জীবিকা বনাম করোনা

নিজস্ব প্রতিবেদক আগস্ট ২৯, ২০২০, ০৫:০২ পিএম
ফাইল ছবি

ঢাকাঃ  করোনা ভাইরাস বাংলাদেশে হানা দেয়ার সাড়ে পাঁচ মাস ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো কোনোভাবেই কমছে না করোনার প্রকোপ। প্রতিদিনই হু হু করে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। তবে ‘জীবিকার’ তাগিতে করোনাকে এখন আর পাত্তাই দিচ্ছে না কেউ। ভয়কে দূরে ঠেলে দিয়ে জীবিকার টানে ঘরবন্দি মানুষেরা বের হয়ে এসেছে বাইরে।

সেই সঙ্গে কমে গেছে সচেতনতাও। পথে, হাটে, ঘাটে কোথাও মানা হচ্ছে না সামাজিক দূরত্ব আর স্বাস্থ্যবিধি। জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ও সরকারি তৎপরতাও নেই আগের মাতো। করোনার সংক্রমণ আছে এবং থাকবে- এটা মেনে নিয়েই শুরু হয়েছে জীবনের সব আয়োজন।

এদিকে করোনায় শনাক্তের হার ও মৃত্যু না কমায় উদ্বেগ বাড়ছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। বাংলাদেশে করোনাকে মোকাবিলা করতে শুধু প্রথম থেকেই সরকার লকডাউন, রেডজোনে লকডাউন, চিকিৎসা, করোনা পরীক্ষা, ঈদে জনগণকে কর্মস্থলে রাখা, করোনায় আক্রান্তদের ঘরে রাখাসহ নানা উদ্যোগ নিলেও কোনোটাই ঠিকমতো বাস্তবায়ন হয়নি। এমনকি করোনা পরিস্থিতি আসলে কোন পর্যায়ে আছে? এমনটিও নিশ্চিত করতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।

সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীসহ দেশের মানুষের জীবনযাত্রার চেহারা দেখলে কোনোভাবেই বোঝার উপায় নাই যে এখন বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ উর্ধ্বগতির দিকে আছে।

শুধুমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া দেশের হাটবাজার, অফিস আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, দোকান পাট, রাস্তাঘাট, লঞ্চ-স্টিমার, ট্রেনে মানুষের সমাগম ফিরেছে আগের চেহারায়। পাড়া-মহল্লায় চায়ের দোকানগুলোয় মধ্যরাত পর্যন্ত চলে আড্ডা। আগের মতোই স্টেশনগুলোর চায়ের দোকান, হোটেল চলে সারা রাত।

গত কয়েকদিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, করোনার কারণে স্থবির হয়ে যাওয়া রাজধানীতে চেহারা পুরোটাই ফিরেছে আগের জায়গায়। শুরু হয়েছে রাজধানীর ফুটপাথ জুড়ে হকারদের রমরমা ব্যবসা। রাজপথে এখন নিয়মিত যানজট। আগের মতোই সকাল থেকে বাসস্ট্যান্ডে শুরু হয় অফিসগামী মানুষের দীর্ঘ লাইন, ভিড় এবং চিরচেনা গাড়িতে ওঠার ঠেলাঠেলি। বাস, লঞ্চ, স্টিমারসহ গণপরিবহন চালানোর ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব মানার শর্ত থাকলেও এখন আর তা মানা হচ্ছে না। ৬০ শতাংশ বাড়তি ভাড়া আদায় ছাড়া গণপরিবহনে এখন আর সামাজিক দূরত্ব বলে কিছু নেই। বাসে প্রতি দুই সিটে একজন যাত্রী পরিবহনের বিধান করে দেয়া হলেও এখন প্রতি দুই সিটে দুই জনসহ দাঁড়িয়েও যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যাত্রীরা অসহায়। মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধির কোনো শর্তই। বাসে, লঞ্চে কোনো গণপরিবহনেই রাখা হয় না হ্যান্ড সেনিটাইজার।

