বাবা-মাকে হারানোর ক্ষত প্রতি মুহূর্ত আহত করে: পরশ

নিজস্ব প্রতিবেদক আগস্ট ১৫, ২০২১, ১০:০৯ এএম
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকাঃ শেখ ফজলে শামস পরশ। যুবলীগের প্রতিষ্ঠা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনির বড় ছেলে পরশের জন্ম ঢাকায়, ১৯৭০ সালের ২ জুলাই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুসহ যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের মধ্যে পরশের বাবা শেখ মনি ও মাতা শেখ আরজু মনিকেই সর্বপ্রথম হত্যা করা হয়। তখন পরশের বয়স মাত্র ৫ বছর। বাবা-মাকে চিরতরে হারান তিনি। ছোট ভাই তাপস ৪ বছরের শিশু। বাবা-মা হত্যাকাণ্ডের পর দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হয়েছে দুই ভাইকে। কখনো আত্মীয়দের বাসায় লুকিয়ে থাকতে হয়েছে আবার কখনো পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। এভাবে দুই বছর কাটার পর শেখ আছিয়া বেগমের সঙ্গে ১৯৭৮ সালে তারা চলে যান ভারতে। চাচা শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ ফজলুর রহমান মারুফ, ফুফু শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা তখন বিদেশে শরণার্থী।

পরশ ধানমন্ডি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ইংরেজি সাহিত্যে দ্বিতীয়বার এমএ ডিগ্রি লাভ করেন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে। ২০১৭ সালে কানাডার ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে ‘Teaching English to Speakers of languages’ শীর্ষক সার্টিফিকেট অর্জন করেন।

দেশে ফিরে তিনি দীর্ঘদিন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে শিক্ষকতা করেছেন। বর্তমানে তিনি ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করছেন। তার লেখা আর্টিকেলস বিভিন্ন খ্যাতমান জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি তার গবেষণা পেপার্স বিভিন্ন একাডেমিক ইনস্টিটিউশনে উপস্থাপন করেছেন। শিক্ষতার পাশাপাশি সংস্কৃতিকেও ধারণ করেন পরশ। গান বাজনা তার অতি প্রিয়। ২০১৯ সালের ২৩ নভেম্বর সপ্তম জাতীয় কংগ্রেসে বাবার হাতে গড়া সংগঠন আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

শেখ ফজলে শামস পরশ বলেন, সেদিনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা এত স্বল্প পরিসরে ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলি, বাবা-মাকে হারানো অনেক বড় কষ্টের ব্যাপার। সেদিন খুব ভোরে প্রচণ্ড ভাঙচুরের আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙে। উঠে দেখি মা নেই পাশে। বিছানায় শুধু আমরা দুই ভাই। জানালা দিয়ে ঝড়ের মতো গোলাগুলি হচ্ছে। গুলিগুলো দেয়াল ফুটো করে মেঝেতে আছড়ে পড়ছে। সিঁড়িঘরে অনেক কান্নাকাটির আওয়াজ ও হৈ চৈ। আমরা দুই ভাই ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে সিঁড়িঘরের দিকে গিয়ে দেখি বাবা-মা রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়া। মার পা দুটো বাবার বুকের ওপর আড়াআড়ি রাখা। দাদির শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটিয়ে আছে, আর দাদি পাগলের মতো প্রলাপ বকছেন, দেয়ালে কপাল ঠুকছেন। এ অবস্থায় উনি আমার বড় চাচিকে বললেন, ‘ফাতু, আরজুর পা ২টি মনির বুকের ওপর থেকে সরাও।’ সেলিম কাকা আর চাচি বাবা-মার পাশে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে মাকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করছেন। আর বাবা পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছেন। মুখে কোনো কষ্টের চিহ্ন নেই। মনে হচ্ছে উনি যেন শান্তির নিদ্রায় বিভোর। শুধু গলায় কণ্ঠমনির নিচে চামড়া উঠে যাওয়ার একটা চিহ্ন। বাবার শরীরের অন্য কোথাও কোনো ক্ষত আমার মনে নেই।

আমরা দুই ভাই কান্নাকাটি করছিলাম। মনে হয়, আমরা ভয়েই কাঁদছিলাম, কারণ মৃত্যু কাকে বলে তখনো আমরা জানি না। মৃত্যুর পর যে মানুষকে আর পাওয়া যায় না, সেটাও আমার জানা ছিল না। মৃত্যুর সঙ্গে ওই আমার প্রথম পরিচয়। একসঙ্গে অনেকগুলো মৃত্যু। মার মনে হয় অনেক কষ্ট হচ্ছিল আমাদের ফেলে যেতে। মা পানি খেতে চাচ্ছিলেন এবং বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিলেন। বাইরে তখনো গুলির আওয়াজ থামে নাই। ভয়ানক গোলাগুলির আওয়াজ আর তার সঙ্গে জানালা ভাঙচুরের আওয়াজ। মা চাচিকে বললেন, ‘ফাতু আমাকে বাঁচাও। আমার পরশ-তাপস! ওদের তুমি দেইখো।’ ওটাই বোধহয় মার শেষ কথা।

