মাগুরাঃ করোনায় কর্মহীন ৪৩৮জন শিল্পী কলা কুশলীর জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের সহায়তা ৪৩ লাখ ৮০ হাজার টাকার বিতরণ তালিকায় ব্যাপক দূর্ণীতি, স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। গত ১৭ মার্চ থেকে বিতরণ করা ওই শিল্পীর তালিকা জেলা শিল্পকলা একাডেমীর কালচারাল অফিসার ও একজন সহ েসাধারণ সম্পাদকসহ কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাযোশে গোপনে তৈরী করা হয়েছে।
তালিকায় ভারতে অবস্থানরত সেখানকার নাগরিক, মৃত ব্যক্তি, কোটিপতির স্ত্রী এমনকি একই পরিবারের ১৫ জনের নামে ১০ হাজার করে টাকা বেয়ারার চেকের মাধ্যমে তুলে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। যারা কেউই দুঃস্থও নন, শিল্পীও নন। একইভাবে শিল্পকলার সংগীত শিক্ষক অজিত রায়ের বিরুদ্ধে একই পরিবারের ৬জনে নাম দিয়ে ৬০ হাজার টাকা তুলে নেয়া সহ শিল্প সংস্কৃতির সাথে নুন্যতম সংযোগ নেই এমন ব্যক্তিদের নাম দিয়ে লাখ লাখ টাকা তুলে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমনকি জেলা শহরে ২টি ফ্লাট ও ২টি বাড়িসহ অন্তত ৩ কোটি টাকার সম্পত্তির মালিকের স্ত্রীকেও দেয়া হয়েছে করোনায় ক্ষতিগ্রস্থ শিল্পীর প্রনোদনা।
এরফলে অনেক প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থ শিল্পী সহায়তা না পেলেও শিল্পীদের চেকবিতরণ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা শিল্পকলা একাডেমীর কালচারাল অফিসার। এতে সরকারের এ মহতি উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে জেলার শিল্পী সমাজের মধ্যে।
জেলার কয়েকজন সাংস্কৃতিক কর্মী ওই তালিকায় শিল্প সাহিত্যের সঙ্গে নুন্যতম যোগাযোগ না থাকা একাধিক ব্যক্তির নাম দিয়ে টাকা উঠিয়ে নেয়ার অভিযোগের প্রেক্ষিতে জানা গেছে। ৩৫৫ নং সিরিয়ালের সুধা রানী চক্রবর্তী গত ১২ মার্চ মারা গেছেন। অথচ তার নামের চেকে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। তালিকার ২৭২ নং সিরিয়ালের জেলার শালিখা উপজেলার তালখড়ি গ্রামের আনন্দ চক্রবর্তী শিল্পকলা একাডেমীর সহ সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ চক্রবর্তীর ভগ্নিপতি ও ২৭৪ নং এর বিথি চক্রবর্তী তার আপন ছোট বোন।
গত ৫বছর ধরে এ পরিবারটি স্বপরিবারে ভারতে বসবাস করছেন। সন্তানদের সেখানকার স্কুলে ভর্তি করে লেখাপড়া করাচ্ছেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। তালিকার ২২৯ নং সিরিয়ালে পবিত্র কুমার চক্রবর্তী স্থানীয় একটি কাপড়ের দোকানের সেলসম্যানকে নাট্যশিল্পী হিসেবে দেখানো হলেও তিনি জীবনে কোনদিন স্টেজে উঠেছেন বলে শহরের কেউই জানেন না। তিনি জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সহ—সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ চক্রবর্তীর ভগ্নিপতি।
একইভাবে ২৩০নং সিরিয়ালের ইন্দ্রজিৎ চক্রবর্তী বিশ্বজিতের ভাইপো, ২৫৫ সিরিয়ালের বরুন চক্রবর্তী বড়ভাই, ২৫৬ ইতি চক্রবর্তী বিশ্বজিতের ছোটবোন, ২৬৪ প্রনয় চক্রবর্তী ভাগ্নে, ২৬৫ প্রিয়াংকা চক্রবর্তী ভাতিজা বৌ, ২৬৬ গোপাল চক্রবর্তী চাচাতো ভাই, ২৬৭ বন্দনা চক্রবর্তী ভাইয়ের বৌ, ২৬৮ প্রদীপ চক্রবর্তী চাচতো ভাই এর ছেলে, ২৭০ কার্তীক চক্রবর্তী চাচতো ভাই এর ছেলে, ২৭১ সুদীপ্ত চক্রবর্তী ভাতিজা, ২৩৮ নং সিরিয়ালে দুলাল ভট্টাচার্য তার ভগ্নিপতি ও ২৫৭ সিরিয়ালের ছবি রানী ভট্টাচার্য ভাইয়ের স্ত্রী। যাদের কেউই শিল্প সংস্কৃতির সাথে জড়িত নন।
এভাবে শিল্পী নাম দিয়ে পরিবারের সদস্যদের দিয়ে লাখ লাখ টাকা তুলে নিয়েছেন বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী ও তার সঙ্গীরা। একইভাবে শিল্পকলা একাডেমীর সংগীত শিক্ষক অজিত রায় শহরের সাতদোহা পাড়া এলাকার একটি পরিবারের ৬ নারীর নাম দিয়ে টাকা উঠিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এরা হলেন সন্ধ্যা রানী ঘোষ (৪১৯), প্রিয়া ঘোষ(৪৪), রিয়া ঘোষ (৮৫), ডলি ঘোষ (১০৪), আপন ঘোষ (১০৫) ও লিলি ঘোষ (১৭২)। এদের কারোই শিল্প সংস্কৃতির সাথে কোন যোগাযোগ নেই। অথচ তাদের প্রত্যেকের নামে ১০ হাজার টাকা করে বেয়ারার চেক দিয়ে টাকা তুলে নেয়া হয়েছে।
