প্রণব মুখার্জি

শিক্ষক থেকে রাষ্ট্রপতি

নিজস্ব প্রতিবেদক সেপ্টেম্বর ২, ২০২০, ১২:৪৮ পিএম
ছবি সংগৃহীত

ঢাকাঃ পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবন। নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন। তারপরও তিনি সবসময়ই ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতেই। ইতিহাস, রাজনীতি বিজ্ঞান ও আইনে মাস্টার্স শেষ করেন। পরবর্তীতে কলেজে  শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। আবার সাংবাদিকতাও করেছেন। প্রধানমন্ত্রী হতে না পারলেও নিজেকে তুলে এনেছিলেন রাজনীতির শীর্ষে। হয়েছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি। তিনি হলেন ভারতের প্রথম বাঙ্গালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। এই বাঙ্গালি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব দীর্ঘ জীবন শেষে সোমবার ৩১ আগষ্ট শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

প্রণব মুখার্জির জন্ম ১৯৩৫ সালের ১১ই ডিসেম্বর। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার এক সাধারণ পরিবারে। তার বাবা ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন তিনি।

পরে পাঁচ দশকের রাজনীতির পথ পাড়ি দিয়ে ২০১২ সালে ভারতের ১৩তম রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী পদের জন্যও আলোচনায় এসেছিলেন, তবে হতে পারেননি। মেয়াদ শেষে অবসরের পর আর সক্রিয় রাজনীতিতে জড়াননি তিনি।

বাবার পথ ধরে শুরুতে প্রাচীন রাজনৈতিক দল কংগ্রেসে যোগ দেয়ার চেষ্টা করলেও স্থানীয় নেতারা তাকে সে সুযোগ দেননি। পরে কংগ্রেস থেকেই বেরিয়ে আসা অজয় মুখার্জীর বাংলা কংগ্রেসে যোগ দেন। কিন্তু তার মেধা আর জ্ঞানে আকৃষ্ট হয়ে মুখার্জী তাকে রাজ্যসভার সদস্য করে পাঠান ১৯৬৯ সালে।

তার ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক ভারতের এক্সপ্রেস গ্রুপের সিনিয়র এডিটর জয়ন্ত রায় চৌধুরী বলেন, প্রায় পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবনে নানা উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে গেলেও তিনি সবসময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতেই ছিলেন। 
যখন খুব অসুবিধায় পড়েছেন, যেমন কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে নিজে দল করার চেষ্টা করলেন, তারপর আবারও ফিরলেন। সেই খারাপ সময় কাটাতে পেরেছেন কারণ তার চেনাজানা। এতোটা গুরুত্ব ছিলো তার সেজন্য কেউ তাকে আলাদা করতে পারেনি। বেশিদিন কেউ তাকে চেপে ধরে নামিয়ে রাখতে পারেনি।

তবে সেই কংগ্রেস থেকেও তাকে বেরিয়ে ভিন্ন দল করতে হয়েছিলো গান্ধী পরিবারের সাথে বিরোধের জের ধরেই। যদিও পরে আবারো ফিরে আসেন তিনি কংগ্রেসে। পাঁচবার রাজ্যসভায় গিয়েছেন আর লোকসভায় নেতৃত্ব দিয়েছেন ২০০৪ সাল থেকে ২০১২ সালে, যা তাকে পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়।

জয়ন্ত বলেন, বৈশ্বিক রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞান, মেধা, প্রজ্ঞা আর কৌশলের কারণে প্রণব মুখার্জি পরিণত হয়েছিলেন একজন বড় মাপের শিক্ষকে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি কীভাবে পাল্টাচ্ছে, ভারত বা এশিয়ার জন্য তার তাৎপর্য প্রভাব কেমন হবে- এগুলো নিয়ে তার বিরাট দক্ষতা, এটা ছিলো তার বিরাট গুণ। উনি বিরাট একজন শিক্ষক। উনাকে না জিজ্ঞেস করে ইন্দিরা গান্ধী বা মনমোহন সিং কিছু করতেন না। এমনকি নরেন্দ্র মোদীও তার কাছে পরামর্শ নিয়েছেন। সুতরাং উনি বড় রাজনীতিক সেটা সবাই জানে। কিন্তু তিনি যে বড় মাপের শিক্ষক সেটা সবার জানা নেই।

