ঢাকাঃ দেশের চলমান সড়ক দূর্ঘটনা নিয়ে উদ্বিগ্ন কর্তাব্যক্তিরা। ২০২০ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৬৮৬ জন নিহত হয়েছেন। সড়কে নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার করছেন ঠিকাদাররা উঠেছে এমন অভিযোগ। দেশের সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণে বিশ্বমানের বিটুমিন উৎপাদন করছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড বা ইআরএল। কিন্তু চাহিদার তুলনায় তাদের সক্ষমতা কম হওয়ায় আমদানি করা বিটুমিনের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। এ সুযোগে সারা দেশের সড়কে আমদানি হওয়া নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার করছেন অসাধু ঠিকাদাররা। নকল বিটুমিনে তৈরি সড়ক দ্রুতই ভাঙছে। সেই ভাঙা সড়কে ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন। বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। এতেই প্রতিবছর সড়কে হাজার হাজার তাজা প্রাণ ঝরে লাশ হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’-(নিসচা) এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চনের মতে, বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে যেমন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, তেমনি ত্রুটিপূর্ণ রাস্তার কারণেও দুর্ঘটনা হচ্ছে। ভাঙা সড়কও দুর্ঘটনার কারণ। বিশ্বে রাস্তা নির্মাণে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় বাংলাদেশে। কিন্তু এত টাকা দিয়ে রাস্তা তৈরি হওয়ার পরও ভালো থাকে না, এটা জনগণের জন্য বড় কষ্টের বিষয়।
সরেজমিন দেখা যায়, দেশের প্রায় ৪৫টি জেলায় শত শত সড়কের বিভিন্ন জায়গা দেবে গেছে কিংবা খানাখন্দ তৈরি হয়েছে। এসব রাস্তা তৈরির কাজও চলছে। খোলা ড্রামে, পুরনো আমলের প্রযুক্তি ব্যবহার করে, আগুনে পুড়িয়ে গলানো হচ্ছে বিটুমিন। যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে, বিটুমিনকে গরম করার আদর্শ তাপমাত্রা হলো সর্বোচ্চ ১৫০ থেকে ১৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু এখানে আদর্শ তো দূরে থাক, তাপমাত্রা মাপারই ব্যবস্থা নেই। আর বিটুমিনের ড্রামে চোখ রাখলে দেখা যায়, সবই বেসরকারিভাবে আমদানি করা নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের বিটুমিন। তবে কিছু অসাধু ঠিকাদার একটি কৌশল ব্যবহার করে। তারা দেশে তৈরি ইস্টার্ন রিফাইনারির কয়েকটি ড্রাম প্রকাশ্যে রাখেন। আড়ালে রাখেন কম দামে আমদানি করা নিম্নমানের বিটুমিন। এসব ভেজাল বিটুমিন দিয়ে তৈরি রাস্তাগুলোর আয়ু বড়জোর এক বছর বা তারও কম। ফলে সড়কে চলাচল করতে গিয়ে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে। সড়কে সড়কে শত শত দুর্ঘটনায় তরতাজা প্রাণ হয় লাশ।
বিশিষ্ট যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, বিটুমিন আগুনে গলানোর সময় তাপমাত্রা কত থাকবে, আবার ট্রাকে তোলার সময় তাপমাত্রা কত হবে, এরপর ট্রাক থেকে নামিয়ে নির্মাণাধীন রাস্তায় যখন ছড়িয়ে দেওয়া হবে, তখন কত মাত্রার তাপ থাকবে, সেটা দেখা হয় না। ঠিকাদাররা তাদের বাণিজ্যিক মনোভাবের কারণে এ বিষয়গুলো মেনে চলেন না। এ কারণে আমরা বিটুমিনের রাস্তা টেকসই করতে পারি না।
সর্বশেষ ২০২০ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৬৮৬ জন নিহত হওয়ার তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি। সংগঠনটি দেশের জাতীয়, আঞ্চলিক ও অনলাইন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি প্রতিবেদনে বলেছে- ২০২০ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের সঙ্গে আহত হয়েছেন ৮ হাজার ৬০০ জন। দুর্ঘটনার তথ্য পর্যালোচনা করে সংগঠনটি বলছে, গত বছর যত সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে, এর মধ্যে ৫২ দশমিক ৯৬ শতাংশ গাড়িচাপা দেওয়ার ঘটনা। এ ছাড়া ২২ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ১৭ শতাংশ যানবাহন খাদে পড়ে দুর্ঘটনাকবলিত।
দেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রায় ২৯ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৪৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে সংঘটিত হয়েছে। বিটুমিন মূলত সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে বছরে বিটুমিনের চাহিদা প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টন। এর প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। এর মধ্যে বিপিসির নিয়ন্ত্রণাধীন ইস্টার্ন রিফাইনারি ৭০ হাজার টন উৎপাদন করে। বাকি বিটুমিন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। তবে প্রায়ই বিদেশ থেকে নিম্নমানের বিটুমিন আমদানি করে সড়কে ব্যবহারের কারণে সড়ক টেকসই হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি মাসে বিটুমিনের চাহিদা প্রায় ৪২ হাজার টন। উন্নয়ন কর্মকান্ড সম্প্রসারিত হওয়ায় প্রতি বছর এর চাহিদা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে।