ঢাকা: সারা বিশ্ব যখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, তখন জীবাণু ও ভাইরাস থেকে বাঁচতে হ্যান্ডস্যানিটাইজারের ব্যবহার বেড়েছে কয়েকগুণ। চিকিৎসকরা বলছেন, বেশির ভাগ সময়ই হাতের মাধ্যমে করোনাভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। আর তাই নিজেদের দু’হাত জীবাণুমুক্ত রাখতে হ্যান্ডস্যানিটাইজার ব্যবহার করছে মানুষজন। আর এই সুযোগে দেশের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী তৈরি করছে নকল হ্যান্ডস্যানিটাইজার। এসব হ্যান্ডস্যানিটাইজারে ভাইরাস বা ব্যকটেরিয়ার ক্ষতি সাধন করতে না পারায় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে মানুষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইথানল (ইথানল বা এলকোহল) এর সাথে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, গ্লিসারিন ও ঠাণ্ডা ফোটানো পানি অথবা আইসোপ্রোপাইল এ্যালকোহল (প্রোপানল) এর সাথে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ও গ্লিসারিনসহ বিভিন্ন উপাদান নির্দিষ্ট পরিমাণে মিশালে তৈরি হয় হ্যান্ডস্যানিটাইজার। নির্দিষ্ট পরিমাণের বাহিরে কেউ যদি কোন একটি উপাদান কম বেশি মেশায় বা কোন উপাদান বাদ দেওয়া হয়, তাহলে সেই হ্যান্ডস্যানিটাইজার জীবাণুমুক্ত না করে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মিথানল ও হেগজেন দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে হ্যান্ডস্যানিটাইজার। এ দুটি বিষাক্ত কেমিক্যাল যা খেলে মানুষ মারা ও যেতে পারে। এসব কেমিক্যালের দুর্গন্ধ বা ব্যবহারের পরে যে বাষ্প নির্গত হয় তা নাকের মাধ্যমে আমাদের দেহে প্রবেশ করে শরীরে নানা ধরণের বিরুপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে। যেহেতু এদুটি কেমিক্যাল আমাদের মানবদেহের সঙ্গে পরিচিত নয়, তাই এগুলো ফুসফুসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কাশি, ফুসফুস ব্যাথা, গলাব্যাথা এবং জ্বরজ্বর ভাব দেখা দিচ্ছে। ক্ষেত্র বিশেষে শ্বাসকষ্টও হতে পারে। বিষাক্ত হ্যান্ডস্যানিটাইজার ব্যবহারের মানুষের নিয়মিত খাদ্যগ্রহণেও অনিহা আসতে পারে। যেহেতু জ্বর, গলাব্যাথা, শ্বাসকষ্ট করোনা সংক্রমণের লক্ষণ হওয়ায় মানুষ করোনা ভেবে মানসিক ভাবে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে।
বিশেষ করে ব্যাংক, বিভিন্ন লঞ্চ ও বাস টারমিনালে বিষাক্ত মিথানল ও হেগজেন দিয়ে তৈরি হ্যান্ডস্যানিটাইজার ব্যবহারে পুরো এলাকাই গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়ে পড়ছে। ফলে সুস্থ্য মানুষও অসুস্থ্য হয়ে পড়ছে।বেশ কিছু দিন আগেই ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা্ এ বিষয়টি তাদের সরকারকে অবহিত করেছে। যা ভবিষ্যতে ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ফার্মাসি ডিপার্টমেন্টের এডভাইজার প্রফেসর ড. এস এম আব্দুর রহমান আগামীনিউজ ডটকম কে বলেন, হ্যান্ডস্যানিটাইজারে অ্যালকোহলের মাত্রা সঠিক পরিমাণ না থাকলে তা জীনবাণুনাশক হবে না। এতে করে করোনাভাইরাসও ছড়াতে পারে। কেননা একজন ধারণা করছে সেতো স্যানিটাইজার ব্যবহার করেছে তার মানে সে জীবাণুমুক্ত। কিন্তু তার স্যানিটাইজারে সঠিক পরিমাণে অ্যালকোহল না থাকায় তা তাকে সুরক্ষা দিতে পারে নি। অন্যদিকে কেউ যদি ভেজাল দেয়, মিথানল দেয় এটা শরীরের ভিতরে প্রবেশ করলে শরীরের বিভিন্ন ক্ষতি হতে পারে। অন্য কোন দ্রব্য, কালার বা অন্যান্য মেটিরিয়াল দিলে হাতে জ্বালা পোড়া করা বা ত্বকের ক্ষতি হতে পারে। এই জিনিসগুলো কখনোই শরীরের জন্য সহায়ক না। কি ধরনের ম্যাটিরিয়াল ব্যবহার হচ্ছে সেটার উপর নির্ভর করবে শরীরের কি ক্ষতি হবে। বদ্ধ পরিবেশে স্যানিটাইজার বেশি ব্যবহার করা হলে ক্ষতি হতে পারে। নকল স্যানিটাইজার ব্যবহারে শ্বাস কষ্টও হতে পারে বলে জানান তিনি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ডা. রাশেদ মোহাম্মদ খান আগামীনিউজকে বলেন, নকল স্যানিটাইজারে এক্সিমা বা প্রদাপক, ত্বক শুস্ক, লাল হয়ে পারে। এছাড়া ত্বকের ইনফেকশনও হতে পারে। ব্যাকটিরিয়াল ইনফেকশন হতে পারে।
ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ জাবেদ জামাল আগামীনিউজকে বলেন, আগে জানতে হবে হ্যান্ডস্যানিটাইজার কাদের জন্য বেশি প্রয়োজন। সাধারণ মানুষের জন্য হ্যান্ডস্যানিটাইজারের থেকে সাবানটাই বেশি কার্যকর বলে আমি মনে করি। আমাদের দেশে একটা প্রবণতা আছে যখন যেটা শুরু হয় সেটার দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মানুষ।
স্যানিটাইজারের মূল উপাদান হলো আইসোপ্রোফাইল অ্যালকোহল। এটা যখন আপনি নির্দিষ্ট মাত্রায় ব্যবহার করবেন সেটা করোনাভাইরাসকে ডিজ ইনফেক্ট করতে পারে। আর হ্যান্ডস্যানিটাইজার কিন্তু করোনাভাইরাসকে মেরে ফেলতে পারে না। এটা হাত পরিস্কার করে জীবাণুমুক্ত রাখে। বর্তমানে আমাদের দেশের বাজারে আইসোপ্রোফাইল অ্যালকোহলের ঘাটতি রয়েছে। তাহলে বাজারে এতো এতো স্যানিটাইজার কিভাবে আসছে। তার মানে বেশিরভাগই ভেজাল।
আইসোপ্রোফাইল অ্যালকোহল আমাদের দেশে আগে ছিল ১৬০০ টাকা লিটার, এখন তিন হাজার টাকার বেশি। এতো দাম দিয়েতো জিঞ্জিরা, কেরানীগঞ্জ বা টঙ্গীর সাধারণ কারখানাগুলোতো আর অর্জিনাল কিছু ব্যবহার করে না। তাই তারা মিথানল ব্যবহার করে। এটা হলো প্রাকৃতিক গ্যাস। এছাড়া কালার করা জন্য বিভিন্ন রং ব্যবহার করে, টয়লেট ক্লিনার ব্যবহার করে। টয়লেট ক্লিনার বেশি ব্যবহার করলে হাতের চামড়া উঠে যাবে। মিথানল বেশি ব্যবহার করলে স্কিন ক্যান্সার হতে পারে।
মূল কথা হচ্ছে বেশিরভাগ হ্যান্ডস্যানিটাইজারই জিনিস পত্রের পরিমাণ ঠিক রাখছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু (WHO) এর মতে হ্যান্ডস্যনিটাইজারে মিনিমাম ৭২ শতাংশ আইসোপ্রোফাইল অ্যালকোহল দিতে হবে। এর কম দিলে হবে না। কিন্তু আমাদের দেশে যে পরিমান হ্যান্ডস্যানিটাইজার আছে সেই পরিমাণ আইসোপ্রোফাইল অ্যালকোহল নেই। আসলে এ হ্যান্ডস্যানেটাইজার নিয়ে আমরা অনেক ভুল তথ্য জানি। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের অনেক পড়াশুনা দরকার। পাশাপাশি আমাদের দেশের অবৈধ ক্যামিকেল ব্যবসা বন্ধ করতে হবে বলেও মত দেন তিনি।
এদিকে, নকল হ্যান্ডস্যানিটাইজার ও জীবাণুনাশক বিক্রির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত শুক্রবার (১৯ জুন) রাজধানীর কোতোয়ালী থানার বাবুবাজার ও মিটফোর্ড এলাকায় অভিযান চালিয়ে নকল ও ভেজাল এক হাজার ৯০০ লিটার স্যাভলন এবং ৫০০ লিটার হেক্সিসল উদ্ধার করে পুলিশ। এসময় সাত জনকে গ্রেফতার করা হয়।
গত ১০ জুন নকল ও অনুমোদনহীন স্যানিটাইজার বিক্রিয়ের জন্য রাজধানীর নিউ মার্কেটের চারটি দোকানকে আড়াই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছ। এছাড়া প্রায় পাঁচ লাখ টাকার নকল স্যানিটাইজার জব্দ করেছে র্যাব।
ওই দিন বিকেলে র্যাব-৪ এর একটি আভিযানিক দল নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আনিসুর রহমান এবং সহকারী পুলিশ সুপার রিফাত বাশার তালুকদার এর নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে এ জরিমানা করা হয় বলে জানান র্যাব-৪ এর সিনিয়র সহ: পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম সজল।
এ ব্যাপারে র্যাবের লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উংয়ের পরিচালক সারোয়ার বিন কাশেম আগামী নিউজকে বলেন, নকল হ্যান্ডস্যানিটাইজার ও জীবানুনাশকের বিরুদ্ধে র্যাবের অভিযান অব্যাহ আছে। যারা এইসব অবৈধ কাজে জড়িত আমি আগামী নিউজের মাধ্যমে তাদের সবাইকে বলতে চাই, আপনারা কেউ পার পাবেন না। সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
আগামীনিউজ/আরিফুর/জেএস