি সাইবার হেল্প ডেস্কও রয়েছে৷ এই হেল্পলাইন (০১৭৬৬৬৭৮৮৮৮) সপ্তাহের সাত দিন, ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। বাংলাদেশের যে কোন জায়গা থেকে যে কেউ হেল্পলাইনে সরাসরি ফোন করে অথবা এসএমএসের মাধ্যমে অভিযোগ জানাতে পারবেন। এছাড়া সাইবার হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে হটলাইন `৯৯৯` চালু করেছে সরকার।