প্রতিকূলতা সত্ত্বেও করোনা টিকার বড় উৎস হয়ে উঠতে পারে কিউবা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক   এপ্রিল ১৩, ২০২১, ০৫:১৭ পিএম
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকাঃ ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে একটি শক্তিশালী বায়োটেক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। আশির দশকে রাজধানী হাভানায় ছয় গবেষক নিয়ে একটি পরীক্ষাগার স্থাপন করে সেই প্রতিশ্রুতি পূরণে অনেকটা এগিয়েও নিয়ে যান। এরপর পার হয়ে গেছে ৪০ বছর।

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারীর মধ্যে ছোট এই দ্বীপরাষ্ট্রটি বায়োটেক খাতে বিশাল এক অর্জনের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। সেখানে তৈরি হচ্ছে ভাইরাসটির প্রায় পাঁচটি টিকা। এ খবর দিয়েছে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট। খবরে বলা হয়, পাঁচটি টিকার মধ্যে দুটি টিকা ট্রায়ালের শেষ ধাপে আছে। আগামী মে মাসের মধ্যেই টিকাগুলোর প্রয়োগ শুরু হতে পারে। সফল হলে কিউবার স্বাস্থ্যখাতের শক্তিমত্তার এক অনন্য নিদর্শন হয়ে উঠবে টিকাগুলো।

একইসঙ্গে দেশটির ধসে পড়া অর্থনৈতিক শক্তি পুনর্জ্জীবিত করতেও ভূমিকা রাখবে টিকাটি। ক্ষমতার শেষের দিকে এসে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের এই বিচ্ছিন্ন দেশটিকে সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক দেশগুলোর তালিকায় পুনরায় যুক্ত করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। এছাড়া, দেশটির উপর একাধিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে ট্রাম্প প্রশাসন।

কিউবার কর্মকর্তারা জানান, তারা স্বস্তা ও সহজে মজুদ করা যায় এমন টিকা তৈরি করছেন। কয়েক সপ্তাহ কোনো কক্ষের স্বাভাবিক তাপমাত্রাতেই সংরক্ষণ করা যাবে টিকাগুলো। আর সর্বোচ্চ ৪৬.৪ ডিগ্রি তাপমাত্রায় দীর্ঘদীন মজুদ রাখা যাবে। কিউবার এ চেষ্টা সফল হলে, অনুন্নত ও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোর জন্য করোনা মোকাবিলা অনেকটাই সহজ হয়ে উঠবে।

বর্তমানে ধনী রাষ্ট্রগুলোর চাহিদা মেটানোর খাতিরে সহজলভ্য টিকা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অনেক দরিদ্র দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার শিকার হওয়া দেশগুলোর জন্য কিউবা হয়ে উঠতে পারে টিকা পাওয়ার মূল উৎস। ইতিমধ্যে দেশটির সঙ্গে চুক্তি করেছে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় ভোগা ইরান ও ভেনেজুয়েলা। বর্তমানে কিউবার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় টিকা হচ্ছে সোবারানা ২।

প্রযুক্তি শেয়ার চুক্তির আওতায় ইরান সরকার ৫৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবী ইরানির উপর এই টিকাটির তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল চালাতে সম্মত হয়েছে। ইরানি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, টিকাটি সফল হলে ইরানেই তৈরি হতে পারে প্রায় ৪ কোটি ডোজ। প্রসঙ্গত, জানুয়ারিতে ইরানের সুপ্রিম নেতা এক ঘোষণায়, মার্কিন ও বৃটিশ টিকা আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা দেন। টিকাগুলোকে সম্পূর্ণভাবে ‘বিশ্বাসের অযোগ্য’ বলে বর্ণনা করেন তিনি। তবে তা সত্ত্বেও, ইরানি কর্মকর্তারা বৃটিশ-সুইডিশ কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত টিকার ৪০ লাখ ডোজ কিনেছেন।

যদিও প্রতিষ্ঠানটির বৃটিশ সম্পৃক্ততা এড়িয়ে গেছেন তারা। এদিকে, ভেনেজুয়েলার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হর্গে আরিয়েজা চলতি সপ্তাহে বলেছেন, কিউবার মেডিক্যাল সায়েন্স ও বায়োটেকনলজির উপর আমাদের আস্থা রয়েছে। এটা আমাদের জনগণের জন্য সত্যিকারের সমাধান হয়ে উঠবে। কিউবার জন্য করোনা টিকা প্রস্তুতে সফলতা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশটির মর্যাদা বৃদ্ধি করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় বাক-স্বাধীনতার নিয়ে বিক্ষোভ, কবি ও সমকামী অধিকারকর্মীদের দমন করে সমালোচিত হয়েছে দেশটির সরকার। চলতি সপ্তাহে কিউবার কর্মকর্তারা জানান, ট্রায়ালের তৃতীয় ধাপের ফলাফল ইতিবাচক আসলে মে মাসেই একটি বিশাল পরিমাণের ‘ইন্টারভেনশন গবেষণা’ চালাবে তারা।

