‘ব্যাংকিং সেবা গ্রাম পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই‍‍’

নিজস্ব প্রতিবেদক জুন ১৪, ২০২২, ০১:০২ এএম
যশোদা জীবন দেবনাথ

ঢাকাঃ যশোদা জীবন দেবনাথ। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। জীবনে বেড়ে ওঠার প্রতিটি পদে পদে তাকে কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছে। অক্লান্ত পরিশ্রম, অধ্যবসায় আর সফল হবার প্রবল ইচ্ছা থেকেই বর্তমানে তিনি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ও  বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালক। তার চেয়েও বেশি  পরিচিত টেকনোমিডিয়া লিমিটেড ও প্রোটেকশন ওয়ান প্রাইভেট লিমিটেডের কারণে। দেশের এটিএম মেশিনের সিংহভাগই সরবরাহ করছে তার প্রতিষ্ঠান। উদীয়মান এই শিল্পপতি সম্প্রতি সফলতা-ব্যর্থতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন আমার সংবাদের সাথে। তার মুখোমুখি হয়েছিলেন  আগামী নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক।   

আগামী নিউজ- কেমন আছেন, দিনকাল কেমন চলছে?

যশোদা জীবন দেবনাথ- খুব ভাল আছি। সবকিছু মিলে ভালোই চলছে। 

আগামী নিউজ- আধুনিক ব্যাংকিং সেবা নিয়ে সামনের পরিকল্পনা জানতে চাই?

যশোদা জীবন দেবনাথ-আমি বর্তমানে অনেকগুলো প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছি। যেগুলোতে আমাকে আইসিটি মিনিস্ট্রি সাহায্য করছে। বাংলাদেশে এখন প্রায় ১৪০০০ এটিএম মেশিন আমার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের সব মানুষের কাছে এখনো এই সুবিধাগুলো পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। ডিজিটাল প্রেমেন্ট সিস্টেমটা আমরা ইউনিয়ন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছি। একটা শহরের মানুষ যদি ২৪ ঘন্টা ব্যাংকিং সুবিধা পেতে পারে তাহলে একটি গ্রামের মানুষও সেটা পাবে। আমি গ্রামের মানুষের সাথে ব্যাংকিং সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করতে এটিএম কে ইউনিয়ন পর্যায়ে নিতে পরিকল্পনা করে রেখেছি, এমনকি কাজও শুরু করেছি। এ সুবিধা চালু হলে গ্রামের মানুষের ঘরের ভেতর টাকা রাখার প্রবণতা কমে যাবে। উন্নত হবে জীবন যাত্রার মান। বাড়বে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি।

আগামী নিউজ- তরুনরা চাকরির পিছে ছুটছে, তরুনদের জন্য কি পরামর্শ দিবেন?

যশোদা জীবন দেবনাথ- চাকরি একটা বদ নেশা। কারো যদি সৎ ইচ্ছা থাকে তাহলে সে চাকরির পেছনে ঝুকবে না। ব্যবসা করবে অথবা ফ্রিল্যান্সিং। অনেক কাজ করার সুবিধা আছে। একটা চাকরি করে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা বেতন পায়। অপরদিকে ফ্রিল্যান্সিং করে ১ লক্ষ টাকার উপরে আয় করা সম্ভব। এক্ষেত্রে কিন্তু নিজের স্বাধীনতাও রয়েছে। সুতরাং আমি সবসময় তরুনদের চাকরির পেছনে দৌড়াতে নিষেধ করি।

আগামী নিউজ- আপনার চরিত্রের শক্তিশালী দিক কোনটি বলে মনে করেন?

যশোদা জীবন দেবনাথ- এক কথায় বলতে গেলে আত্নশক্তি। আমি সকালে কাজে বের হই, কিন্তু সন্ধ্যা অবধি কাজ করার পড়েও মনে হয় আমি এখনি কাজে আসছি। ইচ্ছাশক্তি জাগ্রত হলে কেউ আপনাকে থামাতে পারবে না। ইচ্ছাশক্তি জাগ্রত হলে তাকে আটকে রাখা অসম্ভব। 

আগামী নিউজ- কোন বন্ধুরা এগিয়ে এসেছিল ?

