ঢাকাঃ বিচারকাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ, চার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা ও রাজধানীর বনানীর দ্য রেইন ট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনায় করা মামলার।
এর মধ্যে আবরার হত্যা মামলার যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায়ের জন্য দিন ধার্য করা হবে। আর এস কে সিনহার অর্থ আত্মসাৎ ও রেইন ট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। এ দুই মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন ও যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য করা হবে। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি বলছেন, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। রায়ে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে, এমনই আশা রাষ্ট্রপক্ষের।
আবরার হত্যা মামলার রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি প্রশান্ত কুমার কর্মকার বলেন, ‘আবরার হত্যা মামলাটি যুক্তি উপস্থাপন পর্যায়ে রয়েছে। যুক্তি উপস্থাপন শেষে মামলাটির রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য করা হবে। আমরা আশা করছি, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এ মামলার রায় ষোষণা হবে। রায়ে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে আশা করছি।’
এস কে সিনহা বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মীর আহম্মেদ সালাম বলেন, ‘এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে করা মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থন ও যুক্তি উপস্থাপন শেষে এ মামলার রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য করা হবে। আর দুই ধার্য তারিখের মধ্যে মামলাটি শেষ হবে বলে আশা করছি।’
বনানীতে দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আফরোজা ফারহানা আহম্মেদ অরেঞ্জ বলেন, ‘দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থন ও যুক্তি উপস্থাপন শেষ এ মামলার রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য করা হবে। আশা করি দুই-তিন ধার্য তারিখের মধ্যে মামলাটির রায় ঘোষণা হয়ে যাবে। রায়ে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করছি আমরা।’
আবরার হত্যা: যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায়
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন চুক্তির সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার জেরে আবরার ফাহাদকে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে ডেকে নেয় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। এরপর রাত ৩টার দিকে শেরেবাংলা হলের নিচতলা ও দোতলার সিঁড়ির করিডোর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
ওই ঘটনায় আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে চকবাজার থানায় ১৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান। অভিযুক্ত ২৫ জনের মধ্যে এজাহারভুক্ত ১৯ জন এবং তদন্তেপ্রাপ্ত আরও ছয়জন রয়েছেন। এজাহারভুক্ত ১৯ জনের মধ্যে ১৬ জন এবং এজাহারবহির্ভূত ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারদের মধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আটজন।
মামলার তিনজন আসামি এখনো পলাতক আছেন। তারা হলেন-মোর্শেদুজ্জামান জিসান, এহতেশামুল রাব্বি তানিম ও মোস্তবা রাফিদ। তাদের মধ্যে প্রথম দুজন এজাহারভুক্ত ও শেষের জন এজাহারবহির্ভূত আসামি।
২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। মামলায় মোট ৬০ জন সাক্ষীর মধ্যে ৪৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।
এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য শেষ
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ও কিছু পর্যবেক্ষণের কারণে তোপের মুখে ২০১৭ সালের অক্টোবরের শুরুতে ছুটিতে যান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা । পরে বিদেশ থেকেই তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন।
এরপর ২০১৯ সালের ১০ জুলাই ঋণ জালিয়াতি ও চার কোটি টাকা আত্মসাতে জড়িত থাকার অভিযোগে এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়, ঢাকা-১-এ মামলাটি দায়ের করা হয়। মামলার বাদী দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন।
দুদক জানায়, আসামি মো. শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় দুটি চলতি হিসাব খোলেন। ৭ নভেম্বর তারা দুই কোটি করে মোট চার কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেন। ব্যাংক হিসাব খোলা ও ঋণ আবেদনপত্রে দুজনই বাড়ি নম্বর ৫১, সড়ক নম্বর ১২, সেক্টর ১০, উত্তরা আবাসিক এলাকা- এই ঠিকানা উল্লেখ করেন। ওই বাড়ি সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ঋণ আবেদনে জামানত হিসেবে রণজিৎ চন্দ্র সাহার স্ত্রী সান্ত্রী রায় সিমির সাভারের ৩২ শতাংশ জমি দেখানো হয়। এ দুজনই এস কে সিনহার পূর্বপরিচিত। ঋণ আবেদন দুটি কোনোরকম যাচাই-বাছাই করা হয়নি। রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণ ও ব্যাংকের কোনো নিয়মনীতিও মানা হয়নি।
২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর আদালতে এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের পরিচালক বেনজীর আহমেদ। ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এ মামলায় ২১ জন সাক্ষীর মধ্যে সবার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।
ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক শেখ নাজমুল আলমের আদালতে ২৯ আগস্ট (রোববার) আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। আত্মপক্ষ সমর্থন শেষ হলে যুক্তি উপস্থাপনের জন্য দিন ধার্য করা হবে। এরপর মামলাটির রায় ষোঘণার জন্য দিন ধার্য করা হবে।
রেইন ট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণ মামলার সাক্ষ্য শেষ
শেষ পর্যায়ে রয়েছে রাজধানীর বনানীর দ্য রেইন ট্রি হোটেলে জন্মদিনের পার্টিতে দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগে আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে করা মামলার বিচারকাজও। মামলার অন্য আসামিরা হলেন সাফাতের বন্ধু নাঈম আশরাফ ওরফে এইচ এম হালিম, বন্ধু সাদমান সাকিফ, দেহরক্ষী রহমত আলী ও গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন।
মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ রাত ৯টা থেকে পরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত আসামিরা মামলার বাদী এবং তার বান্ধবী ও বন্ধুকে আটকে রাখেন। অস্ত্র দেখিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করেন। পরে বাদী ও তার বান্ধবীকে জোর করে একটি কক্ষে নিয়ে যান আসামিরা। সেখানে বাদীকে সাফাত আহমেদ ও তার বান্ধবীকে নাঈম আশরাফ একাধিকবার ধর্ষণ করেন। আসামি সাদমান সাকিফকে দুই বছর ধরে চেনেন মামলার বাদী। তার মাধ্যমেই ওই ঘটনার ১০-১৫ দিন আগে সাফাতের সঙ্গে দুই শিক্ষার্থীর পরিচয় হয়। পরে সাফাত তার জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কথা বলে ওই দুজনকে আমন্ত্রণ জানালে তারা সম্মত হন। আমন্ত্রণ জানাতে গিয়ে তাদের বলা হয়েছিল, বড় একটি অনুষ্ঠান হবে, অনেক লোকজন থাকবে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের (ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার) পরিদর্শক ইসমত আরা এমি ২০১৭ সালের ৭ জুন পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। একই বছরের ১৯ জুন ওই ট্রাইব্যুনাল আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন। এরপর ২০১৭ সালের ১৩ জুলাই ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক শফিউল আজম পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচারের আদেশ দেন।
অভিযোগপত্রে আসামি সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফ ওরফে এইচ এম হালিমের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে। অন্য তিন আসামি সাফাত আহমেদের বন্ধু সাদমান সাকিফ, দেহরক্ষী রহমত আলী ও গাড়িচালক বিল্লাল হোসেনের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে ৩০ ধারায় ধর্ষণে সহযোগিতার অভিযোগ।