হিজড়াদের পারিবারিক সম্পত্তির ভাগ পেতে জটিলতা কেন?

ডেস্ক রিপোর্ট নভেম্বর ১২, ২০২০, ০৬:১৭ পিএম
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকাঃ হিজড়া জনগোষ্ঠীর বাবা মায়ের সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশে কোন আইনেই স্পষ্ট কিছু বলা নাই।

বাংলাদেশে হিজড়া জনগোষ্ঠী বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ যেন বাবা-মায়ের সম্পত্তির সমান ভাগ পান, সেজন্য আইন মন্ত্রণালয় মুসলিম শরিয়া আইন এবং সংবিধানের আলোকে একটা উপায় বের করার চেষ্টা করছে।

হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই নির্দেশনা দিয়েছেন।

কিন্তু হিজড়াদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারীরা বলেছেন, তাদের বাবা-মায়ের সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার প্রশ্নে বাংলাদেশে কোন আইনেই স্পষ্ট করে কিছু বলা নাই।

তারা আরও বলেছেন, বাংলাদেশের আইন এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে জটিল এবং স্পর্শকাতর এই বিষয়ে সরকার আসলে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেবে বা সহসাই কোন সমাধান হবে-এ ব্যাপারে তারা আস্থা রাখতে পারছেন না।

বাধা কোথায়?
জয়া শিকদার হিজড়া হওয়ার কারণে বাবা-মায়ের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তার এক ভাই এবং দুই বোন মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী সম্পত্তির ভাগ পেয়েছেন। কিন্তু তিনি সম্পত্তির ভাগ না পাওয়ার পেছনে আইন এবং সমাজকে বড় বাধা হিসাবে দেখেন।

তিনি বলেছেন, "আমার বাবার কাছে আমি যখন সম্পত্তি চেয়েছি, সে আমাকে বলে যে তোমাকে কোন পরিচয়ে আমি সম্পত্তি দেবো। আমার নারী স্বভাব রয়েছে। আমার বাবা আমাকে বলে, তুমি নারী পরিচয়ে বা নারীর পোশাক পরে আমার কাছে সম্পত্তি নিবা, সেটা আমার সমাজ গ্রহণ করবে না।"

"আমার বাবা আরও বলে যে, তোমারতো কোন সংসার নাই। তুমি সম্পত্তি দিয়া কি করবা? তার এক কথা সে দেবে না।"

জয়া শিকদার এখন সম্পত্তিসহ সমাজের সবক্ষেত্রে হিজড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেন।

তিনি বলেছেন, "বাংলাদেশে মুসলিম উত্তরাধিকার আইন এবং হিন্দু ধর্ম আইন- যেসব আইনে পরিবারিক সম্পত্তি ভাগ করে দেয়া হয়, কোন ধর্মের আইনেই হিজড়ারা সম্পত্তির ভাগ পাচ্ছে না। পরিবারের সদস্যরা আইনের সুযোগ নেয়। এছাড়া পরিবারের সদস্য এবং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও ইতিবাচক নয়।"

মানবাধিকার সংস্থা ব্লাস্ট এর হিজড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার সম্পর্কিত বিভাগে কাজ করেন শোভা সরকার। তিনি নিজেও একজন হিজড়া।

একজন বন্ধুর সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার লড়াইয়ের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেছেন, তার বন্ধু হিজড়া হওয়ার কারণে সেই লড়াইয়ে আইন এবং সমাজ কোন দিক থেকেই সমর্থন না পেয়ে তাদের হার মানতে হয়েছিল।

শোভা সরকার জানিয়েছেন, পরিবারের সম্পত্তিতে তার সেই বন্ধুর কোন অধিকারই ছিল না। বাবার সম্পত্তির ভাগ চাইলে ভাই বোনেরাই তাকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। তখন নিরাপত্তার অভাবে তার বন্ধু সম্পত্তির দাবি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