হাভানার ১৭ লাখ জনগণের প্রায় সবাইকেই টিকা দেওয়া হবে। বছর শেষের আগেই দেশের সবাইকে টিকা দেওয়া হবে। তেমনটা হলে করোনার বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি অর্জনকারী প্রথম দেশ হয়ে উঠবে কিউবা। এতে করে পর্যটকদেরও আকৃষ্ট করতে পারবে তারা। কিউবার টিকা তৈরি কর্মসূচীর তত্ত্বাবধায়নে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠান বায়োকিউবাফার্মার প্রেসিডেন্ট এদোয়ার্দো মার্তিনেজ দিয়াজ বলেন, আমাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে কিউবার জনসংখ্যাকে টিকা দেওয়া।

এতে দেশটি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে ও পর্যটকদের জন্যও নিরাপদ হয়ে উঠবে। তবে কিছু কিছু সমালোচক বলছেন, টিকা কার্যক্রম নিয়ে একটু বেশি দ্রুতই আগাচ্ছে কিউবা সরকার। পরীক্ষামূলক টিকা জনগনের উপর প্রয়োগ করে, পর্যটন খাত স্বাভাবিক করতে চাইছে যাতে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়। কিউবা বিষয়ক ইউকাবাইটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা নর্গেস রদ্রিগেজ বলেন, এটা কোনো কার্যকর প্রমাণিত টিকা নয়। তারা এটা প্রয়োগ করোতে মানুষকে ব্যবহার করছে।

এরপর পর্যটকদের সেখানে গিয়ে টিকাটি নেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে চাইছে। কিউবা একটি কর্তৃত্ববাদী একদলীয় দেশ যেখানে বাকস্বাধীনতা, রাজনৈতিক কর্মসূচী ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দমিয়ে রাখা হয়। তবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের কারণে ছোট উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও এর বায়োটেকনলজি সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। বর্তমানে দেশটিতে রয়েছে অন্তত ৩১টি প্রতিষ্ঠান ও ৬২টি কারখানা, যেগুলোয় কাজ করে ২০ হাজারের বেশি কর্মী। তবে দেশটির গবেষকরা মাসে আয় করেন গড়ে মাত্র ২৫০ ডলার। কিউবার বায়োটেক খাতের উন্নতি শুরু হয় গত শতকের আশির দশকে। সেসময় ডেঙ্গু জ্বর মোকাবিলায় ইন্টারফেরন উৎপাদন করার উদ্যোগ নেন কাস্ত্রো।

বর্তমানে দেশটিতে বিভিন্ন রোগ মোকাবিলায় প্রয়োগ করা ১১টি টিকার আটটি সেখানেই উৎপাদন হয়। ৩০টিরও বেশি দেশে টিকা রপ্তানি করে তারা। ২০১৭ সালে ফুসফুস ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কিউবার সিমাভ্যাক্স ইম্যিউনোথেরাপি চিকিৎসার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয় নিউ ইয়র্কের রসওয়েল পার্ক কমপ্রিহেনসিভ ক্যান্সার সেন্টারে। সোবেরানা ২ এর পাশাপাশি কিউবার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় আরেকটি টিকা হচ্ছে আবদালা। টিকাগুলো শতভাগ কার্যকর হওয়ার জন্য দুই থেকে তিন ডোজ পর্যন্ত নিতে হয়। উভয় টিকায় উচ্চ পর্যায়ের প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি হতে দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে প্যান আমেরিকান হেলথ অর্গানাইজেশনের সহকারী পরিচালক জারবাস বারবোসা চলতি সপ্তাহে জানান, কার্যকর প্রমাণিত হলে টিকাগুলো ছয় মাসের মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পেতে পারে।

কিউবার গবেষকরা পশ্চিমা গবেষকদের তুলনায় তুলনামূলক বেশি কঠিন পরিস্থিতিতে কাজ করেন। এর মধ্যে রয়েছে সরবরাহে ঘাটতি, সরঞ্জামের ঘাটতি। এসবের জন্য মূলত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দায়ী। কিউবার বায়োটেক গবেষণায় সহায়তাকারী অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন মেডিকিউবা ইউরোপের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কো ক্যাভালি জানান, গত বছর করোনা ভাইরাস বিরোধী টিকাগুলোর কার্যকারিতা মূল্যায়নে তারা কিউবাকে ৫ লাখ ডলার সমমূল্যের সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে।

তবে, তিনি আরো বলেন, অনেক সময় কিউবার জন্য কিছু কিনতে চাইলে সমস্যার মুখে পড়তে হয় আমাদের। ট্রাম্প চলে গেলে, ইউরোপে পর্যন্ত কিউবার জন্য কিছু কেনা কঠিন হয়ে পড়েছে আমাদের জন্য। কিউবা জানিয়েছে, তারা দরিদ্র দেশগুলোকে জন্য বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে টিকা সরবরাহ করবে। কিন্তু অন্যান্য দেশগুলোর জন্য টিকার মূল্য থাকবে বেশি।

আগামীনিউজ/প্রভাত