ঢাকাঃ পুরান ঢাকার নিম্ন আদালত নানা সমস্যায় জর্জরিত। শতাধিক হকার, পাগলবেশী মাদকসেবী ও অবাঞ্ছিত লোকজনের অবাধ আনাগোনায় আদালত প্রাঙ্গণের পরিবেশ ও নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বিঘ্ন্নিত হচ্ছে। আর আদালত প্রাঙ্গণ থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোয় পর্যাপ্ত পার্কিং ব্যবস্থা না থাকায় বিচারপ্রার্থী, আইনজীবী ও সংশ্লিষ্টদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। আদালত প্রাঙ্গণে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা ও বিশ্রামাগার নেই। পাশাপাশি পর্যাপ্ত টয়লেট সুবিধাও নেই।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি মো. আবদুল্লাহ আবু জানান, আদালত চত্বরে ফেরিওয়ালা ও অবাঞ্ছিত লোকজনের আনাগোনা বন্ধ করতে হবে। আদালত প্রাঙ্গণকে মশা-ময়লা মুক্ত করে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। সর্বোপরি আদালতের নিরাপত্তার বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
ঢাকার তিন নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের স্পোশাল পাবলিক প্রসিকিউটর মাহমুদা আক্তার জানান, আদালত প্রাঙ্গণে পর্যাপ্ত টয়লেট ব্যবস্থা নেই। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা বেশ ভোগান্তিতে পড়ে। আদালতের সামনে বিচার প্রার্থীদের জন্য বেঞ্চের ব্যবস্থা নেই। সরকারি বরাদ্দ থাকলেও অজ্ঞাত কারণে এসব সুবিধা দেয়া হচ্ছে না। বয়স্ক, নারী ও শিশুরা যেন আদালতে এসে অসুবিধায় না পড়ে সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে।
পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব : আদালত চত্বরে চুরি-ছিনতাইসহ একাধিক অপকর্মের ঘটনা ঘটলেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনে প্রবেশে কোনো আর্চওয়ে নেই। দ্বিতীয় তলায় একটি আর্চওয়ে থাকলেও তা দেখভাল লোক নেই। ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রবেশপথে দুটি আর্চওয়ে থাকলেও সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্যকে চোখে পড়ে না।
চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সামনে সার্বক্ষণিক একজন কনস্টেবল থাকেন। বাকি ৩৪ জন ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসের সামনে পুলিশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। নতুন ভবনে চিফ জুড়িশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট স্থানান্তর হলেও সেখানে আর্চওয়ে দেখভালের কেউ নেই। শতাধিক হকার, পাগলবেশী মাদকসেবী ও অবাঞ্ছিত লোকজনের অবাধ আনাগোনায় আদালত প্রাঙ্গণের নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে।
বিচারক, এজলাস ও রেকর্ড রুম সংকট : পুরান ঢাকার নিম্ন আদালতে বিচারক সংকটের পাশাপাশি উপযুক্ত এজলাস ও আধুনিক রেকর্ডরুমের অভাব রয়েছে। বিভিন্ন এজলাসের পেছনে বিচারকদের চলাচলের বারান্দার দিকে ছোট ছোট স্টোর রুম রয়েছে। সেখানে অনেক সময় রেকর্ড রুম হিসেবে নিষ্পত্তি মামলার নথিপত্র রাখা হচ্ছে। এছাড়া রেবতী ম্যানশনের তৃতীয় তলায় সকালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর কার্যক্রম শেষে দুপুরের পর ঢাকার মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হয়। আর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পঞ্চম তলায় অবস্থিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫ এর এজলাস ভাগাভাগি করে চলছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৯ এর বিচার কার্যক্রম।
বিশুদ্ধ পানি ও বিশ্রামাগার সংকট : আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের জন্য আদালত প্রাঙ্গণে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা ও পর্যাপ্ত টয়লেট সুবিধা নেই। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের ষষ্ঠতলা ভবনে বিচার প্রার্থীদের জন্য তৃতীয় চতুর্থ ও ষষ্ঠ তলায় তিনটি টয়লেট রয়েছে। এছাড়া আরও দুটি টয়লেট থাকলেও তা তালাবদ্ধ দেখা গেছে। অধিকাংশ টয়লেট ব্যবহারে টাকা দিতে হয়। ঢাকা জেলা জজ আদালতের পাশে মসজিদের সামনে নতুন করে একটি গণটয়লেট স্থাপন করা হয়েছে। তবে সেখানে এমনই দুর্গন্ধ যে প্রবেশ করাই দুরূহ। এছাড়া পুরুষদের জন্য তৈরি টয়লেটের দরজা খুবই সরু। সেখানে প্রবেশ করাই দুরূহ হয়ে পড়ে। বিচার প্রার্থীদের জন্য বিশ্রামাগার নেই বললেই চলে। নারী ও শিশু বিচার প্রার্থীদের জন্য রেবতী ম্যানশনে একটি বিশ্রামাগার থাকলেও সেখানে তেমন লোকজন যান না।
দিনে ফেরিওয়ালা, রাতে মাদকসেবীদের দৌরাত্ম্য : আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবী ও বিচার প্রার্থী ছাড়াও বহিরাগত লোকজনের আনাগোনা রয়েছে। অনেকে দালালদের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হন। নানা মানুষের ভিড়ে আদালত প্রাঙ্গণে পকেটমারের দৌরাত্ম্যও রয়েছে। সরেজমিন দেখা যায়, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে হকারদের রাজত্ব চলছে। শতাধিক হকার অবাধে বিচারণ করছে। তাদের কেউ কেউ আবার স্থায়ী আসন গেড়েছেন। এছাড়া চত্বরে পাগলবেশী মাদকসেবীসহ অসংখ্য ফকিরের আনাগোনা রয়েছে।
আদালত চত্বরে আইনের বই-পুস্তক থেকে শুরু করে চা, পান, সিগারেট, ইঁদুর-তেলাপোকা মারার বিষ, শার্ট-কোট-গাউন, মোবাইল সিম নিবন্ধন, জুতা পলিশ, ঝালমুড়ি, আচার, বাদাম, আইসক্রিম, কলা, পেঁপে, শসা, গাজর, আনারস, ডাব, মাছ ও মুরগি সবই বিক্রি হয়। এছাড়া রাত হলেই চত্বরে মাদকসেবীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়।
ময়লা, মশার অভয়ারণ্য : আদালত প্রাঙ্গণে বিভিন্ন আবর্জনার স্তূপে দুর্গন্ধের পাশাপাশি মশার অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে প্রবেশের প্রধান ফটকের দু’পাশেই আবর্জনার স্তূপ রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই এসব স্থানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে আসামি এনে আবর্জনার পাশেই রাখা হয়। সেখানে তাদের সঙ্গে আত্মীয়-স্বজনরা একটু দেখা ও কথা বলার সুযোগ পান। প্রিজন ভ্যানগুলো ঘিরে তারা ময়লা-আবর্জনার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকেন। এছাড়া আদালত ভবনগুলোর নিচের চারপাশে রয়েছে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। এসব দ্রুত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে দাবি জানিয়েছেন আইনজীবী ও বিচার প্রার্থীরা।
আগামীনিউজ/প্রভাত