তিনি আরও বলেছেন, মামলা করে কোন লাভ হবে না- এমন ধারণা থেকে তিনি আইনগত পদক্ষেপও নেননি।

সম্পত্তির ভাগ চাইলে হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানুষ পরিবারের সদস্যদের নিষ্ঠুর আচরণের শিকার হন বলে তারা বলেন।

মুসলিম আইন কি বলছে
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের পারিবারিক সম্পত্তির ভাগাভাগির ক্ষেত্রে দেশটির প্রেক্ষাপট মিলিয়ে তাদের স্ব স্ব ধর্মের আইন ব্যবহার হয়ে থাকে।

ইসলাম ধর্মের মানুষের সম্পত্তি ভাগাভাগি হয় মুসলিম উত্তরাধিকার আইনের আওতায়।

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেছেন, ১৯৬১ সালের মুসলিম উত্তরাধিকার আইন বাংলাদেশে কার্যকর রয়েছে। সেই আইনে হিজড়াদের সম্পত্তির ব্যাপারে সুস্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি।

"মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে সন্তানদের কথা বলা হয়েছে। সন্তান মানে পুত্র এবং কন্যারা সম্পত্তির ভাগ পাবেন। বাংলাদেশে বিদ্যমান এই আইনে হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের ব্যাপারে সুস্পষ্ট করে বলা নাই। তবে বিভিন্ন দেশে ইসলামী আইন বিশারদরা হিজড়াদের সম্পত্তির ভাগ দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন এবং অনেক দেশে তা অনুসরণও করা হয়।"

তাজুল ইসলাম মনে করেন এ ব্যাপারে একটা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত।

"পাকিস্তানের একটা প্রদেশে ইসলামী আইন বিশারদরা গবেষণা করে একটা ফতোয়া দিয়েছেন, যে হিজড়া সন্তানদের মধ্যে পুরুষ ভাবটা প্রবল, তাদেরকে পুরুষ সন্তান হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। আর যাদের মাঝে নারীর স্বভাব বেশি, তাদের কন্যা সন্তান হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। এমন লক্ষণ বিবেচনা করে উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তির ভাগ সেখানে হয়।

''তবে এ ব্যাপারে বিশ্বে ইসলাম বিশারদদের সর্বসম্মত কোন সিদ্ধান্ত এখনও নেই। একটা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত।"

তিনি জানিয়েছেন, হিন্দু ধর্মাবলম্বী, খৃস্টান এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উত্তরাধিকারের প্রশ্নে কিছু বিধি বাংলাদেশে কার্যকর রয়েছে। কিন্তু সে সব ধর্মেও হিজড়াদের সম্পত্তির অধিকারের ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু বলা নাই।

হিজড়া জনগোষ্ঠীকে এখন কিছু কিছু কাজের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসাবে তাদের কয়েকজনকে নিয়োগ করা হয়েছে।

হিন্দু আইনে জটিলতা
বাংলাদেশে হিন্দু আইনে ঐ ধর্মবলম্বীদের জন্য সম্পত্তির ভাগাভাগি যেভাবে হয়, তাতে কন্যা সন্তানরাই বিয়ের পর বাবার সম্পত্তির ভাগ পান না। সেখানে হিজড়াদের ব্যাপারে কিছুই বলা নাই।

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী প্রবীর নিয়োগী বলেছেন, "হিন্দু আইনে হিজড়া সন্তানদের বাবা মায়ের সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার ব্যাপারে কিছু নেই। বিষয়টাতে আলোচনা প্রয়োজন।"

দু'জন আইনজীবীই আইনের অস্পষ্টতাকে বড় সমস্যা হিসাবে উল্লেখ করেছেন।

হিজড়া জনগোষ্ঠীর কয়েকজন

হিজড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারীরা বলেছেন,যেসব অভিযোগ তারা পান, তার বড় অংশই হিজড়াদের বাবা-মায়ের সম্পত্তির ভাগ না পাওয়ার বিষয়ে।

