করোনাকালে ক্যান্সার স্ক্রিনিং এ সতর্কতা

পলি শাহনাজ জুলাই ২, ২০২০, ০৬:১৩ পিএম
ডা. মো. হাবিবুল্লাহ

ঢাকা: মরণব্যাধী ক্যান্সার নিয়ে সকলের সচেতনতা খুব জরুরি। কিন্তু করোনাকালে হাসপাতালগুলো থেকে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকায় আপাতত ক্যান্সার স্ক্রিনিং (লক্ষণপূর্ব সনাক্তকরণ) থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। 

এ প্রসঙ্গে, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ক্যান্সার রোগতত্ববিভাগের প্রধান ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার আগামীনিউজের প্রতিবেদকের সঙ্গে সাক্ষাতকালে এর ঝুঁকির দিকগুলো বর্ণনা করেছেন। বাড়িতে ফ্রি কল করার পরামর্শ দিয়ে তিনি তার মোবাইল নম্বরটি সংযুক্ত করেছেন। (ফ্রি পরামর্শের জন্য: ০১৭৬৪৪৯০৫৭৪)

আগামীনিউজ: করোনা পরিস্থিতিতে ক্যান্সার স্ক্রিনিং এর সতর্কতা কী কী?

ডা. মো. হাবিবুল্লাহ: কোভিড-১৯ মহামারিতে পুরো বিশ্ব একরকম থমকে গেছে। এর প্রথম ধাক্কা লাগে আক্রান্ত দেশগুলোর স্বাস্থ্যসেবায়। গত একশ' বছরে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে একসঙ্গে এমন মহামারি দেখা যায়নি। তাই উন্নত দেশের আধুনিক চিকিৎসা ব্যাবস্থাও অনেকটা ভেঙে পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে করোনা আক্রান্ত ও অন্যান্য সব রোগীর সেবা দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছে অনেক দেশ। কারণ, করোনার এই পরিস্থিতিতে সাধারণত একটিু নিরাপদে থাকার জন্য সবাইকে হাসপাতালে এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যকর্মীদের করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু হচ্ছে যা বিপজ্জনক। আবার অনেক রোগীও হাসপাতালে গিয়ে করোনায় সংক্রমিত হচ্ছেন।

আগামীনিউজ: ক্যান্সার স্ক্রিনিং এর গুরুত্ব কী?

ডা. মো. হাবিবুল্লাহ: ক্যান্সার যদি প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয় করা যায়, তবে চিকিৎসায় সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। ক্যান্সারের লক্ষণ দেখা দিলে, হাতের কাছে পাওয়া যায় এমন চিকিৎসায় কোনো উন্নতি না হলে, হাসপাতাল বা চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া তাই খুব জরুরি।

তবে লক্ষণ দেখা দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার দরকার নেই। লক্ষণ নেই, কিন্তু কোনো বিশেষ ক্যান্সারের এক বা একাধিক ঝুঁকি আছে, এমন আপাতঃ সুস্থ মানুষদের ক্যান্সার স্ক্রিনিং টেস্ট করালে গোপনে থাকা ক্যান্সার নির্ণয় হতে পারে। আমাদের মত দেশে স্তন, জরায়ুমুখ ও মুখগহ্বরের ক্যান্সারের সহজ স্ক্রিনিং টেস্ট ব্যাপক হারে করা সম্ভব।

আগামীনিউজ : ক্যান্সার রোগীর করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কী কী? 

ডা. মো. হাবিবুল্লাহ: ক্যান্সারের বিভিন্ন বিশেষায়িত বিষয়ের আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো করোনাকালে ক্যান্সার সেবার নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। বাংলাদেশেও এই নীতিমালা অনুসরণ করা শুরু হয়। এই নীতিমালাগুলোতে সংগত কারণেই চিকিৎসা-পরবর্তী ফলোআপ ও লক্ষণপূর্ব শনাক্তকরণ তথা স্ক্রিনিং পরীক্ষা নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। জরুরি নয়, এমন অপারেশন বাদ অথবা পিছিয়ে দিয়ে প্রয়োজনে বিকল্প চিকিৎসার কথা ভাবতে হচ্ছে। কেমোথেরাপি বা ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা, কিংবা বিকিরণ বা রেডিওথেরাপির ক্ষেত্রেও রক্ষণশীল হতে হচ্ছে।

আমেরিকার সোসাইটি অব ব্রেস্ট সার্জনসসহ শীর্ষ পাঁচটি সংগঠন গত ১৩ এপ্রিল এক যুক্ত বিবৃতিতে কিছু ব্যতিক্রম বাদে কোভিড-১৯ সংকট নিরসন পর্যন্ত স্তন ক্যান্সারের স্ক্রিনিং মেমোগ্রাফি, আল্ট্রাসাউন্ড ও এমআরআই পরীক্ষা স্থগিত রাখার প্রতি সমর্থন জানায়। রোগী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সংক্রমণ ঝুঁকি এড়াতেই এই ব্যবস্থা। অন্যান্য ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও সতর্কতা, নিরাপত্তার উপর জোর দেয়া হয়েছে। 

আগামীনিউজ: প্রতি বছর কত মানুষ ক্যান্সার আক্রান্ত ও মারা যান?