তার দীর্ঘকালের ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক গৌতম লাহিড়ী বলেন, মূলত রাজনীতিক প্রণব মুখার্জি আলো ছড়াতে শুরু করেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারতীয় পার্লামেন্টে তার তৎপরতার মাধ্যমেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধই বড় কারণ প্রণব বাবুর জাতীয় রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশে। 

ইন্দিরা গান্ধী তার মেধায় আকৃষ্ট হয়ে তাকে কংগ্রেসে নেন ও বড় বড় নেতাদের রেখে তাকেই নম্বর টু হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এক সময় তাকে ইন্দিরা গান্ধীর মানসপুত্র বলা হতো। অতি অল্প বয়সে ১৯৮২ সালে তাকে অর্থমন্ত্রী করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।

নিজের বর্ণাঢ্য অভিজ্ঞতার আলোকে বই লিখেছেন অন্তত আটটি। সর্বশেষ ২০১৭ সালে প্রকাশিত বইয়ে বাংলাদেশে ২০০৮ সালের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার পেছনের ভূমিকাও উঠে এসেছিলো।

তবে ভারতে কংগ্রেসের বাইরেও উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তার গ্রহণযোগ্যতা তাকে রাজনীতিতে বিশেষ মর্যাদায় তুলে এনেছিলো বলে মনে করেন লাহিড়ী। তিনি বলেন, প্রণব মুখার্জী রাষ্ট্রপতি হওয়া পর্যন্ত জীবন উত্থানপতন ও টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গেছে। কংগ্রেস যখন ২০০৪ সালে ক্ষমতায় আসে ওই সময় থেকে প্রণব ছিলেন রাজনৈতিক পরিপক্বতার তুঙ্গে। পরে তিনি অর্থমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। তিনি সবাইকে নিয়ে রাজনীতির চেষ্টা করেছিলেন বলে তাকে রাজনীতির ‘চাণক্য’ নামে অভিহিত করা হয়।

লাহিড়ী আরও বলেন, যেকোনো সংকটময় মুহূর্ত থেকে উত্তরণে তার তৎপরতায় বারবার ঋদ্ধ হয়েছে ভারতের রাজনীতি। কূটনৈতিক দক্ষতা দিয়েই তিনি ভারতের রাজনীতিতে বিরোধী দলগুলো এমনকি বিজেপি নেতাদেরও শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন।

মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রণব মুখার্জি হচ্ছেন একমাত্র ভারতীয় বাঙালি যিনি সর্বভারতীয় রাজনীতিতে ছাপ রেখেছেন, রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। তার শ্বশুরবাড়ি বাংলাদেশে। সে কারণে একটা টান তার থাকতে পারে। আর মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই তিনি নানাভাবে সম্পৃক্ত। আবার শেখ হাসিনা নির্বাসনে থাকার সময় একটা পারিবারিক সম্পর্কও তৈরি হয়েছিল। আবার দীর্ঘকাল গুরুত্বপূর্ণ দুটি মন্ত্রণালয়- অর্থ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চালিয়েছেন। সে কারণে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতীয় নীতিতেও তার ভূমিকা ছিলো।

লাহিড়ী ও জয়ন্ত রায় চৌধুরী দুজনেই বলেন, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সমর্থন ও স্বীকৃতির জন্য অনবদ্য অবদান রাখা মুখার্জীর অসীম মমতা ছিলো বাংলাদেশের প্রতি।

প্রণব মুখার্জি নিজেই তার বইয়ে বাংলাদেশে ওয়ান ইলেভেনের সরকারের সময়ে তার ভূমিকার কথা লিখেছেন যা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলো ২০১৭ সালে বইটি প্রকাশের পর।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই মুখার্জিকে তার একজন পারিবারিক অভিভাবক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। দুই পুত্র ও এক কন্যার জনক প্রণব মুখার্জির স্ত্রী প্রয়াত শুভ্রা মুখার্জি ছিলেন বাংলাদেশের নড়াইলের মেয়ে। ১৯৯৬ সালে প্রণব মুখার্জি তার কন্যা শর্মিষ্ঠা মুখার্জিকে নিয়ে শেষবারের মতো এই গ্রামে বেড়াতে এসেছিলেন। 

আগামীনিউজ/জেহিন