শহরের কেশব মোড়ের বাসিন্দা বর্তমানে স্বামীর কর্মস্থল ঢাকায় অবস্থানরত স্নিগ্ধা পাল নামে এক সাবেক নৃত্য শিল্পী ও তার মায়ের নামে ১০ হাজার করে টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কাস্টমস বিভাগে কর্মরত এক ব্যক্তির স্ত্রী স্নিগ্ধা পালের মাগুরা শহরে ২টি ফ্লাট, ১টি বাড়ি ও একটি বিশাল বাগান বাড়ি রয়েছে। যার মূল্যমান কমপক্ষে ৩ কোটি টাকা। স্বজনপ্রীতি করে তাকে ও তার মা জোসনা পালকে ১০ হাজার করে মোট ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারিভাবে যখন করোনায় ক্ষতিগ্রস্থ শিল্পীদের সহায়তা দেয়ার জন্য নামের তালিকা আহবান করা হয় তখন শিল্পকলা একাডেমীর সাধারণ সম্পাদকের অসুস্থতার সুযোগে অফিসে না আসার সুযোগ নিয়ে সহ সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, অজিত রায় এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের একটি অসাধুচক্র একত্রে বসে বিভিন্ন ব্যক্তির নাম ও আইডি নম্বর সংগ্রহ করে নিজ মনগড়া একটি তালিকা প্রেরণ করে। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রকৃত শিল্পীদের বিষয়টি জানতেই দেয়া হয়নি। অথবা তাদের আবেদন অগ্রাহ্য করা হয়েছে। যার ফলে প্রকৃত শিল্পীরা অনেকেই বঞ্চিত হলেও মুখচেনা বিভিন্ন ব্যক্তির নাম দিয়ে তালিকা প্রেরণ করা হয়। চূড়ান্ত তালিকার প্রায় ৭০ ভাগই অশিল্পী বলে দাবী করেছেন একাধিক সংস্কৃতি সংগঠক। ফলে সরকারের এত বড় একটি মহতি উদ্যোগ ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে।
তালিকা যাচাই করতে গিয়ে দেখা গেছে ২২ নং সিরিয়ালে অচলা মন্ডল নামে এক নারীর নাম তালিকায় থাকলেও সেখানে দেয়া ফোন নম্বরে ফোন দিয়ে ওই নারীর স্থলে সাতক্ষিরা থেকে আব্দুর রহমান নামে এক ব্যক্তি ফোন ধরেন। অন্যদিকে শহরের তাতীপাড়া এলাকার বাসিন্দা শিল্পী কবরী ঘোষের নাম থাকলেও তাকে তিনি কোন টাকা বা চেক পাননি বলে জানিয়েছেন। অথচ ইতিমধ্যে চেক বিতরণ করা হয়ে গেছে মর্মে জানিয়েছেন শিল্পকলা সংশ্লিষ্ঠরা।
মাগুরার বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী শুকুর আল মামুন, চিত্রশিল্পী শামসুজ্জামান পান্না, সাহিত্যিক এম এ হাকিম, লোক সাংস্কৃতি সংগঠক এ.টি.এম. আনিসুর রহমান, সাহিত্য সংগঠক এ্যাড. কাজী মিহির, সাহিত্যিক লিটন ঘোষ জয়সহ একাধিক ব্যক্তি ক্ষোভ ও দুঃখের সঙ্গে জানান, শিল্প সংস্কৃতিক সঙ্গে যারা জড়িত তারা সাধারণত উদার মানবিক হবেন, এমনটিই ভাবা হয়ে থাকে। প্রকৃত শিল্পীরা যেখানে করোনার কারণে চরম অর্থ সংকটে অনেকে অনাহারে অর্ধাহারে আছেন। পরিচিত অনেক প্রয়াত শিল্পীদের পরিবার যেখানে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সেখানে শিল্পীদের জন্য দেয়া সরকারের এত বড় একটি মহতি উদ্যোগের টাকা নয়ছয় করা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। মাগুরা জেলা শিল্পকলা একাডেমীর আড়ালে একটি অসাধু চক্র যেভাবে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করেছেন তাতে আমরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। এরা শিল্প সংস্কৃতির চরম শত্রু।
অভিযোগ প্রসঙ্গে জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সহ সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিত চক্রবর্তী জানান, আমার পরিবারের সদস্যরা যদি প্রনোদনা পাওয়ার উপযোগি হন তাহলে তারা টাকা পেতেই পারেন। আমি কোন স্বজন প্রীতি বা দূর্নীতি করিনি।
এ প্রসঙ্গে জেলা শিল্পকলা একাডেমীর কালচারাল অফিসার মোঃ জসিম উদ্দিন জানান, শিল্পকলা একাডেমী থেকে নামের তালিকা চেয়ে পাঠানোর পর দ্রুত তালিকা পাঠানো হয়েছে। ফলে কিছুটা অসামঞ্জস্য থাকতেই পারে। তালিকার সবাইকে টাকা দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান। তবে একটি তালিকায় একই পরিবারের ১৫ জনের নাম থাকাটা দুর্ভাগ্যজনক বলেন তিনি।
জেলা প্রশাসক ড. আশরাফুল আলম জানান, কয়েকজন শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির মাধ্যমে আমরা চেষ্টা করেছি সবোর্চ্চ সতর্কতার সাথে তালিকা প্রস্তুত করতে। এখানে কোন অনিয়ম দূর্ণীতি হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। ভবিষ্যতে যেন আরও বেশী সংখ্যক প্রকৃত শিল্পীরা সহায়তা পান সেজন্য প্রচেষ্টা অব্যহত থাকবে।
আগামীনিউজ/এএস