ঢাকা: রোহিঙ্গাদের মানবিক সঙ্কট মোকাবেলায় জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং সহযোগী এনজিওসমূহ ২০২০ সালের জন্য জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান (জেআরপি) ঘোষণা করেছে।
বিগত বছরগুলোর প্রচেষ্টা এবং সফলতার ভিত্তিতে এ বছর ৮৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তহবিল গঠনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে মিয়ানমার থেকে আগত প্রায় ৮,৫৫,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এবং তাদের উদারভাবে আশ্রয় প্রদানকারী প্রায় ৪,৪৪,০০০ এরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় বাংলাদেশি জনগণের চাহিদা পূরণ করা হবে।
মঙ্গলবার (৩ মার্চ) জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানিয়েছে।
সামগ্রিকভাবে মোট আপিলের প্রায় ৫৫ শতাংশই প্রয়োজন হবে খাদ্য, আশ্রয়ণ, নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশনসহ প্রয়োজনীয় জরুরি সেবা প্রদানের জন্য। শুধু খাদ্যনিরাপত্তার জন্য মোট তহবিলের প্রায় ২৯ শতাংশ ব্যয় হবে। এছাড়াও স্থানীয় বাংলাদেশিদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য, সুরক্ষা, শিক্ষা, ক্যাম্প ব্যবস্থাপনা, জ্বালানি এবং পরিবেশ সংক্রান্ত কার্যক্রমগুলো অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার এবং এ দেশের জনগণ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বাগত জানাতে ব্যাপক সহমর্মিতা দেখিয়েছেন। উভয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান রক্ষা ও চলমান সংকটে স্থানীয় অর্থনীতির শক্তিশালীকরণ জরুরি।
২০১৭-তে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে আসার পর বাংলাদেশে অবস্থানরত বেশিরভাগ রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য এটি নির্বাসনের তৃতীয় বছর। রোহিঙ্গারা স্পষ্টভাবেই জানিয়েছেন তারা নিজ দেশে ফেরত যেতে চান, তবে তা নির্ভর করছে তাদের এবং তাদের পরিবারের নিরাপত্তা, মৌলিক অধিকার লাভের সুযোগ এবং মিয়ানমারে নাগরিকত্ব প্রাপ্তির নিশ্চয়তার ওপর।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর হাইকমিশনার ফিলিপো গ্র্যাণ্ডি বলেন, ‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০২০ সালের এই জেআরপি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাদের বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান এবং ভবিষ্যতে নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসন উভয়ের জন্য।’
প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু না হওয়া পর্যন্ত, রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং স্থানীয় বাংলাদেশিদের চাহিদা মেটাতে ও জীবনমান উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকার এবং মানবিক সহায়তা প্রদানকারী সংস্থাসমূহ একত্রে কাজ করে যাচ্ছে। ২০২০ এর জেআরপি-তে সেই ইস্যুগুলোকে অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে যেসব কারণে স্থানীয় জনগোষ্ঠী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আইওএম-এর মহাপরিচালক আন্তোনিও ভিতোরিনো বলেন, ‘২০১৭ সালের আগস্টে যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সংকট মোকাবেলায় কাজ শুরু করে, তখন থেকে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছি শরণার্থীদের মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যে সরকারের সাথে কাজ করার জন্য এবং স্থানীয় জনগণের জন্য অর্থপূর্ণ সহায়তা প্রদানের জন্য। ২০২০ সালের জেআরপির কেন্দ্রে থাকবে অবকাঠামো, জীবিকা, সুরক্ষা ও পরিবেশ, আর এটি আমাদের আগের কাজেরই চলমান প্রয়াস।’
২০১৭ সালে বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর আগমনের পর থেকেই, মানবিক সহায়তা প্রদানকারী সংস্থাগুলো জীবন রক্ষাকারী সহায়তা ও সুরক্ষা প্রদানের পাশাপাশি বাংলাদেশের দীর্ঘ বর্ষা ও ঘুর্ণিঝড় মৌসুমের ঝুঁকি কমিয়ে আনতে কাজ করছে। ২০১৯ সালের একটি বড় অর্জন হচ্ছে, ক্যাম্পগুলোতে বসবাসরত সকল রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসা।
পরিবেশের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার রোহিঙ্গা শিবিরে শরণার্থীদের জীবনমানে বাস্তবিক উন্নয়ন ঘটিয়েছে। সকল রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিবার রান্নার জন্য বর্তমানে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ব্যবহার করছে, এর ফলে পুন:বনায়ন কার্যক্রম ও বনায়ন সংরক্ষনের পাশাপশি এলপিজি ব্যবহারের ফলে কক্সবাজার জেলার যেসব অঞ্চলে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাস করছে সেখানে পুন:সবুজায়ন হয়েছে।
এ বছর জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সরকারের একটি সিদ্ধান্ত অনুমতি দেয় রোহিঙ্গা শিশুদের মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণের। জেআরপি-২০২০ এর মাধ্যমে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুদের শিক্ষা প্রদান করতে পারবে। শিগগিরই ৬ষ্ঠ থকে ৯ম শ্রেণির ১০,০০০ শিশুকে নিয়ে একটি পাইলট কার্যক্রম শুরু হবে, যার ভবিষ্যৎ বর্ধিতকরণ নিয়ে বর্তমানে কাজ চলছে।
গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের অর্জন ও শিক্ষাগুলোকে জেআরপি-২০২০ এর মাধ্যমে সরকার এবং মানবিক সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলো আরো কার্যকর করে তুলবে। গত বছর বর্ষা মৌসুমে তিন হাজারেরও বেশি প্রশিক্ষিত রোহিঙ্গা শরণার্থীকে দুর্যোগ মোকাবেলার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামসহ প্রস্তুত করা হয়েছে।
বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী আগমনের প্রথম দিন থেকেই মানবিক কার্যক্রমের অগ্রগতি ও অর্জনসমূহ লক্ষণীয়। তবে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যতদিন না স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদা সহকারে তাদের নিজ দেশে ফেরত যেতে পারছেন, ততদিন পর্যন্ত এই সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকার এবং মানবিক সহায়তা প্রদানকারী সংস্থাসমূহের জন্য সুদৃঢ় বৈশ্বিক সংহতি এবং তহবিল অপরিহার্য, যাতে শরণার্থী এবং বাংলাদেশের স্থানীয় জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা অব্যহত রাখা যায়।
২০১৯ সালের জেআরপি-তে ৯২১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তহবিলের আবেদন করা হয়েছিল, যার প্রেক্ষিতে ৭০ শতাংশের কিছু বেশি বা ৬৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগৃহীত হয়েছিল।
আগামীনিউজ/হাসি