এরপর কী হলো জানি না। গুলির আওয়াজ বেড়ে যাচ্ছিল। কারা যেন এদিকে আবার আসছিল। চাচি তখন আমাদের নিয়ে তার ড্রেসিংরুমে পালালেন। আমাদের মেঝেতে শুইয়ে রেখেছিলেন যাতে গুলি না লাগে। গুলি মনে হয় বাথরুমের জানালা দিয়ে ড্রেসিংরুমেও ঢুকে যাচ্ছিল। এরপর বাবা-মার সঙ্গে আমাদের আর দেখা হয়নি। তিনি বলেন, বাবা-মায়ের মতো ভালোবাসা আর মায়া-মমতার জায়গা সত্যিই দুনিয়াতে আর হয় না। আমাদের জন্য এটা একটা বড় ক্ষত, অনেক বড় ক্ষতি। আমাকে আর আমার ছোট ভাইকে অবশ্যই ক্ষত করে, আহত করে প্রতি মুহূর্তে। বাবা-মাকে মিস করা খুবই স্বাভাবিক। তবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার বাবা যে চলে গেছেন। আমার বাবা বঙ্গবন্ধুর সৈনিক ছিলেন, তার সঙ্গেই রাজনীতি করতেন। তার বিশাল বড় এক অনুরাগী ছিলেন। তাকে ভালোবাসতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ধারণ করতেন সারাজীবন। এই ব্যাপারটা আমাকে গর্ব অনুভব করায়। আমি গর্বিত যে, আমার বাবা জাতির পিতার সঙ্গে প্রাণ দিয়েছেন। এটা আরেকটা ভালো লাগার জায়গা।

হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রেক্ষাপট একটাই। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধের পরাজিত শক্তিই ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। কারা সেই ষড়যন্ত্রকারী, সেটা এ দেশের মানুষ অনুমান করতে পারে। যারা স্বাধীনতাবিরোধী, যারা বাঙালির বিজয় চায়নি, তারাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। হত্যার ষড়যন্ত্রও করেছে। আত্মস্বীকৃত খুনি ফারুক, রশীদ স্বেচ্ছায় বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সাবেক সেনাশাসক জিয়াউর রহমানকে নেপথ্যের শক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছে। পরবর্তী সময় ধারাবাহিকভাবে খুনিদের পুরস্কৃত করা থেকে শুরু করে অন্যান্য কাজের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান যে ১৫ আগস্টের খুনের সঙ্গে জড়িত- এ ব্যাপারে তিনি নিজেই প্রমাণ রেখে গেছেন। সুতরাং আমি বলবো একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তির চর বা দোষর ছিল জিয়াউর রহমান। তারাই এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।

হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ঘাতকচক্র কী অর্জন করতে চেয়েছিল? জবাবে বাবা-মা হারানো পরশ বলেন, ঘাতক চক্র একটা বিষয়ই অর্জন করতে চেয়েছিল। তারা কখনোই চায়নি, বাংলাদেশ একটা সফল রাষ্ট্র হোক, এ দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হোক। এ দেশের মানুষ যে সুখে-শান্তিতে উন্নয়নশীল ও মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে স্বীকৃতি পাবে, সেটা আমাদের শত্রুরা কখনোই চায়নি। তারা সব সময় চেয়েছিল- বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম যেন ব্যর্থ হয়। এটা তাদের একটা প্রতিশোধ ছিল। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের একটা বড় প্রতিশোধ। ৭৫-এ আমাদের পরিবার ও বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে তারা এই দেশকে একটা ব্যর্থ রাষ্ট্র বানানোর নীল নকশা করেছিল। সেই নকশা অনুযায়ীই এগিয়ে যাচ্ছিল।

বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত সেই পরিকল্পনা ও কাজটাই তারা করেছে। এই দেশকে তারা একটা মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে, একটা জঙ্গি দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পরিকল্পনা চলছিল। আমাদের আশপাশে বা পাকিস্তান টাইপের একটা দেশ বানানোর চেষ্টা হয়েছিল। এটা একটা প্রতিশোধ পরায়ণতা বলে আমি মনে করি।