যশোদা জীবন দেবনাথ- গ্রামের পাশে জনতা স্টোরে আড্ডা দিতাম। সেখানে বন্ধুদের অনেক বলেছি আমাকে একটি চাকরি জোগাড় করে দিতে। কিন্তু কেউ সাড়া দেয়নি। মানুষের অর্থবিত্ত না থাকলে শুভাকাঙ্ক্ষীরাও পাশে থাকেনা। অনেক পরিচিত মুখ মুহূর্তেই অপরিচিত হয়ে ওঠে। তবে জনতা স্টোরে স্বপন নাম করে আমার এক বন্ধু ছিলো। সে কর্মচারীর কাজ করতো। তার সহযোগিতায় আমি সেই দোকানে কাজ করার সুযোগ পাই। দোকান মালিকের বাড়িতে সকলের খাওয়া শেষ হলে টেবিল পরিস্কার করে সেখানেই আমি ঘুমাতাম। সকালেই আবার দোকান খুলতাম। এভাবেই সময়ের সাথে আমিও বুঝতে শিখি জীবনকে। পরবর্তীতে ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে আমি ভর্তি হই। সেসময়ে কোতোয়ালি থানার ওসি মোস্তফা কামাল আমার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন। তার বাসাতেই বাচ্চাদের পড়াতাম। ভদ্রলোক আমাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। অর্থ আর মানসিকতার লড়াইয়ে পাশে থেকেছেন। অনন্তর অনুপ্রেরনা দিয়ে গেছেন। ঢাকায় এসে একটি কম্পিউটার ফার্মে যুক্ত হতেও তিনি সহযোগিতা করেছিলেন। কম্পিউটার সার্ভিসেস নামের সেই প্রতিষ্ঠানে  শেখার সুযোগ ও কিছু টাকাও পেলাম। জগতে কিছু মানুষ থাকে যারা অপরের প্রয়োজনে নিজের সর্বস্ব দিতে পিছুপা হননা। তিনি সেই বিরল মানুষদের একজন।

আগামী নিউজ- পর্দার আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে? 

যশোদা জীবন দেবনাথ- অনুপ্রেরণা বলতে আমার সেই শৈশবের ছায়া মোস্তফা কামালকেই বুঝি। এছাড়াও কিছু বন্ধুরা পাশে থেকেছে। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। জীবনের এই পর্যায়ে এসে ঈশ্বর আমায় অনেক দিয়েছেন। কিন্তু মোস্তফা কামালের সেই ঋণ আজও পরিশোধ করতে পারিনি। কিছু ঋণ কখনো শোধ করা যায়না। থাকুক না এমন কিছু অস্তিত্বের ঋণ! পাশাপাশি আমার বাবা মায়ের আশীর্বাদ সেই গ্রামের ছোট যশোদা জীবন থেকে সিআইপি যশোদা জীবন দেবনাথে পরিনত করেছে। বাবার মাত্র ১৫০০ টাকা আয়ের অর্ধেকই আমাকে দিয়ে দিতেন। যমুনা সেতু বানানোর সময়তেও আমি সেখানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেছি। জীবনে অনেক সীমাবদ্ধতাকে কাছে থেকে দেখেছি। মানতে ও মানিয়ে নিতে শিখেছি।

আগামী নিউজ- কিভাবে সফলতার যাত্রা শুরু হয়েছিল? 

যশোদা জীবন দেবনাথ-  ২০০৭ সালে আইটি ফার্ম করে এলজিইডি মন্ত্রণালয়ে কম্পিউটার সরবরাহ করি। জুলাইতে গিয়ে বিল সাবমিট করলাম। কিন্তু দেখতে পেলাম ফান্ডে কোন টাকা নেই। বিল পেতে আমাকে আরও একটি বছর অপেক্ষা করতে হবে। একদিকে সকলের থেকে ধার-দেনা করে টাকা নিয়ে কম্পিউটার সরবরাহ করায় তাদের বকেয়া দেবার চাপ অপরদিকে মানসিক বিষণ্ণতা আমার চলার পথকে স্থবির করে দিয়েছিলো। ওই মুহূর্তে আমার বাসায় রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও পর্যাপ্ত অর্থ ছিলোনা। এমনও দিন গেছে হাতের একটি ব্রেসলেট বিক্রি করে চলতে হয়েছে। তবে আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় এনসিআর একটি মেইল। একদিন সকালে বাসায় স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক থেকে একটি মেইল পেলাম। আমি সরাসরি যোগাযোগ করলাম। তারা আমাকে কাজ করার সুযোগ দিলেন। এসবই কাকতালীয় মনে হয়েছিল। যেহেতু আমার সাথে আগের রাতে অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছিল সেহেতু এগুলো আস্তে আস্তে স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। তারা আমাকে অগ্রিম টাকাও দিলেন কাজ শুরু করতে। সেই থেকেই আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

আগামী নিউজ- আমাদের সময় দেবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

যশোদা জীবন দেবনাথ- আপনাকেও ধন্যবাদ। আগামী নিউজের জন্য শুভকামনা।

এসএস