হিজড়া কালচার

হিজড়াদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী 'বন্ধু'' নামের একটি সংগঠনের তানভীর ইসলাম বলেছেন, হিজড়া জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে তারা প্রতিদিনই নানা অভিযোগ পেয়ে থাকেন। এসব অভিযোগের বড় অংশই বাবা-মায়ের সম্পত্তির ভাগ না পাওয়ার বিষয়ে।

তিনি উল্লেখ করেছেন, "সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা বাড়ি ছাড়া হয়ে হিজড়া কালচারে যুক্ত হয়। হিজড়ারা ১০ বা ১৫ জন মিলে একজনকে গুরু মেনে তার অধীনে একসাথে কোন বস্তিতে বা কোন বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে।"

"তারা ঈদ, বাংলা নববর্ষ বা কোন উৎসবে মানুষের কাছে চাঁদা তোলে এবং এলাকায় কোন পরিবারে সন্তান হলে সেই বাড়িতে গিয়ে চাঁদা নেয়। এই অর্থ এনে তারা গুরুকে দেয়। সেই অর্থ দিয়ে গুরু সবার খাওয়া এবং বাড়ি ভাড়া দেন। এটা হিজড়া কালচার হিসাবে পরিচিত। সম্পত্তি এবং পরিবারের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে তাদের এই পথে নামা ছাড়া কোন উপায় থাকে না।"

মি. ইসলাম বলেছেন, হিজড়ারা পরিবারে লড়াই করে যখন হেরে যায়, তখন তারা আর আইনের আশ্রয়ও নেয় না। কোন ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়ানোর নজিরও সেভাবে নেই। তবে এখন সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে তাদের কিছু কাজের সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। সেটা যথেষ্ট নয় বলে তিনি মনে করেন।

তিনি জানিয়েছেন, সরকারিভাবে আনুমানিক একটা পরিসংখ্যানে হিজড়ার সংখ্যা ১০ হাজার বলা হয়। তবে বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের হিসাবে দেশে হিজড়ার সংখ্যা তিন লাখের বেশি হবে।

তানভীর ইসলাম বলেছেন, দুই বছর আগে সরকারি গেজেটে হিজড়া একটি লিঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। যদিও তাদের ভোটার হওয়ার অধিকার দেয়ার ক্ষেত্রে তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে বলা হয়েছে। তবে সরকারি গেজেটে স্বীকৃতির পর সম্পত্তির অধিকার পাওয়ার দাবি জোরদার হয়েছে। তারা সহ আরও কয়েকটি সংগঠন মিলে হিজড়াদের সম্পত্তির অধিকারের জন্য একটা আইনের দাবিতে আন্দোলন করছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।

সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবী জানিয়েছেন, শহরের হাতে গোনা কিছু পরিবার হিজড়া সন্তানদের সম্পত্তির ভাগ দেয়। কিন্তু তিনি এমন দু'টি অভিযোগ পেয়েছিলেন, দু'জনের মেয়ে স্বভাব থাকায় তাকে মেয়ে সন্তান হিসাবে দেখিয়ে সম্পত্তির ভাগ দেয়া হয়েছে। তবে সেখানেও পরিবারের অন্য মেয়ে সন্তানের থেকেও তাদের ভাগে কম দেয়া হয়েছে।

অবশ্য হিজড়াদের বাবা মায়ের সম্পত্তির সমান ভাগ নিশ্চিত করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশনা দিয়েছেন, সে ব্যাপারে হিজড়া জনগোষ্ঠী দৃশ্যমান এবং কার্যকর পদক্ষেপ চায়।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিবিসিকে বলেছেন, মুসলিম শরিয়া আইন এবং বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে এ বিষয়ে তারা ব্যবস্থা নেবেন। এর বাইরে তিনি এখন বিস্তারিত কিছু বলেননি।

আগামীনিউজ/প্রভাত