রাজধানীর মহল্লায় দোকানপাট বা কাঁচাবাজারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দোকান পাটগুলো এখন পুরোপুরি খুলেছে। রাত ১০টার মধ্যে এখন রাজধানীর কোনো মহল্লায়ই এখন আর অন্ধকার নেমে আসে না। রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলোয় ভিড় বাড়তে শুরু করেছে অনেক আগে থেকেই। কাঁচাবাজারের মাছ বা সবজির অনেক দোকান এবং স্টল পুরোটাই পূর্ণ হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার একাধিক জনের সঙ্গে কথা বললে সবাই এক সুরে বলেন, করোনা সবকিছু উল্টোপাল্টা করে দিয়েছে। দীর্ঘদিন বেকার কিংবা বসে থাকার ফলে সব সঞ্চয় ভেঙে খেয়ে ফেলেছি। এখন রাস্তায় নামা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। জীবিকাকে টিকিয়ে রাখতে জীবন বাজি রাখা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

অন্যদিকে বাংলাদেশের করোনার প্রকোপ দেখা দেয়ার সাড়ে পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও সংক্রমণের গতি না কমায় বাড়ছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনা পরীক্ষা পর্যাপ্ত হচ্ছে না এখনো। শনাক্তের বাইরে থেকে যাচ্ছে বহু মানুষ। পরীক্ষার ফলাফল কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল- তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। জুনের শুরু থেকে প্রায় তিন মাস ধরে শনাক্ত ও মৃত্যুর তথ্যরেখা নিচে নামানো যাচ্ছে না। কখনো শনাক্ত কিছুটা কমে। তখন বলা হয় সংক্রমণ কমেছে। আবার দুই-এক দিন পরেই যখন ঘুরেফিরে তা আগের সংখ্যায় উঠে যায় তখন সংক্রমণ বেড়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ জানান।

চলতি সপ্তাহে সংক্রমণ কমেছে বলে যখনই তথ্য আসছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে, তখন বিশেষজ্ঞরা মৃত্যুর তথ্য কী এসেছে সেটা দেখতে বলছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যেই দেখা যায়, তিন মাস ধরেই প্রতি মাসে মৃত্যু হাজারের ওপরে থাকছে। এমনকি এর মধ্যে গত মাসে ছিল সর্বোচ্চ এক হাজার ২১৪ জন, জুন মাসে ওই সংখ্যা ছিল এক হাজার ১৯৭ জন। অন্যদিকে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত চলতি মাসে মৃত্যু হয়েছে ১ হাজার ৬৩ জনের। শুধু তাই নয়, চলতি মাসের গত তিন সপ্তাহের মধ্যে শেষ সপ্তাহে মৃত্যুর সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। আবার যদি গত ২৬ জুলাই থেকে এক মাসের হিসাবের তুলনা করা হয়, সেখানেও দেখা যাচ্ছে মাত্র পাঁচ দিন মৃত্যুর সংখ্যা ছিল দৈনিক ২১-৩০ জনের মধ্যে। বাকি পুরো সময়টা মৃত্যু ওঠানামা করেছে ৩০ থেকে ৫৪ জনের মধ্যে।

এ প্রসঙ্গে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘সংক্রমণ নিয়ে এক ধরনের সংশয় থাকতে পারে, কিন্তু মৃত্যু যে কমছে না সেটাই আমাদের কাছে বড় চিন্তার ব্যাপার। বরং মাঝে কিছুদিন পরীক্ষা কম হওয়ায় শনাক্ত যেহেতু কম ছিল, তাই মনে হচ্ছিল সংক্রমণ কমেছে। কিন্তু সেটা তো একটানা কমছে না। আবার তো বেড়ে যাচ্ছে। তাই মৃত্যুর কী অবস্থা সেটা ধরে সবার সতর্ক থাকতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। কার্যকর ব্যবস্থা বলবৎ রাখতে হবে।

আগামীনিউজ/জেহিন