ডা. মো. হাবিবুল্লাহ: এই শতাব্দীর শুরু থেকে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার মত প্রধান অসংক্রামক রোগগুলিই স্বাস্থ্যব্যবস্থার মনোযোগের কেন্দ্রে থাকা উচিত বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো গুরুত্ব দিয়ে আসছিলো। গ্লোবোক্যান (২০১৮) প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষ প্রতি বছর নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। মারা যায় ১ লাখ ৮ হাজার। 

আগামীনিউজ: ক্যান্সারের ঝুঁকি এড়ানোর উপায় কি?

ডা. মো. হাবিবুল্লাহ:  ক্যান্সারের ঝুঁকি ও এর প্রতিরোধ সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা এবং ক্যান্সার স্ক্রিনিং- এ দুটো পারে একে নিয়ন্ত্রণে আনতে। তবে করোনার জন্য এই কাজগুলি অনেক দিন পিছিয়ে গেলে, পরিস্থিতি আরো বেসামাল হয়ে পড়বে। 
আবার, ক্যান্সারের ঝুঁকি আছে এমন কারো ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার চেয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে কোভিড সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি। 

আগামীনিউজ: এমতাবস্থায় স্ক্রিনিং সেবা প্রতিষ্ঠান কি কি করতে পারে?

ডা. মো. হাবিবুল্লাহ:  ১. ঝুঁকির মাত্রা বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। স্বাভাবিক অবস্থায় আমাদের দেশে শুধু বয়স বিবেচনায় স্ক্রিনিং পরীক্ষার সুপারিশ করা হয়। এখনকার পরিস্থিতিতে আরো এক বা একাধিক ঝুঁকি না থাকলে আরো দুই বা তিন মাস অপেক্ষা করা যেতে পারে, সংক্রমণ পরিস্থিতির উন্নতির আশায়।

২. সীমিত পরিসরে ও শারীরিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে নির্ধারিত কেন্দ্রগুলোতে স্ক্রিনিং টেস্ট চালু রাখা যায়। ভীড় এড়াতে সীমিত সংখ্যায় এপয়েন্টমেন্ট দিতে হবে। 
৩. টেলিফোন ও অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে আগে বাছাই করে নিতে হবে। বিশেষ করে কোভিডের কোন উপসর্গ আছে কিনা, তা ভালো করে জেনে নিতে হবে। 
৪. কেন্দ্রে যারা আসবেন টেস্টের জন্য, তাদেরকে আগে ট্রায়াজ বা শ্রেণিবিভাগ করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রয়োজনে কোভিড টেস্ট করিয়ে নিতে হবে। 
৪. এন্ডোস্কপি, কলোনোস্কপি, কল্পস্কোপির মত পরীক্ষাগুলি স্ক্রিনিং এর জন্য আপাতত: নিরুৎসাহিত করতে হবে। 
৫. চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। 

আগামীনিউজ: করোনাকালে রোগীদের কী কী করা উচিত?  

ডা. মো. হাবিবুল্লাহ: ১. বেশি ঝুঁকিপূর্ণ না হলে আরো কিছুদিন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে না গিয়ে ক্যান্সারের স্ক্রিনিং এড়িয়ে চলা উত্তম। 
২. স্তন ক্যান্সারের জন্য প্রতিমাসে একবার নিজে নিজের স্তন পরীক্ষার অভ্যাস করুন। 
৩.কোন সন্দেহ হলে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের টেলিফোনে পরামর্শ নিন। সেই অনুযায়ী পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিন। 
৪. কেবলমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ম্যামোগ্রাম বা আল্ট্রাসনোগ্রাম করুন।
৫. জরায়ুমুখের ক্যান্সার স্ক্রিনিং এর সময় হয়ে থাকলে আগে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের হটলাইন বা টেলিফোনে যোগাযোগ করুন। এপয়েন্টমেন্ট বা পরীক্ষার সিরিয়াল নিশ্চিত হলে সেবাকেন্দ্রে যান। 
৬. অন্যান্য ক্যান্সারের কোন লক্ষণ থাকলে কিংবা একাধিক ঝুঁকির উপাদান থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। নিজে নিজে টেস্ট করতে যাবেন না এই সময়ে। 
৭. স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার আগে নিশ্চিত হোন আপনার কোভিডের মত কোন উপসর্গ আছে কিনা। কিংবা আক্রান্ত কারো সংস্পর্শে এসেছেন কিনা। তথ্য গোপন করবেন না।চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীকে সঠিক তথ্য দিন।

আগামীনিউজ/এসপি/এমআর